সবার আগে চাই শিক্ষার সুযোগ

সুশিক্ষা, মানব সম্পদ এবং শিক্ষার আধুনিকায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো জাতীয় স্বার্থে সম্প্রতি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। শুধু পরিমাণগত বিস্তার নয়, গুণগতমানের শিক্ষা সুনিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষত কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির আগমন ও বিশ্বায়নের কারণে শিক্ষা এখন দেশ ও জাতির গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও একই ধারায় ওই অঙ্গনে প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে সৃজনশীলতা বিকাশের বিষয়টিও।
শিক্ষার গুণগত মান অনেক লক্ষ্যেই অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে প্রবর্তিত হয়। গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের বিষয়টি, এসএসসি ও এইচএসসিতে কার্যকরী হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও এটি সমন্বিতভাবে প্রয়োগের আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। এসএসসি ও এইচএসসিতে গ্রেডিং পদ্ধতি কার্যকরী হওয়ায় একটি সুস্থ ধারার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি জাতির একটি প্রত্যাশা পূরণ ও আশান্বিত হওয়ার বিষয়। গ্রেডিং পদ্ধতির পাশাপাশি নকল প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান, মাধ্যমিক সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষার সময়সীমা নির্ধারণ ও নির্দিষ্টকরণ, উপস্থিতির বিষয়ে সতর্কতা ইত্যাদি কার্যক্রম ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা হলেও গতি পায়। বোর্ড কর্তৃপক্ষের কিছু নির্দেশনাও সহায়ক হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আয়োজন করে কৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। উদ্দেশ্য একটিই, ভবিষ্যতের নাগরিকদের উৎসাহ জোগান, আত্মবিশ্বাসী করা।
এসএসসি-এইচএসসিতে অর্জিত ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারিভাবে বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডে মেধাবৃত্তি প্রদান করে আসছে, যা সব সময় উদ্দীপক ও সহায়ক ভূমিকা রাখছে। উপরন্তু এটি শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার কাছেই সম্মানজনক বৃত্তি হিসেবে বিবেচিত এবং এটি উচ্চ শিক্ষা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা এতই ব্যয়বহুল, অনেক ক্ষেত্রে পণ্য বলা হয়ে থাকে। শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি সব অনুষঙ্গই ব্যয়বহুল, সাধারণের নাগালের বাইরে। এ কথা আমাদের সবার জানা, শিক্ষার ধারা বিশেষভাবে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী অবদান রাখছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। এসব পরিবার সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়াস চালায়। কিন্তু বাস্তবতা হল, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে মাঝপথে পড়াশোনার পাঠ চুকাতে হয়, যা জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের বিষয়। এ কথা সবাই স্বীকার করেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এরা হয় পরিবারের সত্যিকারের সম্পদ। পরবর্তীতে এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবারের দায়িত্ব নেয়, শিক্ষার প্রসার ঘটায়।
আশার কথা, এসব মেধাবীর সমস্যা অনুধাবন করে, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখেই মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করতে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, এনজিও, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘শিক্ষা ঋণ প্রকল্প’ চালু করেছে। শিক্ষা সমাপনান্তে কর্মজীবনে প্রবেশের পর এই ঋণ নির্ধারিত নিয়মে পরিশোধযোগ্য। এ ধরনের সুযোগ ও উদ্যোগ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। আমাদের দেশে এ উদ্যোগ আরও প্রসার লাভ করুক, শিক্ষার্থীরা নির্ভাবনায় পড়াশোনার সুযোগ লাভ করুক, এটাই কাম্য। শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নেও এটি পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষাঋণ দেবে, তারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অগ্রসরতার বিষয়টি নিরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে পারেন। যেমন প্রতি বছর/টার্মে টাকা তোলার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ফলাফল বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা বা এ ধরনের অন্য কিছু। অবশ্যই এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয়, কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ বা মঞ্জুরীকৃত ঋণের টাকা যেন সময়মতো শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যায় তাও দেখতে হবে, যাতে তাকে ঋণের টাকার জন্য পড়ার সময় নষ্ট করতে না হয়, ঋণ কার্যক্রমই সেভাবে পরিচালিত হবে। প্রাপ্ত সুযোগ ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষিত হবে, অর্জিত শিক্ষা মূল্যবোধ অর্জন ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার উপকরণাদি উদ্ভাবন ও আয়ত্বকরণে সক্ষমতা অর্জন করবে—এটা আশা করা যায়।
কথা উঠেছে, বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী আকর্ষণের কৌশল হিসেবে এই প্রকল্প চালু করেছে—এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটি জাতির দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, আর্থিক বিষয় নিয়ে নতুন সংকটে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মানুষ মানুষের জন্য। মানুষের শুভবোধের প্রতি আস্থা রেখে বলতে চাই, সব অপবাদ, প্রতিবন্ধকতা দূর করে এ উদ্যোগ জাতির জন্য সুফল বয়ে আনুক। শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে ঋণ গ্রহীতারা ঋণ পরিশোধের ধারাটি শুধু শিক্ষা সহায়ক হিসেবে নয়, শিক্ষার অধিকার প্রাপ্তির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকে সুদৃঢ় করবে। একজন সুশিক্ষিত মানুষ তার বিবেকের স্বপক্ষে, নীতি ও মূল্যবোধ রক্ষায় দৃঢ়তার পরিচয় দেবে—এটা সমাজ আশা করে।
বাংলাদেশে ক্রমাগত উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে সম্পদের বৈষম্য। বেসরকারি হিসাব মতে, এখনো শতকরা ৪০ জন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বিষয়টির বাস্তবচিত্র দেখাতে আমাদের খুব বেশি দূর যেতে হয় না। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। অবস্থার পরিবর্তনে একটু ভালো থাকার আশায় গ্রামের ভিটেমাটি ছেড়ে অনন্যোপায় হয়ে শহরমুখী যারা, তারা ক্রমান্বয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়ছেন। তাদের নতুন নামকরণ হচ্ছে ‘ছিন্নমূল’। শহরে রেল স্টেশন, বড় রাস্তার পাশে, রেল লাইনের ধারে গড়ে উঠে বস্তি। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ সব মাথার ওপর দিয়ে যায়। এ এক করুণ, অমানবিক, অসহায় অবস্থা। সারা দিন পরিশ্রম করে কোন রকমে উদরপূর্তি। কোন রকমে প্রাণ টেকানো, এই তো চিত্র। উপরন্তু গ্রামে নিজ ভিটায় থাকাকালে সন্তানকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর যে সুপ্ত ইচ্ছেটুকু ছিল, বৈরী পরিবেশের তপ্ত হাওয়ায় তা হারিয়ে যায়। গ্রামে খাবার কষ্ট থাকলেও শহরে কাজ করে খাব, এ আশায় গুড়েবালি। বরং গ্রামের সৎ জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলো ইচ্ছা–অনিচ্ছায় নানাবিধ অসামাজিক, অমানবিক কাজে জড়িয়ে পড়ে, মাকড়সার জালের মতো সমস্যার জাল তাদের কেবল জড়িয়ে ধরে।
এদের নিয়ে আমাদের আলাদা করে ভাবতে হবে, নিতে হবে প্রতিকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। অন্যথায় আমাদের শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন—সব হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। এরা (ছিন্নমূল) নিজের জন্য ভাবে না, কিন্তু সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায়, সুন্দর জীবন যেন তারা পায়, তা দিতে চায়। কিন্তু পারে না, কারণ জীবন বাঁচানো যখন দায়, তখন অন্য ভাবনা স্থান পায় না। এদের সন্তানদের (প্রাথমিক) শিক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। প্রয়োজন মানব সম্পদে পরিণত করা।
সাধারণত দেখা যায়, যেখানে বস্তি গড়ে উঠে সেখানে শিক্ষার সুযোগ থাকে না। শিক্ষার পরিবেশ তো নয়ই। বস্তিবাসীদের অধিকাংশই নিরক্ষর। সন্তানকে লেখাপড়ায় সাহায্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এদের নাম ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া পরিবেশ অস্বাস্থ্যকরসহ আরও অনেক সমস্যাতো আছেই।
এসব সমস্যার আলোকে সমাধান অর্থাৎ বর্তমানে যারা বস্তিতে রয়েছে তাদের সন্তানদের শিক্ষার আওতায় আনা এবং গ্রামের ভিটে–মাটি ছেড়ে বস্তিবাসী হওয়ার স্রোত বন্ধ করতে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সমন্বিতভাবে করা প্রয়োজন। আমরা দেখি, অনেক এনজিও কিছু কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এদের নিয়ে কাজ করছে। লক্ষণীয়, এদের পরস্পরের সমন্বয় ও দায়বদ্ধতার। আমরা জানি, বলা যত সহজ, কাজ করে লক্ষ্য অর্জন তত সহজ নয়। আবার এটি প্রমাণিত, মানুষের সাহস, প্রজ্ঞা ও মমতার কাছে সবই পরাভূত। আমাদের সৌভাগ্য, মানবিক ও সর্বাধুনিক ধারণা নিয়ে গ্রামের নারীদের নিয়ে কাজ করে গ্রামীণ ব্যাংক বাস্তব নির্দেশনা দিয়েছে। দারিদ্র্য নিরসনে দরিদ্রদের শক্তি ও সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের সরকারি-বেসরকারি অনেক ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান, কৃষি ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, বিসিকের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে। জাতীয় দায়বদ্ধতা থেকে সমন্বিতভাবে এদিকে লক্ষ্য রেখে উদ্যোগের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদি ঋণ দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত কিছু প্রকল্প।
অর্থায়ন-প্রশিক্ষণ, নিবিড় পর্যবেক্ষণ (উৎপাদন ও বিপণন) সন্তানকে বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয়ে পাঠানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমাদের বিভিন্ন শিল্প-কারখানাগুলো সুনির্ধারিত উপশহর এলাকায় ক্রমে ক্রমে স্থানান্তর করে শহরগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষায় সরকারিভাবে চিন্তা ভাবনা চলছে। বৃহত্তর স্বার্থে কারখানা মালিকদের বাধ্যতামূলক জনকল্যাণমুখী কাজে উহসাহিত করা দরকার। প্রত্যেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমজীবী মানুষদের সন্তানদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য ঠিক রেখে সমন্বিতভাবে কাজটি করতে পারে।
মানুষের জয়রথ ক্রমশ ধাবমান, আকাশ, সাগর জয় করে দৃষ্টিসীমা প্রসারিত দূরে আরও দূরে। আমাদের কাছে অতি কাছে অমিত সম্ভাবনাময়ী মানুষের শিক্ষার সুযোগটুকু সমবেতভাবে অবারিত করা যায় না? পারি না মানুষকে বোঝা না ভেবে সম্পদে পরিণত করতে? অনেক কাজ আমাদের করতে হবে, কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন সৎ মানুষের। সে সাদাকালোর নির্দেশিকা দেবে, বোধ জাগাবে শিক্ষাই। কাজেই সবার আগে চাই শিক্ষার সুযোগ।