অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে...

স্কুল জীবনে বাংলা সাহিত্যের পাঠ্যবইয়ে যেদিন সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ পড়েছি, সেদিন থেকেই ভ্রমণকাহিনি আমার আগ্রহের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। সত্যি বলতে কি, এই ভ্রমণ কাহিনিই আমাকে বই পড়ার সঙ্গে প্রেমের সেতুবন্ধন গড়ে দেয়! এই প্রেমে যে কত বাধা (মানে ক্লাসের পড়া) আর কত বিপত্তি (আমার কাছে পরীক্ষার অপর নাম) ! তবু, এর মধ্যেও শান্তির পরশ নিয়ে স্কুলের লাইব্রেরি আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমার হাতে তুলে দিয়েছে জুল ভার্নের ‘Around the world in 80 days’; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’। সেই থেকে আমি আর ভ্রমণ কাহিনি দুই বন্ধুর মতো পাশাপাশি হাত-ধরাধরি করে চলছি। এটা বলতেই হবে, শৈশবে আর স্কুল জীবনে পড়া সেই ভ্রমণ কাহিনিগুলো এক সুপ্ত অলীক স্বপ্ন হয়ে বাস করছে আমার অন্তরে। আজ একটু চেষ্টা করে দেখব, আপনাদের সঙ্গে আমার এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার অনুভূতি ভাগ করে নিতে।

আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর অরল্যান্ডো। একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বঙ্গোপসাগর নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য আমাকে এই শহরে যেতে হয়েছিল। শহরটির আবহাওয়া বড্ড খামখেয়ালিপূর্ণ। কখনো সে হাসবে তার রৌদ্রোজ্জল আভা নিয়ে; আবার কখনো বা সে হয়ে যাবে মুখভার, ঝাপটা মেরে বইয়ে দেবে ঝড়ঝাপটা! বোঝা দায়, কেন সে এমন করে!

অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে স্থাপিত ভাস্কর্য দ্য ট্রাভেলার
অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে স্থাপিত ভাস্কর্য দ্য ট্রাভেলার

ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বেশ আধুনিক। বিমানবন্দরের ভেতরে পা দিয়েই তাক লেগে গেল। বেশ বুঝতে পারলাম, কেন একে মার্কিন মুল্লুকের শীর্ষ দশ ব্যস্ততম বিমানবন্দরের একটি ধরা হয়ে থাকে। অরল্যান্ডো শহরটি যেহেতু পর্যটক প্রধান জায়গা, ভ্রমণকারীর সংখ্যা একটু বেশি হওয়ারই কথা। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি ভ্রমণকারীকে সামাল দিয়ে থাকে এই বিমানবন্দর, তখন আমার তো ‘চক্ষু চড়ক গাছ’! বিমানবন্দরের ভেতরে দোকানপাট, ক্যাফে আর মানুষের ব্যস্ততা দেখে ভিরমি খাওয়ার দশা হলো। বিমানের উঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জায়গাটা এতটা জমজমাট হয়ে যায়, যেন মনে হবে এখনই কোনো মেলা শুরু হলো।

বিমানবন্দরের এক প্রান্তে হঠাৎ নজরে এল, কেউ একজন এক টেবিলের ওপর ব্যাগে হেলান দিয়ে যেন ঝিমোচ্ছে! একটুখানি অগ্রসর হয়েই বুঝতে পারলাম, মানুষটাকে কাচের ঘরের মধ্যে রাখা হয়েছে! আমার খানিক দ্বিধা ছিল! বড্ড দোটানায় পড়ে গিয়ে আর ভীষণ রকমের কৌতূহলী হয়ে ভাবতে ভাবতে শেষমেশ আবিষ্কার করলাম, যা দেখছি তা সত্যিকারের মানুষ নয়!

অস্বীকার করা যায় না শিল্পীর আবেগ, ভালোবাসা আর পরম মমতার স্পর্শে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটি (সম্ববিৎ ফিরে পেয়ে পরে জেনেছি, তার নাম ‘দ্য ট্রাভেলার’) এতটাই নিখুঁত হয়ে ফুটেছে যে, প্রথম দেখায় যে কারও ভুল হতেই পারে। প্রায় ১৩ হাজার একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে এমন হরেক ভাস্কর্য আর চারু শিল্পের দেখা পাওয়া যাবে। তবে এই ‘দ্য ট্রাভেলার’ ভাস্কর্যটি অন্যতম দর্শনীয়।

এতই সুবিশাল বিমানবন্দর দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে সময় পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত চিত্ত শান্তি অনুভব করলাম। ভ্রমণ ক্লান্তি আমাকে আলিঙ্গন করার সুযোগই পেল না!

বছর দু-এক আগে, দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিঅন (Incheon) বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে ভ্রমণ অবসাদ থেকে দূরে থাকার সুন্দর ধারণা আমাকে দিয়েছিলেন—‘একঘেয়েমি ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করে তোলার জন্য আমাদের একটা গুণ থাকা প্রয়োজন; আর তা হচ্ছে চারপাশের অজানা পরিবেশকে বোঝার চেষ্টা করা এবং নিজেকে সেই পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে রাখা’। অরল্যান্ডো শহরের এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমার অভিজ্ঞতা এক কথায় তা-ই!