বাঙালির পিঠা উৎসব

কথায় আছে বাঙালির বার মাসে তেরো পার্বণ। আর প্রত্যেক পার্বণেই বাঙালি সংস্কৃতির এক একটা রূপ ফুটে উঠে। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি পিঠার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত। বাহারী পিঠা কার না পছন্দ। শৈশব থেকে আজ অবদি পিঠা একটি মুখরোচক খাবার হিসেবে আমাকে আসক্ত করে। পিঠার নাম আর মাছের নামের কোনো শেষ নেই। স্থান–কাল–অঞ্চল ভেদে এসব নামের জৌলুশে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেয়েছে। যেমন মাছের কথাই ধরা যাক, মাছের রাজা ইলিশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে বিভিন্নভাবে মানুষের রসনাতৃপ্তি মেটায়। তেমনি সাধারণ পিঠাকে অসাধারণ উপায়ে তৈরির মাধ্যমে রসনাতৃপ্ত করা হয়। আসলে পিঠা তৈরি বা খাওয়ার একটা উৎসবকে উপলক্ষে আনতে হয়। নিত্যদিনও পিঠা খেতে বাধা নেই, তবে কোনো উৎসব ছাড়া পিঠা তৈরি বা খাওয়া একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
বাংলার বিভিন্ন নবান্ন উৎসব ও বিশেষ কোনো আচার অনুষ্ঠানে অনেক ধরনের পিঠা তৈরির প্রচলন আদিকাল থেকেই চলে আসছে। দেশের ভাটি অঞ্চল নামে খ্যাত এলাকায় বোরো ধানের চারার জন্য যে বীজ সংরক্ষিত হয়, তা থেকে কিছু অবশিষ্ট বীজ রোদে শুকিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে চালের গুঁড়া থেকে এক ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়, যা স্থানীয় ভাষায় জালামুরা পিঠা নামে খ্যাত। তা মূলত কৃষকের ঘরেই তৈরি হতো। কৃষি কাজে উৎসাহিত করতেই এ ধরনের পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হতো। শরীরে তেল চকচকে কালো চামড়ার ভেতর সুডৌল পেশি দীপ্ত কৃষকরাই দিনমান বিল–বাঁওড়ে কাজ করে দানাপানির ব্যবস্থা করে দিত সভ্য সমাজের মুখে।
সারাদিন ভূমি মালিকের কামলা খেটে জীবনভর উপহার দিয়ে চলেছে সোনালি ফসল। এরাই ভূমিহীন চিরদুঃখী কিষানদের বংশধর। শুধু দুবেলা আহার আর বছর শেষে চুক্তি অনুযায়ী কয়েক মন ধান, লুঙ্গি গামছা পেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। সারা বছর পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তা ভাতে সকালের খাবার, দুপুরে শুঁটকির তরকারি তাদের জন্য বরাদ্দ থাকত এবং তাতেই তাদের সন্তুষ্টি। খালি গায়ে সারা দিন খাটুনির পর হয়তো তাদের রুচির খানিকটা পরিবর্তন হতো, তাই তাদের সন্তুষ্টির জন্যই সম্পদশালী গৃহস্থ ঘরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে পিঠা উৎসবের আয়োজন হতো।
অগ্রহায়ণের নবান্নে আমন ধানের কাটা মাড়াই শেষে সিলেট অঞ্চলে এক ধরনের পিঠা তৈরি হতো, তাকে স্থানীয় ভাষায় রুট বা রুটি বলা হতো। নতুন আতপ চালের গুঁড়ির সঙ্গে লবণ, আদা, হলুদ মিশিয়ে ৮-৯ ইঞ্চি গোলাকার ও আধা ইঞ্চি পুরু করে তৈরি পিঠা গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায় নিচে কলাপাতা বিছিয়ে রাখা হতো, তার ওপরে কলাপাতা রেখে শুকনো খড় দিয়ে খুব ভালোভাবে পোড়ানো হতো, পিঠাগুলো পুরোপুরি না ঝলসানো পর্যন্ত খড়ের মধ্যে আগুন জ্বালানো হতো। পরদিন সকালে পিঠাগুলো ছোট ছোট টুকরো করে সবার মধ্যে পরিবেশন করা হতো। এই পিঠাগুলো ঘি মাখিয়ে খেতে খুবই মুখরোচক, এ দিয়ে হতো সকালের নাশতা। এসব পিঠা তৈরি হতো কৃষকের উৎপাদিত নতুন ধানের বাড়তি ফলনের উদ্দেশ্য করে।
পৃথিবীর সব দেশেই পিঠার প্রচলন আছে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে এক ধরনের পিঠার প্রচলন আছে, তা ইডলি নামে পরিচিত। দক্ষিণ ভারতীয়রা তাদের সকালের নাশতা ইডলি ছাড়া চিন্তাই করে না।
আমাদের দেশে যেসব পিঠা অতি সহজলভ্য তার মধ্যে চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটি সাপটা, তেলে ভাজা চালের গুঁড়ার সন্দেশ। নারিকেলের ভাপা পিঠা, সুজির তৈরি ভাপা পিঠা, ডুবো তেলে ভাজা আদা হলুদ যুক্ত বরা, দই বড়া ইত্যাদি। বাংলার গৃহস্থ পরিবারে এক ধরনের পাঁপড় তৈরি হয়। চালের গুঁড়ার তৈরি পাতলা খামির কলাপাতার মধ্যে লেপে তাওয়ার মাধ্যমে করা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে তেলে ভাজা করে চিনির শিরার সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। সাগু দিয়েও এক ধরনের পাঁপড় তৈরি করা হয়।
আজকাল প্রবাসেও আমরা বাংলার ঐতিহ্যকে লালন করছি নানা পিঠা উৎসবের মাধ্যমে। বাঙালি ললনারা সাজগোজ করে মুখরোচক পিঠা তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবসায়িকভাবে তা কমিউনিটির মধ্যে পরিবেশন করছেন। তাতে রথ দেখা, কলা বেচার মতো উপস্থিত দর্শকেরা উপভোগ করছেন।