আমেরিকার গোপন সভার কার্যবিবরণী

(৩১তম পর্ব)

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পরপরই ওয়াশিংটনে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিশেষ অ্যাকশন গ্রুপ পাকিস্তান–ভারত সংকট নিয়ে গোপন সভা করে ৩, ৪, ৬ ও ৮ ডিসেম্বর। নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলামিস্ট জ্যাক অ্যান্ডারসন সেই গোপন সভার কার্যক্রম ফাঁস করেন এবং তা ছাপা হয় ৬ ও ১৩ জানুয়ারির পত্রিকায় যার শিরোনাম ছিল, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকার শীর্ষ পর্যায়ের গোপন আলোচনার নথি’ [Tests of secret documents on top-level U.S discussion of Indian-Pakistani war]

এই সভায় আমেরিকার সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সিআইএ প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এসব সভার সারমর্ম ও কার্যবিবরণী থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মিলে, আমেরিকা একতরফা পাকিস্তানকে সাহায্য করছিল এবং যেকোনোভাবে চাইছিল জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুদ্ধটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থগিত করতে। যদি ভারত অনমনীয় মনোভাব না দেখাত এবং রাশিয়া আমাদের পক্ষে কথা না বলত, তাহলে হয়তো আমাদের স্বাধীনতা অর্জন বিপর্যস্ত হতো।
প্রকাশিত ওই সংবাদটি সংক্ষেপে এমন—
সভায় উপস্থিত:
প্রেসিডেন্টের বিশেষ নিরাপত্তা উপদেষ্টা
ড. হেনরি এ কিসিঞ্জার
আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট জন আরউইন
ডেপুটি সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স ডেভিড প্যাকার্ড
সিআইএ ডাইরেক্টর রিচার্ড হেলমস
চেয়ারম্যান, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ অ্যাডমিরাল,
থমাস মুর
অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট জোসেফ সিসকো
অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স ওয়ারেন নটার
অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট সেমুয়েল ডি পালমা
প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স

সারমর্ম

পশ্চিম অঞ্চল থেকে পাওয়া পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। সিআইএ পূর্ব পাকিস্তানের যেসব অঞ্চল ভারত দখল করেছে, তার একটি মানচিত্র দিতে সম্মত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৯৯ মিলিয়ন ডলার ও পিএল ৪৮০–এর অধীনে ৭ মিলিয়ন ডলার স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন। বিকেলে নিরাপত্তা পরিষদের সভার আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত জানার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিসিঞ্জার ১৯৫৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।

কার্যবিবরণীর অংশবিশেষ

কিসিঞ্জার: আমি প্রতি আধা ঘণ্টায় প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ‘হেল’ পাচ্ছি যে, আমরা ভারতের প্রতি কঠোর হচ্ছি না। তিনি এই মাত্র আবার কল করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন না, আমরা তার পক্ষে কাজ করছি। তিনি চান, আমরা যেন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকি। তিনি মনে করেন সবকিছুই তার বিপরীত হচ্ছে।

হেলমস (সিআইএ প্রধান): উভয় পক্ষ থেকেই পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে, শুধু একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে পাকিস্তান অমৃতসর, পাঠানকোট এবং শ্রীনগর এয়ারপোর্টে বিমান হামলা করেছে। পাকিস্তান সব সীমান্তেই ভারতীয় আক্রমণ হয়েছে বলে দাবি করলেও ভারত তা মিথ্যে বলেছে। তবে পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয়েছে, পাকিস্তান বলছে সাতটি ফন্টে আক্রমণ হয়েছে।

কিসিঞ্জার: ভারত কি কোনো অঞ্চল দখল করছে?

হেলমস: হ্যাঁ, অবশ্যই সামান্য কিছু অঞ্চল।

সিসকো: এটি খুব ভালো হয় যদি যে সব এলাকা ভারত দখল করেছে, সেসব অঞ্চল চিহ্নিত করে একটি মানচিত্র পাওয়া যায়। পশ্চিমে কী হচ্ছে—পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হচ্ছে?

হেলমস: মিসেস গান্ধীর ভাষণ ভালোভাবেই বাংলাদেশের স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে।

কিসিঞ্জার: এটা কি সম্ভব ভারত প্রথমে আক্রমণ করেছিল?

মুর: অবশ্যই সম্ভব।

দ্বিতীয় সভা: ৪ ডিসেম্বর আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিশেষ অ্যাকশন গ্রুপের উপমহাদেশর সংকট নিয়ে আবার গোপন সভা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ সভায়ও হেনরি কিসিঞ্জারসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমেরিকা তড়িঘড়ি করে জাতিসংঘকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ থামানোর জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। সভার সারমর্ম ও কিছু বক্তব্যের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো—

সারমর্ম

সিদ্ধান্ত হয় যে, আমেরিকা জরুরিভাবে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করবে এবং শুরুতেই জাতিসংঘে আমেরিকার দূত বুশ বক্তব্য রাখবেন। পাকিস্তানের সাহায্য বন্ধ করা হবে না।

কার্যবিবরণী

হেলমস: সভায় প্রথমেই বলেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সব সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ভারত করাচিতে পেট্রোলিয়ামের মজুতে আক্রমণের ফলে যে আগুন জ্বলছে, তা বেশ কিছুদিন জ্বলবে। হেলমস আরও বলেন, সোভিয়েতরা মনে করে আন্তর্জাতিক শক্তি এই যুদ্ধে লিপ্ত হবে না।

কিসিঞ্জার: ভারত যে পাকিস্তানে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করেছে, তা জাতিসংঘের বিবৃতিতে স্থান পেতে হবে। বিবৃতিটি হোয়াইট হাউসের কোনো আমলাকে দিয়ে লেখাতে প্রেসিডেন্টের স্পষ্ট নির্দেশ আছে।

কিসিঞ্জার জাতিসংঘে কী হচ্ছে জানতে চাইলে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট পালমা বলেন, সম্ভবত যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জাপান এবং ফ্রান্স সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভা আহ্বানের কথা বলেছে।

আগামী ৬ ডিসেম্বর এই বিষয়ে আবার সভা হবে বলে কিসিঞ্জার জানান।

তৃতীয় সভা: ৬ ডিসেম্বর সভার সারমর্ম এবং কার্যবিবরণীর কিছু অংশ—


বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে সভায় ব্যাপক আলোচনা হয়। এতে কিসিঞ্জার নির্দেশনা দেন, বিষয়টি সম্পর্কে এখনই পর্যালোচনা করা প্রয়োজন এবং পাকিস্তানকে কীভাবে সামরিক সাহায্য করা যায় তাও দেখা দরকার।

সিআইএ প্রধান হেলমস সভার শুরুতে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পূর্বাঞ্চলে সর্বাত্মক যুদ্ধ অব্যাহত আছে। ভারত পশ্চিমাঞ্চলেও পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যস্ত রেখেছে। হেলমস মনে করেন, ১০ দিনের মধ্যেই ভারত পূর্বে চূড়ান্ত কিছু করতে পারবে। পূর্বে ভারত আকাশ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ঢাকার বিমানবন্দর সম্পূর্ণ বন্ধ। ভারত যশোর ও কমলপুর দখলে নিয়েছে। পাকিস্তান ৬১টি ভারতীয় বিমান এবং ভারত ৪৭টি বিমান ভূ-পতিত করার দাবি করেছে। মস্কো জাতিসংঘের যুদ্ধ থামানোর কোনো প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে না। কিসিঞ্জার জানতে চান, বাংলাদেশ নিয়ে কী করা যায়। উত্তরে হেলমস বলেন, এটি এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, ভারত এটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস আবার ১৪ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বিশেষ অ্যাকশন গ্রুপের ৮ ডিসেম্বরে সভার সারমর্ম ও কার্যবিবরণীর অংশবিশেষ প্রকাশ করে। এই সভায়ও কিসিঞ্জারসহ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা তথা সিআইএ প্রধান, সামরিক তিন বাহিনীর প্রধান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সারমর্ম

কিসিঞ্জার মনে করেন, ভারত পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানের স্থল ও বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করে তাকে নির্বীজ করতে চায়। তিনি জর্ডান কর্তৃক পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব বাতিল না করে আপাতত স্থগিত রাখেন।

কার্যবিবরণীতে সিআইএ প্রধান হেলমস পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। ভারতীয়রা কুমিল্লা দখল করেছে। শুধু একটি প্রধান নদী পার হলেই ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করতে পারে। তারা দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মিসেস গান্ধী জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে কাশ্মীর সীমান্ত অঞ্চলে নিজেদের দখল পাকা করতে চায়। ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অদূর ভবিষ্যতে স্বীকৃতি দেবে। অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট সিসকো জানতে চান, পাকিস্তান কত দিন পূর্বাঞ্চলে তাদের দখল রাখতে পারবে? জবাবে হেলমস বলেন, ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা। (চলবে)

ইমেইল: [email protected]