যেভাবে বাগদাদি বধের অভিযান চালায় মার্কিন সেনারা

আবু বকর আল-বাগদাদি। এএফপি ফাইল ছবি
আবু বকর আল-বাগদাদি। এএফপি ফাইল ছবি

হোয়াইট হাউসের ‘সিচুয়েশন রুমে’ গত শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রবেশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা। এর আগে বিকেল চারটা পর্যন্ত গলফ খেলেই কাটান ট্রাম্প। গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েই রুমে ঢোকেন তিনি।

সিচুয়েশন রুম হলো হোয়াইট হাউসে তৈরি ‘যোগাযোগ কেন্দ্র’, যেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর আগে ২০১১ সালে ২ মে ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করা হয়, সে সময়ও সিচুয়েশন রুমে বসে পুরো অভিযান পর্যবেক্ষণ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

শনিবার বিকেলেও এমনই আরেকটি দৃশ্যের অবতারণা হয়। ৬ হাজার মাইল দূরে মার্কিন অভিজাত সেনাবাহিনী জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে। এবার তাঁদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি।

ইরাকে তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। উত্তরাঞ্চল থেকে আটটি হেলিকপ্টার নিয়ে কয়েক শ মাইল দূরে প্রতিকূল অঞ্চলের দিকে উড়ে যায় মার্কিন সেনাবাহিনী। সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুড়ঙ্গ কেটে পরিবার নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন বাগদাদি ও তাঁর অনুসারীরা। এই সুড়ঙ্গের খোঁজ কয়েক দিন আগে পায় মার্কিন সেনারা। তখন থেকেই সেটি নজরে রেখেছিল তারা।

বহুদিন ধরে বাগদাদিকে খুঁজছিল মার্কিন সেনারা। এ জন্য সিরিয়ার একাধিক জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে দিনের পর দিন লুকিয়ে ছিল সেনারা। শেষে জানা যায়, ইদলিবির একটি বাড়িতে গোপন আস্তানায় গা–ঢাকা দিয়েছেন বাগদাদি। বিষয়টি নিয়ে খানিকটা রেকি করে মার্কিন সেনারা। এরপরই রুদ্ধশ্বাস হামলা হয় ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

প্রথমেই সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ উড়িয়ে দেয় মার্কিন সেনারা। বাগদাদি দ্রুত সুড়ঙ্গের টানেলে চলে যান। বাগদাদি এমনটা করতে পারেন আগেই এমনটা ধারণা করেছিল মার্কিন সেনারা। ওই টানেলেই সুইসাইড ভেস্ট পরেন বাগদাদি।

পরে গতকাল রোববার এই অভিযানের বিষয়ে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া ওই ভাষণে বাগদাদি কীভাবে নিহত হন, সে বর্ণনা দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশিক্ষিত কুকুরগুলো তাঁকে (বাগদাদি) ধরতে তাড়া করলে তিনি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দৌড় দেন। এ সময় তিনি ভয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে এসে নিজের গায়ে থাকা বিস্ফোরকভর্তি জ্যাকেট খুলে ফেলেন। এতে তিনি ও তাঁর সঙ্গে থাকা তিন সন্তান আত্মঘাতী হন।

এই অভিযানকে ‘বিপজ্জনক ও দুঃসাহসী রাতের যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছিলেন ট্রাম্প। অসাধারণ কায়দায় এটি চালানো হয়েছে বলে পরে বিবৃতি দেন তিনি।

ট্রাম্প বলেন, বাগদাদির বীরের মতো মৃত্যু হয়নি। তিনি কাপুরুষের মতো মারা গেছেন। কাঁদছিলেন, চিৎকার করছিলেন এবং বাচ্চাদের নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করেন। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা শেষ মুহূর্তে বাগদাদির অবস্থা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। এই অভিযানে কোনো মার্কিন সেনা আহত হয়নি।

অবশ্য পরে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় দুজন সামান্য আহত হয়েছেন। ওয়াশিংটন সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বাগদাদি নিহত হন বলে নিশ্চিত করে মার্কিন সেনারা।

ইরাকে জন্ম নেওয়া বাগদাদি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায়। তাঁর আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ আল-সামারাই। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আড়াই কোটি মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে আল-কায়েদার প্রয়াত প্রধান ওসামা বিন লাদেন ও অঙ্গসংগঠনের বর্তমান নেতা আয়মান আল জাহিরিকে ধরিয়ে দিতে সমপরিমাণ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন।

যদিও বাগদাদি নিহত হওয়ার খবর এটাই প্রথম নয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে ইরাকের মসুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলায় বাগদাদির নিহত হওয়ার খবর বের হয়। পরের বছরের জানুয়ারিতে সিরিয়ার যুদ্ধ পর্যবেক্ষক যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন সিরিয়ান অবজারভেটরি অব হিউম্যান রাইটস জানায়, ওই হামলায় বাগদাদি নিহত হননি। তিনি আহত হয়েছেন। ওই বছরেরই ২০ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বাগদাদির বিষয়ে এ ধরনের খবর প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালের ১৬ জুন সিরিয়ার রাকায় (আইএসের কথিত রাজধানী) মার্কিন বিমান হামলায় বাগদাদির নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।

এসব সংবাদ প্রকাশের পর বাগদাদিকে কোথাও দেখা না যাওয়ায় একসময় ধরেই নেওয়া হয়েছিল, বাগদাদি হয়তো নিহতই হয়েছেন। কিন্তু চলতি বছরের ২৯ মার্চ এক ভিডিওতে দেখা যায় তাঁকে। সেখানে তিনি শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডেতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জন্য হামলাকারীদের প্রশংসা করেন। আইএসের প্রচারমাধ্যম আল-ফুরকান ওই ভিডিও প্রকাশ করে।