অমানিশার কুশীলব

প্রতিযোগিতামূলক যেকোনো খেলাধুলার সংগঠক ও কোচেরা রিজার্ভ বেঞ্চ পাইপ ও লাইনকে শক্তিশালী করতে সব সময় চিন্তিত থাকেন। দলটি জাতীয় পর্যায়ের বা স্থানীয় পর্যায়ের ক্লাব হোক, রিজার্ভ বেঞ্চ ও পাইপ লাইনকে শক্তিশালী করতে সমর্থ না হলে অষ্টপ্রহর অস্বস্তির মধ্যে থাকেন সংগঠক ও কোচেরা। পাইপলাইন শক্তিশালী হলে, রিজার্ভ বেঞ্চ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্তিশালী হয়। পাইপ লাইনকে দৃঢ়, মজবুত, শক্তিশালী করার জন্য জাতীয়ভাবে বয়সভিত্তিক দল গঠন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জাতীয় ও ক্লাব—দুই পর্যায় থেকেই পাইপলাইন শক্তিশালী করার উদ্যোগের অভাব থাকে না। এ ক্ষেত্রে ক্লাব ও জাতীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোর পকেটে টঙ্কা আগমনের পাইপলাইনও থাকতে হয় অবাধ ও নিরূপদ্রব। টঙ্কা বা টাকার পাইপলাইনে বাধা সৃষ্টি করে কোন রকম উপদ্রব করা যাবে না, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় দেশের ক্লাব ও জাতীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোতে। টঙ্কা আগমনের পথ হতে হবে স্বচ্ছ (!), জবাবদিহিমুক্ত। ক্লাব কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত হিসাবকে বেহিসাবি করে ফুলে–ফেঁপে ওঠার পথকে করে দিতে হবে সুগম, এর ব্যত্যয় ঘটলে সুইজারল্যান্ড নামক দেশের কোন কোন ব্যাংকের রিজার্ভ কমে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারে।

আমরা যা–ই বলি না কেন, এই ভুগ্রামে উন্নত দেশ হিসেবে অন্য দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়েও তো আমাদের ভাবতে হবে। খেলাধুলা, দেশীয় অর্থনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোতে অবদান রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনকে স্বাধীন কিংবা জাহাঙ্গীরনগর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় মডেলে অথবা রংপুর মেডিকেল কলেজকে অনুসরণ করে নিয়ন্ত্রণহীন করে দিতে হবে। এসব সংস্থাকে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসনের দিতে হবে। স্বায়ত্তশাসনের ধারা, উপধারা তৈরির জন্য আমাদের মুকুটবিহীন অসংখ্য ‘সম্রাট’ ও সহযোগীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নবান্ধব স্বায়ত্তশাসন বিল পাস করা অতি আবশ্যক। বিলের খসড়া প্রস্তুতির জন্য বিদেশ থেকে কোন পরামর্শক নিয়ে আসতে হবে না। এ ক্ষেত্রে আমরা স্বনির্ভর। আমাদের বিষয় বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বা সাবজেক্ট মেটার স্পেশালিষ্টদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। প্রয়োজনে বালিশ উত্তোলন পরিকল্পনাকারী কিংবা পর্দা ক্রয়কারী দল সহযোগিতা করতে পারে। বিশেষ প্রয়োজনে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘এক মেবা দ্বিতীয়ম’ ঢাকার উত্তরাঞ্চল এবং অস্ট্রেলিয়ায় একাধিক বাসগৃহ ও অগাধ সম্পদের অধিকারী মান্যবর করণিক ও তাঁর স্ত্রীকেও আমরা বিল প্রস্তুতি দলে কো-অপ্ট করতে পারি।

আমাদের জাতীয় পাইপলাইন ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া অত্যন্ত সৃজনশীল। রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের অফিস সহকারীর মেধা কাজে লাগিয়ে ‘পাশা খেলাকে’ আধুনিকীকরণ করে ক্রীড়া উন্নয়নে অবদান রাখার অবাধ সুযোগ এই প্রক্রিয়াতে বিদ্যমান। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলকে যদি সরবরাহ প্রক্রিয়াতে যুক্ত করা না যায়, তাহলে ‘সকলই গরল ভেল’ হয়ে যেতে সময় লাগবে না, বিষয়টিকে তাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে। এ জন্য সব সময় সরকারি দলকে ভালোবেসে দেশসেবায় অবদান রাখা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের দলে শুধু যুক্ত নয়, যথাযথ পদ দিয়ে সম্মানিত করার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এসব ব্যক্তির দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। তারা জানেন কী করে, সামগ্রিক প্রক্রিয়াতে ক্ষমতা বলয়ের কাদেরকে যুক্ত করতে হবে, ডান, বাম, মধ্য, উদার, আইনশৃঙ্খলার শাখা-প্রশাখার সবাই মিলে নিপুণভাবে ভাগ-বাটোয়ারার এক চমৎকার ও ভীতিহীন পদ্ধতি পরিচালনায় তারা অতুলনীয়। জাতির ক্রীড়াশক্তিকে সবল রাখার জন্য আসলে তারা নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা। সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গন ও তার সব ধরনের পাইপলাইনকে সচল, প্রাণবন্ত করাই তাদের ‘রাজনৈতিক’ অঙ্গীকার।

এ রকম অঙ্গীকারকে বাস্তবায়নের জন্য তাঁদের পিছু পিছু ছোটে ব্যাকআপ বা পাইপলাইনের দল। ঢাকা শহরে বসবাসকারী অনেকেই দলগুলোর চমকপ্রদ কিছু নাম শুনে অভ্যস্ত। নামগুলো কিন্তু স্মার্ট ও আকর্ষণীয়। ডিসকো বয়েস, দ্য বস, পোটলা বাবু, ভাইপার, ব্লাক রোজ, নাইন এম এম বয়েজ, নাইন স্টার, ক্যাসল বয়েজ—এ রকম শত শত প্রতিভাবান দল পাইপলাইন ও রিজার্ভ বেঞ্চে সক্রিয়। তারা স্থানীয়ভাবে তাদের কর্মকুশলতা প্রদর্শন করে ইতিমধ্যে কৃষ্ণ সাম্রাজ্যের ‘সম্রাট’দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও পত্র–পত্রিকা তাদের কিশোর গ্যাং বলে অভিহিত করে, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স কিন্তু প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই, যদিও ১৪ বছর বয়স থেকে তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করার অলিখিত রেওয়াজ আছে বলে মনে করা হয়। ২০–৩০ বছরের কিশোরকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা আসলে অন্যায় কিছু নয়, ৭১ বছরের বৃদ্ধ যদি যুবকদের নেতৃত্ব দিতে পারেন জাতীয়ভাবে, ৩০ বছরের যুবককে নিলে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বা জাতীয় মান বজায় রাখা হয় অন্তত।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলা এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে একজন সাবেক কিশোর গ্যাং লিডারের সাক্ষাৎকার নিয়ে অত্যন্ত তথ্যবহুল একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গ্যাং কীভাবে সংগঠিত হয়, প্রাথমিকভাবে তারা কী কাজ করে—এ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য বিবিসি বাংলার রিপোর্টটির কিছু অংশ পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সাবেক গ্যাং লিডারকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়—

‘শুরুতে মূলত অন্যদের হামলা থেকে নিজেদের প্রটেক্ট করার জন্যই আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্রিত হই। পরে বেশ বড় একটা গ্যাং তৈরি হয় আমাদের।’
‘পরে আমরা দেখলাম, এটা একটা ট্রেন্ড। সবাই গুন্ডামি করছে, গ্যাং বানাচ্ছে, দেয়ালে দেয়ালে স্প্রে দিয়ে গ্যাংয়ের নাম লিখছে। তখন আমরাও শুরু করলাম। ৫/৬টি গাড়ি নিয়ে একসঙ্গে মুভ করতাম। একসময় বেশ বড় একটা গ্যাং তৈরি হয় আমাদের।’
‘তবে গ্যাং তৈরি হওয়ার পর খুব দ্রুতই অন্য এলাকার গ্রুপগুলোর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়।’
‘অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও ঘটতো মারামারির ঘটনা। এক এলাকার ছেলে অন্য এলাকায় গেলে মারধরের ঘটনা ঘটতো।’
কাউকে গালি দিলে, ‘যথাযথ সম্মান’ না দেখালে, এমনকি বাঁকা চোখে তাকানোর কারণেও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। মেয়েলি বিষয় ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকেও অসংখ্য মারামারি হয়েছে আমাদের মধ্যে।’
‘আমাদের গ্যাংয়ে একসময় কয়েকটা আর্মস ক্যারি (অস্ত্র বহন) করা শুরু করি আমরা। এসব দিয়ে মাঝে মধ্যে ফাঁকা ফায়ারিং করা হতো। তবে আমরা কাউকে গুলি করিনি কখনো।’
‘আমাদের গ্যাংয়ের কয়েকজনের মধ্যে একটা সময় লোভ চলে আসে। গ্রুপটিকে কাজে লাগিয়ে টাকা আদায়ের ধান্দা শুরু করে কেউ কেউ। ছিনতাই শুরু হয়। আর মাদক নেওয়া তো ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায়।’ (বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক এই প্রতিবেদনে কিন্তু ওয়ার্ম আপ পিরিয়ড বা খেলাধুলার জন্য মাঠে নামার পূর্বে গা গরমের সময়ের কথা বলা হচ্ছে। এতে করে কেউ আমাদের পাইপলাইনের শক্তিকে ‘আন্ডারএস্টিমেট’ করবেন না। তাদের মানও কিন্তু জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কাছাকাছি।

সুখের বিষয়, জাতীয় দল যে শক্তিকে নির্ভর করে এগিয়ে যেতে পেরেছে, পাইপলাইনের কিশোর দলও কিন্তু একই অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। রসুনের গাছ মাটির ওপর যেভাবেই বিস্তার লাভ করুক না কেন, গোড়াতে তাদের অবস্থান কিন্তু একই সূত্রে গ্রন্থিত। এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক একতা আসলে অনুকরণীয়।

সম্প্রতি ‘আমি তোমাকে লাভবান করব, তুমিও আমাকে লাভবান করো’—এই নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মের কিছু কুশীলবকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা পত্রিকান্তরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পাওয়া কিছু তথ্য জানতে পারছি এবং কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেছি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হচ্ছে, এই যে কালো জগতের প্ল্যাটফর্ম যতটুকু জাল বিস্তার করেছে, তার শেকড় অনেক গভীরে। আশার কথা, সরকারের শুভ ইচ্ছাকে খুব দৃঢ় বলে মনে হচ্ছে। রাজনীতিকরণের মাধ্যমে সব অপকর্ম সংঘবদ্ধ দল ন্যায়ানুগ করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, সাম্প্রতিক সরকারি তৎপরতাকে সেই শক্তির বিরুদ্ধে আন্তরিকভাবে শুদ্ধিকরণের প্রয়াস বলে মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তিকে আশ্রয় করে, রাজনীতির নামে আমাদের সম্ভাবনাময় কিশোর, তরুণদের পাইপলাইনে সংঘবদ্ধ করে নিকষ অন্ধকারে নিপতিত করার যে আয়োজন করেছে, আমরা বিশ্বাস করি সাম্প্রতিক অভিযান সৎ ও নিবেদিতভাবে পরিচালিত হয়ে অন্ধকারের শক্তিকে অপসারণ করতে সক্ষম হবে।

আমাদের সম্ভাবনাময় কিশোর, তরুণদের পথ ভ্রষ্ট করা, রাজনীতি এবং সমাজকে নীতি ও মূল্যবোধ বিবর্জিত করার এই অপচেষ্টাকে চলমান শুদ্ধি অভিযান থামাতে পারবে বলে আমাদের অপার বিশ্বাস। সুন্দরের প্রতি, নিবেদিত ভালোবাসার প্রতি, শুভ শক্তির প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থা আছে, চিরায়ত বাংলাদেশ তো অনাদিকাল থেকে আলোকময়, সুন্দর ও সত্যের জন্য লড়াই করে এসেছে। পাইপলাইনকে শক্তিশালী করার এই অশুভ উদ্যোগ তো খুবই সাময়িক, বুকে হাত দিয়ে যারা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান গেয়ে আনন্দ অশ্রু ঝরায়, তাঁরা তো আলোর পথের যাত্রী, তাদের রুখবে কোন অপশক্তি?