প্রাইভেট কোচিং

শিক্ষা যে অমূল্য, তা কে না জানে। কতটা অমূল্য? বলা হয়, একটি অক্ষর যিনি শেখালেন, সেই গুরুর ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। কিন্তু এই শিক্ষাই একালে এসে পণ্যে পরিণত হয়েছে। এখন এই পণ্যায়নের মাত্রা আরও অনেক গুণে বেড়ে গেছে। এটি একই সঙ্গে শিক্ষার্থী–অভিভাবকের ওপর আর্থিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।

শিক্ষায় পণ্যায়নের বিষয়টি এবার সামনে এসেছে নিউইয়র্কের বিশেষায়িত স্কুল ঘিরে চলা কোচিং–বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। নিউইয়র্কের নয়টি বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তির জন্য প্রতিবছর রীতিমতো ইঁদুর–দৌড়ে নামতে হয় শিক্ষার্থীদের। সন্তানদের এই ইঁদুর–দৌড়ে নামতে প্রস্তুত করার জন্য অভিভাবকদেরও নামতে হয় একই রকম দৌড়ে। কারণ, ‘যথাযথ প্রস্তুতির’ জন্য চাই কোচিং সেন্টারে পড়ানোর মতো অর্থ। ফলে হাইস্কুল পর্যায়েই ভালো স্কুলে পড়ার বিষয়টি অধিকারের বদলে সুযোগে পরিণত হচ্ছে।

নিউইয়র্কের মতো শহরে এমনিতেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করাটা অনেক ব্যয়বহুল। এ কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর একমাত্র ভরসা পাবলিক স্কুলগুলো। এসব স্কুলের মধ্যে নয়টি স্কুলকে বিশেষায়িত হিসেবে দেখা হয়, যার শুরু ১৯৭২ সালে। বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে উচ্চ অনুদানের মাধ্যমে এ নয়টি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। উন্নত মানের শিক্ষার কারণে এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরাও পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষায় ভালো করে। বিভিন্ন নামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃত্তি নিয়ে পাঠের সুযোগ পায়।

যেকোনো মা-বাবারই লক্ষ্য থাকে যেন তাঁদের সন্তান উচ্চশিক্ষিত হয়। কারণ, কে না জানে, মূর্খ শত সন্তানের চেয়ে একটি জ্ঞানী সন্তান উত্তম। ফলে সন্তানদের জন্য সর্বোচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে সদা উদ্‌গ্রীব থাকেন অভিভাবকেরা। নিউইয়র্কের অভিভাবকেরা তাই স্বাভাবিকভাবেই বিশেষায়িত স্কুলেই সন্তানদের পড়াতে বেশি আগ্রহী। প্রথমত, এসব স্কুল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ভালো উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃত্তিসহ পড়ার হার বেশি। দ্বিতীয়ত, এসব স্কুলে ভর্তি করা গেলে সন্তানের উচ্চশিক্ষা ব্যয় কম হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু এ দুটি চাওয়াই ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে কোচিং–বাণিজ্যের কারণে।

বিশেষায়িত স্কুল ঘিরে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলোর মিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। উচ্চ ব্যয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এড়াতে যে পাবলিক স্কুলের দিকে তাঁরা মনোযোগ দিলেন, কোচিং–বাণিজ্যের কারণে তা–ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। বিষয়টিকে বৈষম্য হিসেবে বিবেচনা করে অনেক আগেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। বিশেষায়িত স্কুলের ভর্তি প্রক্রিয়ায় বদল আনার কথা বলছেন তিনি অনেক দিন থেকেই। একইভাবে বিশেষায়িত স্কুল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশি সংগঠন ড্রামসহ ২৫টি সংগঠন।

কিন্তু বিশেষায়িত স্কুল বন্ধ করে দেওয়াটা সমাধান নিয়ে আসবে না। কারণ, এসব স্কুল শিক্ষার্থীদের বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ার মতো করে তৈরি করে, যা একটি নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি আশীর্বাদ। এসব স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোচিং সেন্টারগুলোও শিক্ষার্থীদের তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। মনে রাখা দরকার, এসব কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করে অনেক শিক্ষার্থী আমেরিকার নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ শিপসহ ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। পাশাপাশি অভিভাবকদের স্বল্প শিক্ষা, সময়ের অভাব, ভাষা ও বিষয়গত অসুবিধা কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য বাধা হয়ে ওঠে। এই বাধা কাটাতে সাহায্য করে কোচিং সেন্টারগুলো।

তবে প্রশ্ন আছে, কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যয় নিয়ে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এটি তাদের ব্যবসা নয়। কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানে পড়ার ব্যয় অনেককেই আশাহত করছে। প্রতিযোগিতার বাজারে আরও ভালো ভালো কোচিং সেন্টার গড়ে উঠলে হয়তো কিছু প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য দুর হবে। কমবে কোচিং–এর ব্যয়।