আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি সম্ভব

আমরা জাগতিক জীবন নিয়ে মত্ত হয়ে থাকি এবং ভুলে যাই পরকালের কথা। ইহকালের জীবন হচ্ছে অতি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু পরকালের জীবন হচ্ছে অনন্তকালের। সেই জীবনের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। আমরা হইকালে যেমন কর্ম করব, পরকালে তেমন ফল ভোগ করব। ইহকাল হচ্ছে আমাদের জন্য একটি পরীক্ষার জায়গা। নিজের চিন্তা শক্তির সঠিক ব্যবহার করে যারা সঠিক পথ অবলম্বন করবে, তারাই হইকালের পরীক্ষায় সফল হতে পারবে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মনুষ্য জাতিকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মনুষ্য জাতিকে তিনি স্বাধীন চিন্তা শক্তির ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন, যা দিয়ে মানুষ ভালো ও মন্দ বিচার করতে পারে এবং সঠিক পথ বেছে নিতে সক্ষম হয়।

মজার ব্যাপার হলো, আমরা অন্যের ভালো-মন্দের বিচার যেভাবে করতে পারি, সেভাবে নিজের ভালো-মন্দের বিচার করতে পারি না, কিংবা বিচার করি না। কাউকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয়, অপর একজন ব্যক্তির দশটি দোষ খুঁজে বের করতে, দেখা যাবে তিনি হয়তো ওই ব্যক্তির শতাধিক দোষ খুঁজে বের করে ফেলেছেন। আমরা অন্যের চলাফেরা, কথাবার্তায়, কাজকর্মে ও সার্বিক দিক বিবেচনা করে অনেক দোষ বা ভুল ধরতে পারি। অন্যের ভুল বা দোষ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে সমালোচনা করতে করি। যদিও এটা একদমই অনুচিত ও গর্হিত কাজ। আমরা অন্যের ভুল বা দোষ খুঁজে বের করে তাকে সংশোধন করতে অনেক পরামর্শ দিয়ে থাকি, কিন্তু সেটা উচিত ছিল নিজের জন্য করা। নিজের সমালোচনা করাই হচ্ছে আত্মসমালোচনা। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মসমালোচনা করাই অতি উত্তম কাজ।

মানুষকে স্বাধীন চিন্তা শক্তি দেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে তিন ধরনের নফসের সম্মিলন ঘটেছে। নাফসে আম্মারাহ, নফসে লাউওয়ামাহ এবং নাফসে মুতামাইন্না। এর মধ্যে নফসে আম্মারাহ বা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে জৈবিক কামনা-বাসনা ও দুনিয়ার লোভ-লালসার দিকে আকৃষ্ট করে তাকে মন্দ কাজের দিকে নিয়ে যায়। একমাত্র আত্মসমালোচনার দ্বারাই নিজের কুপ্রবৃত্তি দমন করা সম্ভব। আরবি ‘মুহাসাবাতুন নাফস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘আত্মার হিসাব গ্রহণ করা’। ইংরেজিতে একে বলা হয়, self-criticism/self-accountability অর্থাৎ আত্মসমালোচনা।

পারিভাষিক অর্থে আত্মসমালোচনা বলতে বোঝায়, সচেতনভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করা বা পরিত্যাগ করা, যাতে কৃতকর্ম সম্পর্কে নিজের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। সুতরাং যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ হয়, তবে তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। আর যদি তা আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কাজ হয়, তবে তা থেকে বিরত থাকা। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ তথা ইবাদতে মশগুল রাখা। আত্মসমালোচনাকে প্রতিটি মোমিনের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ও না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন (অর্থাৎ তারা কোন কাজটি ভালো, কোনটি মন্দ তা বাছাই করা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে)। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক।’ (সূরা: হাশর- ১৮)।

আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে পবিত্র কোরআনের অপর একটি অংশে আল্লাহ বলেছেন, ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে।’ (সূরা আল আ’রাফ–৭/২০১)। আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নির্দেশনা হতে হজরত ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯, সনদ মওকুফ ছহীহ)।

হজরত ওমর (রা.)–এর এই বাণী থেকে এখানে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মসমালোচনা করে নিজেদের দোষ ও ভুলগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং নিজেকে সংশোধন করে নিতে হবে। আমরা যদি আত্মভোলা হয়ে যাই, তাহলে পথভ্রষ্ট হয়ে আমরা ভুল পথে পা বাড়িয়ে দেব। নিজের ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে দ্বিধাহীন পাপকর্মে লিপ্ত হব। যার কারণে পরকালে পেতে হবে কঠিন শাস্তি। আমরা আমাদের চিন্তা শক্তি দিয়ে নিজেদের প্রতিটি কাজের ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতা রাখি। তাই আত্মসমালোচনা করা কোনো কঠিন কাজ নয় বরং আত্মসমালোচনায় ইহকাল হবে সুন্দর ও পরকালের হিসাব-নিকাশ একদম সহজ হয়ে যাবে।

আমরা কোনো কাজের সংকল্প করার আগেই সে কাজটি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে যে, কাজটি ইহকাল ও পরকালের জীবনের জন্য উত্তম না ক্ষতিকর? কাজটি কি হারাম, না হালাল? কাজটিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে, না অসন্তুষ্টি? অতঃপর যখন কাজটি উত্তম হবে, তখন আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে কাজে নেমে পড়তে হবে। আর কাজটি খারাপ হলে একইভাবে পূর্ণ একনিষ্ঠতা ও তাওয়াক্কুলের সঙ্গে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিদিন সকালে আন্তরিকভাবে প্রত্যয় দীপ্ত হতে হবে, যেন সারা দিন সৎ আমলের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা যায়। আবার দিন শেষে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারা দিনের সব কাজকর্মের ওপর আলোকপাত করতে হবে। যদি কোনো কথা বা কাজে কোনো ভুল বা দোষ থাকে, তার জন্য আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে অনুতপ্ত হতে হবে। ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ হতে বিরত থাকার প্রত্যয় রেখে তওবা করতে হবে। কারও সঙ্গে কোনো অন্যায় করলে, তার কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। এভাবেই চলতে পারলেই নিজেকে সংশোধন করে পাপকর্ম হতে বিরত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে।

মোট কথা, একমাত্র আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের আত্মশুদ্ধি সম্ভব। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে পরিশুদ্ধ মানুষ হতে হলে আত্মসমালোচনার কোনো বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের আত্মসমালোচনা করার তৌফিক দান করুন। আমিন।