শীত আসলেই স্মৃতিকাতর বাঙালি

প্রবাসের জীবন বিচিত্র। অনেক ভালো লাগার সঙ্গে আছে অনেক না–পাওয়ার বেদনা। অনেক পুরোনো স্মৃতির অ্যালবাম। শীতকাল মানেই বাঙালির পিঠা-পুলির উৎসব। শীত এলেই শুরু হয় পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম। আমাদের প্রবাসে শীত শুরু হয় শীতের ভয়ে, কখনো কুয়াশার চাদরে পুরো শহর ঢেকে শীতের সকাল শুরু হয়। রোজগার করে, কাজ করে, পিঠা বানানো কয়জনের হয়? তবে শীত আসলে অলস সকালে হারিয়ে যাই সেই পুরোনো দিনগুলোতে।
আমার মনে আছে, যখন স্কুলে পড়তাম। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে স্কুলের বন্ধে আমরা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। সেই দিনগুলো একেবারেই স্বপ্নের মতো মনে হয় এখন। গ্রামে সকাল শুরু হতো খেজুরের রসে মুখ ভিজিয়ে। খুব ভোরে কিছু মানুষ দিয়ে যেত সেই রসে ভরা হাঁড়িগুলো। শীতকালে শুরু হয় পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম। এ সময় ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। সেই ধানে ভরে ওঠে কৃষকের গোলা। চাল তৈরির কল এখন গ্রামে পৌঁছে যাওয়ায় ঘরে ঘরে ঢেঁকিতে আর আগের মতো ধান ভানার দৃশ্য দেখা যায় না। শীতকালে তখন গ্রামবাংলার গৃহস্থ বাড়িতে ঢেঁকিতে চিঁড়ে কোটার ধুম লেগে যেত। বানানো হতো চালের গুঁড়ি—পিঠাপুলির জন্য। ঢেঁকির একটানা ‘ঢুকুর’ ‘ঢুকুর’ শব্দ শুনতে বেশ ভালো লাগত। শখ করে আমরাও ছোট ছোট পা দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম ঢেঁকিতে। সারাবেলা সবাই মিলে পালাক্রমে শুরু করত ঢেঁকিতে ধান ভানা। তারপর চাল গুঁড়ো করা হয়। তা দিয়ে তৈরি করা হয় নানা পিঠা।
শীতের সময় গ্রাম বাংলায় পাওয়া যায় খেজুর রস। এই রসে ভেজানো হয় পিঠা। দেশজুড়ে পিঠা তৈরির ব্যস্ততা চোখে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে ধুম পড়ে যায় পিঠা বানানোর। তেমনি দেখতাম পিঠা বানানোর আয়োজন চলত আমার দাদা বাড়িতেও। কাজের মানুষগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের বাড়ির বউড়াও আসত আমার মা–চাচিদের কাজে হাত দিতে। দাদা–দাদি থাকত আমাদের নিয়ে ব্যস্ত। শীতের পিঠা-পুলি বাঙালির ঐতিহ্যের এক ধারা। পৌষের হিমেল হাওয়া ছাড়া যেমন শীতকে কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি পিঠা ছাড়াও বাঙালির ঐতিহ্য ভাবা যায় না।
শীতের সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে পিঠা তৈরি করে কাটাত ব্যস্ত সময়। আমাদের বাড়ির উঠানে দেখতাম পাটি বিছিয়ে দেওয়া হতো অনেকগুলো। আর সন্ধ্যার পর হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। তখন গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বাতি ছিল স্বপ্নের বিষয়। বড় বড় শহর, বন্দর ছাড়া অনেক জেলা-উপজেলায়ও বিদ্যুৎ ছিল না। অতিরিক্ত আলোর জন্য তখন কেরোসিন দ্বারা হ্যাজাক লাইট (বাতি) জ্বালানো হতো। গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ মাহফিল বা বড় কোনো অনুষ্ঠান হলে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে অতিরিক্ত আলোর ব্যবস্থা করা হতো। দিনের মতো চারদিকে উজ্জ্বল করে দিত সেই আলো আর একপাশে ব্যবস্থা করা হতো গ্রামোফোন (যাকে আমরা কলের গান বলেই চিনি)। তাতে গান বাজত। সবাই মিলে চাঙারি ভরে (বাঁশ বেত প্রভৃতি দিয়ে তৈরি বড় ঝুড়ি বিশেষ) পিঠা বানাতো। সবাই নানা গল্পে, হাসি–তামাশায় কাটিয়ে দিত অনেক রাত। সঙ্গে চলতো নানা রকম খাওয়া–দাওয়া আর কেটলির পর কেটলি চা শেষ হতো। বেশির ভাগ সময় অনেক মানুষ
মিলে তারা কোলই পিঠা বানাত ভেতরে নারিকেলের পুর দিয়ে।
গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে, গুড়ের রস দিয়ে তার মধ্যে ভিজিয়ে দুধ কোলই তৈরি করত। আরও কত রকম পিঠা যে তারা বানাত! সকাল বেলা বানাতো ভাপা পিঠা। শীতের দিনের গরম–নরম ভাপা পিঠার স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। শীতের দিনে নানা বাড়ি থেকে ডালা সাজিয়ে আমার বাবার জন্য নিয়ে আসত নানা ধরনের পিঠে। জামাই আদর বলে কথা। অঞ্চল ভেদে একই পিঠা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত! যেমন তেল পিঠাকে উত্তরবঙ্গের অনেক এলাকায় বলে পাকান পিঠা।
বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত পিঠার মধ্যে রয়েছে ভাপা পিঠা, পানতোয়া, চিতই পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, দোল পিঠা, নকশি পিঠা, পাকান, আন্দসা, কাটা পিঠা, ছিটা পিঠা, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি–পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চাঁদ পাকান, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, রস পিঠা পাটিসাপটা পিঠা, পুলি, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, ক্ষীরকুলি, কুশলি, মালাই, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ লতিকা, ঝালপোয়া, সূর্যমুখী, নারকেলি, সিদ্ধপুলি, ভাজা পুলি, দুধরাজ ইত্যাদি।
আনন্দের আয়োজনও রয়েছে প্রচুর। চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড়-পাটালি তৈরি হয়। এ সময় রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে যায় যেন। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় খেজুর রস থেকে চমৎকার গুড় ও পাটালি তৈরি হয়। তবে সব এলাকায় বেশ উন্নত মানের চমৎকার নান্দনিক পাটালি তৈরি হয়। অনেক ধৈর্য, শ্রম আর যত্নসহকারে এই বিশেষ সুস্বাদু আর শৈল্পিক পাটালি তৈরি করেন পাটালির কারিগর তথা শিল্পীরা। শুধু গুড়-পাটালি-পিঠাপুলি ক্ষীর-পায়েস আর মোয়া নয়, উঠোনের কোনায় বড় চুলোয় নতুন চালের মুড়ি ভাজার ব্যস্ততাও চোখে পড়ত।
সকালের মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রসে ভেজানো মুড়ি, গুড়-মাখানো মুড়ির মোয়া কিংবা নোলেন পাটালি দিয়ে মচমচে মুড়ি খাওয়ার কথা মনে হলেই জিবে পানি এসে যায়। শীত আসলেই মনে পড়ে পুরোনো দিনের সেই সোনালি দিনগুলোর কথা। প্রবাসে এত পিঠা আমরা পাই না। যখনই কোনো পিঠা উৎসব বাঙালিরা আয়োজন করে, আমরা খুশি মনে চলে যাই প্রিয় পিঠার স্বাদ নিতে।