বাঙালির 'পরচর্চা' অসুখ

‘চর্চা’ শব্দটা উত্তম, অর্থবহ। আলোচনা, পড়াশোনা, অভ্যাস, অনুশীলন, গবেষণা ইত্যাদি ভালো অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, সাহিত্য চর্চা, শরীর চর্চা, ধর্ম চর্চা—এসব ক্ষেত্রে ‘চর্চা’ শব্দ চড় চড় করে মর্যাদার উঁচু চেয়ারে বসে আছে। কিন্তু শব্দটির মাথায় যেই না বসল ‘পর’, শব্দটি সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে পতন হলো। তখন শব্দটি হলো, যার সহজ ব্যাবহারিক অর্থ হলো—পরনিন্দা।

শব্দের অধঃপতন ঘটল ঠিকই, কিন্তু বিষয়টি হয়ে উঠল দারুণ সুস্বাদু লোকপ্রিয় আর লোভনীয়। পরনিন্দা একটি দোষ। এটাকে আমি জনপ্রিয়, লোকপ্রিয় বলছি বলে কেউ কেউ হয়তো মন ভারী করবেন। তা করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, ‘চুরি করা মহাপাপ’ জেনেও কিছু মানুষ হরদম চুরি করে। মিথ্যা বলা মহাপাপ জেনেও আমরা হড় হড় করে মিথ্যা বলি। তাই মুখে যত পরচর্চা পরনিন্দাকে ‘দূর ছাই, ছি ছি’ করি না কেন, পরনিন্দা আমরা সবাই করে থাকি। সানন্দে করি, উত্তেজনার সঙ্গে করি এবং উপভোগ করি। দাদ একটা ঘৃণ্য পচা রোগ, কিন্তু দাদ চুলকানোতে সুখ আছে!

এমন কেউ আছে নাকি, যিনি পরচর্চা করেন না? আছেন বৈকি। ব্যতিক্রম সবক্ষেত্রে থাকে, কিন্তু ব্যতিক্রম প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত নয়। শতকরা হয়তো পাঁচ বা দশ জন পরনিন্দা করেন না। মজার কথা হলো, বাকি ৯৫ জনই নিজেদের ওই শতকরার একজন বলে মনে করেন! ওই ৯০-৯৫ জনই বলেন, ‘পরনিন্দা করা আমার কপালে লেখা নাই। ওসব আমি কখনো করি না।’ লেখক যাযাবরের সেই উক্তিটি মনে পড়ে, ‘কৃতজ্ঞতা কথাটি আছে ইংরেজের ভাষায়-নেই তার চরিত্রে।’ ঠিক তেমনি বলা চলে, পরচর্চা করার অভ্যাসটি আছে ওই ৯৫ ভাগের চরিত্রে, কিন্তু ওটা লেখা নেই তাদের কপালে। আমাদের জ্ঞানী–গুণীজনেরা বলেন, ‘হে মানুষ, তুমি আত্মসমালোচনা কর। নিজের দোষ খুঁজে বের কর।’ মানুষ তাই করছে। রাম-শাম, কটাই-মজুর, মন্ত্রী-দারোগা, নেতা-চোর, বন্ধু-সহকর্মী, সহপাঠী, পাড়া–প্রতিবেশী, পুত্রবধূ, শ্বশুর–শাশুড়ি, ননদ, ভাবি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, অধীনস্থ কর্মী, পাড়ার দোকানদার—এক কথায় চারপাশের সর্বভূত অর্থাৎ সবাই তো আমার আত্মবৎ। ওদের সমালোচনা করা, ওদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করে ওদের পিছু চটকানোর নামই আসলে আত্মসমালোচনা। ওরা কি আমার পর!

পরচর্চা, পরনিন্দা হচ্ছে এক ধরনের বিনোদন মানে অ্যামিউজমেন্ট। প্রায় সব রকম অ্যামিউজমেন্টের জন্য সরকারকে কর দিতে হয়। এমনকি কাউকে মারলেও কর লাগে। একবার এক বীরপুরুষ স্ত্রীকে মেরে আহত করে কোর্টে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিচারককে সে বলল, হ্যাঁ, সে তার স্ত্রীকে মেরে হাতের সুখ মিটিয়েছে। তখন বিচারক রায় দিয়ে বললেন, মহিলাকে মেরে আহত করার জন্য ছয় মাসের জেল। সে সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। লোকটি বলল, সাজা তো পেলাম ছয় মাসের জেল। কিন্তু হুজুর, ওই পাঁচ হাজার টাকা কিসের জন্য? বিচারক বললেন, ওটা হাতের সুখ মিটানোর জন্য অ্যামিউজমেন্ট ট্যাক্স!

কিন্তু পরচর্চা নামক বিনোদনটি বিনা ট্যাক্সে যখন খুশি, যত খুশি করা যায়। সেই পৌরাণিক যুগ থেকে পরচর্চা বিনোদনের কাজ করে চলেছে। কিছুদিন আগে গ্রামগঞ্জের পুকুরঘাট ছিল মেয়েদের আড্ডার জায়গা। ওখানে পরচর্চার একেবারে পরাকাষ্ঠা দেখা যেত। এখন গ্রামাঞ্চলের পানির নল কল নির্ভর হয়ে যাওয়ায়, সেই পরচর্চার স্থানটি লুপ্ত হয়েছে। উঠান, বারান্দা, ক্লাবঘর, বৈঠকখানা, পাবলিক পাঠাগার, চায়ের দোকান এবং নাম করা কিছু আড্ডালয়ে হয়ে থাকে নানা বিষয়ে চর্চা। পরচর্চা ছাড়া অন্য বিষয়ে চর্চায় থাকে না তেমন ঝাল-টক-মিষ্টি। আর সেসব চর্চায় ‘এলেম’ লাগে। দরকার হয় বিদ্যাবুদ্ধির। তাই সেগুলো তেমন জমে না। সে কারণে চর্চাটি ঘুরেফিরে পৌঁছে যায় আসল স্টেশনে। আর যেইমাত্র চর্চা শুরু হলো পরের, অমনি সবার মুখ গেল খুলে—সবার স্টকে রয়েছে দুনিয়ার তাবৎ লোকের সব তাজা তাজা হাঁড়ির খবর।

শুরু হয়ে গেল অন্তহীন বিনোদন। স্বপ্নে পোলাও রাঁধতে কেউ কী ঘি ঢালতে কার্পণ্য করে! তেমনি চর্চা যখন শুরু হয় পরের, তখন তিলকে তাল, নারকেলকে সষে, নরকে বানর বানাতে বাধা কোথায়!

আমাদের ভাষায় ‘রাজা উজির মারা’ বলে একটা কথা আছে। অনেকেই রাজা উজির মেরে থাকেন। এমনিতেই রাজা উজির মারা সহজ কর্ম নয়। কিন্তু অতি সহজে তাদের মারা যায়, শুধু ওই পরচর্চার বধ্যভূমিতে। বসে গেলাম কয়েকজন সেখানে, তারপর বাস্তবে যাদের নাগাল পাব না, পেলেও তাদের সামনে ‘টু’ শব্দটি করতে পারব না—শুরু করলাম তাদের চর্চা, মানে নিন্দা। এরপর ওদের মেরে কেটে, ল্যাং মেরে ধরাশায়ী করে কুপোকাত করে, নরাধম বানিয়ে আহা কি সুখ! কি সুখ!!

এমনিতে যদি লাঠি, চাকু, বন্দুক নিয়ে মারতে যাই, তবে কিন্তু নিজে মরার সম্ভাবনাও থাকে। তার ওপর পুলিশ, কোর্ট কাছারির আঠারো ঘা অবধারিত। কিন্তু পরচর্চার আসরে প্রতিপক্ষকে যত মার, যত খুশি ঘায়েল কর, কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। যাকে মারলাম, ঘায়েল করলাম, তার কোনো ক্ষতি হলো না-আমারও তো কোনো ক্ষতি হলো না উপরন্তু লাভ হলো। দাদ চুলকানোর সুখের মতো মানসিক অসুখ চুলকানোর সুখ! সুতরাং পরচর্চা এমন আর কী মন্দ!

তা ছাড়া একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করেছে। মর্জি মতো সে আসে–যায়–থাকে অথবা থাকে না। আকাশের বুনো বিদ্যুতের মতো তারের বিদ্যুৎও ঝিলিক দিয়ে পালিয়ে যায়। রবিঠাকুরের ‘আজ ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায়...’ গানের সুরে স্বাচ্ছন্দ্যে গাওয়া যায়—আজ ক্ষণে ক্ষণে আলোয় ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা। বিরক্তিকর লোডশেডিংয়ের সময়টাতে টাইম পাসিংয়ের এক মস্ত বড় পন্থা হচ্ছে ওই পরচর্চা। ওই সময়টাতে পরচর্চা শুরু করলে দেখতে দেখতে ওই অন্ধকার সময়টা বড্ড মজায় কেটে যায়। এটি একেবারে পরীক্ষিত সত্য। সুতরাং পরচর্চা তো বলা যায় নতুন ধরনের এক আঁধার বিনোদন খেলা।

কোনো আড্ডায় যখন সাপে কামড়ানো অথবা ভূতের গল্প শুরু হয়, তখন উপস্থিত সবাই একটা না একটা নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলবেন। আর আপনার কোনো অসুখ করলে আপনার সব চেনাজানা লোক, বন্ধু-বান্ধব সবাই আপনাকে কোনো না কোনো ওষুধের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে দেবে। তখন আপনার মনে হবে, একমাত্র আপনি ছাড়া পৃথিবীর আর সবাই ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, ওঝা, তান্ত্রিক, টোটকা বিশারদ! ঠিক তেমনি পরচর্চা যার বিষয়ে চর্চা হয়, সেই অনুপস্থিত লোকটির কোনো না কোনো দোষ-ত্রুটি, কেলেঙ্কারি, কুকর্মের গল্প চর্চাকারীদের সবার জানা। সে গান তারা গাইবে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যখন শ্মশানে মরা পোড়ায়, তখন অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি উপস্থিত শ্মশান বন্ধুরা প্রত্যেকে এক এক খণ্ড আমগাছের ডাল জ্বলন্ত চিতায় ফেলে দেয়। এটাকে বলে ‘জ্ঞাতি কাষ্ঠ’। পরচর্চার ক্ষেত্রে সবাই চর্চিত লোকটির চিতায় নিজ নিজ অবদানের ‘জ্ঞাতি-কাষ্ঠ’ জোগান দিতে বড় উৎসুক থাকেন। এতে আমাদের ঐক্যহীন দেশে ঐক্য বাড়ে। পরচর্চার আসরে আমরা দারুণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। পরচর্চায় আমাদের সাংঘাতিক একতা।

বলা হয়, পেন ইজ মাইটার দেন সোর্ড। অর্থাৎ অসির চেয়ে মসির শক্তি বেশি। ঠিক তেমনি নিন্দা কম শক্তিশালী নয়। সহজে বলা চলে, নিন্দুক ইজ মোর পাওয়ারফুল দেন বন্দুক। এতসব ভালো দিক থাকলে কিন্তু একটা উপদেশ নৈতিক কারণে দিতে হয়। যেমন প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে—‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক’, তেমনি আমাদের জানা উচিত পরচর্চা নৈতিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকারক।

সাবধান বাণী থাকা সত্ত্বেও সিগারেট বাজারে চলছে। সিগারেটের মুখাগ্নি করে নিজেদের শিগগির মুখাগ্নি করানোটা এগিয়ে আনছে অনেকে, তেমনি পরচর্চা, পরনিন্দা লিখেই চলবে। কারণ, কোনো কালে ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনি’।