বাঙালির মননচর্চায় রণেশ দাশগুপ্ত

রণেশ দাশগুপ্ত। ফাইল ছবি
রণেশ দাশগুপ্ত। ফাইল ছবি

রণেশ দাশ গুপ্তের স্মরণে গঠিত জাতীয় শোক কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর সংক্ষিপ্ত শোক-সংবলিত একটি লিপি প্রকাশ করে। জাতীয় কমিটির সন্নিবেশিত লিপির আলোকে তাঁর জীবনী ও জীবনাচার নিয়ে এই লেখা।
চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে বহু চড়াই–উতরাই, বাধা–বিঘ্ন পেরিয়ে বাঙালির মননচর্চা ও মুক্তি-প্রয়াসকে বলবান করার কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন রণেশ দাশ গুপ্ত। সেই সঙ্গে সব ধরনের বাহুল্যবর্জিত নিরাভরণ সরল জীবনাচারের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঋষিতুল্য সাধক। সংগ্রামী এই অনন্য মনীষীর প্রয়াণে সেদিন গোটা জাতির পক্ষ থেকে কমিটি গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর জীবন ও কর্মের আদর্শ থেকে শক্তি আহরণের শপথ করে।
রণেশ দাশ গুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি। বাবা অপূর্বরত্ন দাশ গুপ্ত ছিলেন খ্যাতনামা খেলোয়াড় এবং ক্রীড়া কুশলতার সুবাদে চাকরি পেয়েছিলেন বিহারের হিসাব দপ্তরে। তাঁর কাকা ছিলেন গান্ধীবাদী স্বদেশি, শিক্ষকতা ছাড়াও কাকা নিবারণ দাশ গুপ্ত জড়িত ছিলেন রাজনীতিতে এবং কিছুকাল বিহার কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন। এই কাকার সুবাদে বাল্যকাল থেকেই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে রণেশ দাশ গুপ্ত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন।
১৯৩৯ সালে রাঁচির স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে রণেশ দাশ বাঁকুড়ার কলেজে ভর্তি হন। এ সময় অনুশীলন দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। দীর্ঘ অনশনে কারাগারে যতীন দাশের মৃত্যু ‘চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহ’ ইত্যাদি ঘটনায় উত্তাল ত্রিশের দশকে সদ্য যুবক রণেশ দাশ গুপ্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন নিবিড়ভাবে। অচিরেই বাঁকুড়ার কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেন এবং কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। এখানে পুলিশি নজরদারির কারণে পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কিছুকাল পর বরিশাল বি এম কলেজে এসে ভর্তি হন। বরিশালে থাকতেন মাতুল সত্যানন্দ দাশের বাসায়। সদ্য বিবাহিত জীবনানন্দ দাশ তখন স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা দাশকে নিয়ে একই বাড়িতে থাকতেন।
১৯৩৪ সালে বাবা ভারত গিয়ে আহত হয়ে অকাল অবসর গ্রহণ করেন এবং লৌহজংয়ে পদ্মাপারের পৈতৃক ভিটে গাউরদিগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে আসেন। সেনগ্রাম পদ্মগর্ভে বিলীন হওয়ায় তাঁরা ঢাকায় বাড়িভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে রণেশ দাশ গুপ্ত এই সময় পড়াশোনা ছেড়ে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন বিখ্যাত ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায় কর্মজীবনের শুরু। ১৯৩৬ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটি লেখা দিয়ে লেখালেখির জগতে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ঘটে।
এই সময় স্বদেশিয়ানা থেকে বামপন্থী আন্দোলনের দিকে ক্রমশ ঝুঁকতে থাকেন রণেশ দাশ। গোপাল বসাক প্রমুখদের সঙ্গে মিলে তিনি ঢাকায় প্রথম কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে তোলেন। পাশাপাশি বামপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সোমেন চন্দ, অচ্যুৎ গোস্বামী প্রমুখের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন লেখক সংঘ। ১৯৪০ সালে ‘ক্রান্তি’ নামে প্রকাশিত প্রগতি লেখক সংঘের সংকলন আমাদের সাহিত্য আন্দোলনে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। সোমেন চন্দ শহীদ হওয়ার পরপর রণেশ দাশ গুপ্ত ও কিরণ শংকর সেনগুপ্তের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় অসাধারণ সংকলন ‘প্রতিরোধ’। ১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে ঢাকার মিউনিসিপ্যাল কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগের দুঃশাসনে অচিরেই কারাগারে যেতে হল রণেশ দাশ গুপ্তকে। জেলের ভেতরেও অব্যাহত ছিল তাঁর মননের চর্চা। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর পর তাঁর কারারুদ্ধ অবস্থায়ই পরিবারের সদস্যরা অসহায়ভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হন। আত্মীয়–স্বজনহীন পরিমণ্ডলে দেশবাসীকে আত্মার আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করে রয়ে গেলেন রণেশ দাশ গুপ্ত। গোটা পাকিস্তানি আমলে তাঁকে বারংবার কারারুদ্ধ হতে হয়েছে। গণ-আন্দোলনের চাপে কখনো মুক্তি পেলেও প্রতিক্রিয়ার উত্থানে আবার যেতে হয়েছে জেলে। ভাষা আন্দোলনকালে কারাগারে মুনীর চৌধুরীকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন ‘কবর নাটক’ রচনায়। ১৯৫৫ সালে কারামুক্তির পর সংবাদ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন এবং পত্রিকাটিকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র করে তুলতে তাঁর ছিল বিশেষ ভূমিকা। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর অনবদ্য নন্দনতাত্ত্বিক গ্রন্থ ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনের সময় তিনি আবার গ্রেপ্তার হন, ’৬২ সালে মুক্তির পর আবার গ্রেপ্তার হন। ৬৫ সালে মুক্তি পান। কারারুদ্ধ অবস্থায় ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেক অনবদ্য বই ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন’।
ষাটের দশকে সাহিত্যরুচি গঠন ও মননচর্চা গভীরতর করার কাজে তাঁর দুই মৌলিক গ্রন্থের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ। বিশ্ব সাহিত্যের নিরিখে বাংলা সাহিত্য আলোচনায় তাঁর মৌলিকত্ব মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচনায় আলাদা ব্যাপ্তি এনে দিয়েছে। এরপর একে একে প্রকাশ পায় তাঁর গ্রন্থ ‘ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম’ ও ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা’। শেষোক্ত গ্রন্থটি উর্দু থেকে অনুবাদ। কারাবন্দী দিনগুলোতে তিনি শিখেছিলেন উর্দু। কমিউনিস্ট পার্টির নানামুখী কর্মকাণ্ডে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক রচনা ও জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনার গুণে তিনি পরিণত হয়েছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে এবং এই প্রভাব জাতীয় ধারাভুক্ত শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যেও অনুভূত হয়। দেশব্যাপী এই সাংস্কৃতিক জাগরণের সংগ্রামে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যেই উদীচী ও খেলাঘরের সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগ গড়ে ওঠে। সৃজনী সাহিত্য গোষ্ঠীরও তিনি ছিলেন বিশেষ প্রেরণাদাতা।
অজস্র পত্রিকা ও সংকলনে রণেশ দাশ অক্লান্তভাবে লেখা দিয়েছেন। বিশেষত একুশে ভিত্তিক সংকলন প্রকাশে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এমনিভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মানসভূমি নির্মাণের একজন প্রধান রূপকার হয়ে উঠেছিলেন রণেশ দাশ। স্বাধীনতার পর প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধ সংকলনের নাম দিয়েছিলেন ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালো’। তাঁর রচনাগুলো দিয়ে তিনি এই কাজই করে চলেছিলেন। তাঁর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’, ‘আয়াত সৃষ্টিতে আয়াত রূপ’, রহমানের মা ও অন্যান্য’, সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ’, ‘মুক্তিধারা’, ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ প্রভৃতি। শেষোক্ত গ্রন্থটি বর্তমান জটিল সময়ে সাম্যবাদে তাঁর অপার আস্থাকে প্রকাশ করেছে।
১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর একটি সভায় যোগ দিতে রণেশ দাশ কলকাতায় যান। এরপরই প্রতিবিপ্লবী উত্থান ও কঠোর সামরিক শাসনে তাঁর দেশে ফেরা বিঘ্নিত হয়। পরে এক নীরব অভিযোগ শোনা অভিমানে তিনি দেশে ফেরা থেকে বিরত থাকেন। একপর্যায়ে ব্যাপক নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে তাঁর প্রত্যাবর্তন কামনা করা হলে তিনি দেশে ফিরতে সম্মত হয়েছিলেন। এমনি সময় দীর্ঘ রোগভোগে জরাজীর্ণ শরীরে তাঁকে চিরবিদায় নিতে হলো। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতার পিজি হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অকৃতদার নিরাভরণ নিরহংকার ত্যাগী জীবনাচারের এই ব্যতিক্রমী মানুষটির মরদেহ আবার ফিরে আসে তাঁর স্বদেশভূমিতে। তাঁর জীবনকর্মের আদর্শ স্বদেশের মানুষের জন্য অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস হয়ে রইবে।