অসীম ধৈর্যের ফল

আশির দশকের শেষদিক। চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন। আবাস স্থল কলেজ লাগোয়া আবদুল হামিদ ছাত্রাবাস। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার অধিবাসী অত্যন্ত পরহেজগার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার। পড়াতেন সাধারণ ব্যবস্থাপনাসহ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। পরনে থাকতো পুরোপুরি সুন্নতি লেবাস। চট্টগ্রাম তাবলিগ জামাতের শীর্ষ স্থানীয় মুরুব্বি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। সবচেয়ে বড় কথা, ক্লাসে যতক্ষণ শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন, প্রতিদিন ছিলেন অদ্বিতীয়। খুবই যত্ন সহকারে পাঠ নিতেন। এসবের পাশাপাশি কলেজে ও কলেজ হোস্টেলে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে তাবলিগে যোগদানের দাওয়াত দিতেন নিয়মিত এবং নিয়ম করে। নামাজ-রোজা পালনে সবাইকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করতেন। সপ্তাহের একদিন হোস্টেলের দ্বিতীয় তলার পাঞ্জেগানা মসজিদে আসর নামাজে শরিক হতেন।
নামাজের পর মুসল্লি ছাত্রদের নিয়ে আল্লাহ ও রাসুলের আমল-আখলাকের গুরুত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনার পাশাপাশি দ্বীনের পথে বের হয়ে বিপথে যাওয়া মোমিন মুসলমানদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে উৎসাহিত করতে নসিহত করতেন। সুনামগঞ্জের আরও একজন ছিলেন, শওকত নামে আমার একজন সহপাঠী। শহর সংলগ্ন আমবাড়ি গ্রামে ওর বাড়ি। প্রয়াত মেধাবী ছাত্র আজীজের মামা ছিলে শওকত। ভাগনে আজিজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেছিলেন। পরে মাস্টার্স করেছিলেন কিনা আমার মনে পড়ছে না। সহপাঠী শওকত ছিল নিয়মিত নামাজি। আমরা অনিয়মিত নামাজ পড়লেও শওকত ছিলে শতভাগ নিয়মিত। মোয়াজ্জেম হোসেন স্যারের বারংবার অনুরোধ এবং দাওয়াতে ‘হ্যাঁ’বলতে বাধ্য। হালকা বিছানাপত্র ও বাড়তি দুপ্রস্থ পরনের কাপড়
নিয়ে এক বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের আগে উপস্থিত হলাম চট্টগ্রাম শহরের লাভ লেইন মসজিদের তাবলিগ জমায়েতের মারকাজে।
মুরব্বিদের সিদ্ধান্তে ঠিক হলো, মোয়াজ্জেম স্যারের নেতৃত্বে আমরা দ্বীনের দাওয়াত দিতে যাব চট্টগ্রামের অন্যতম শিল্প শহর চন্দ্রঘোনায়। বিকেলে বাসযোগে রওনা দিয়ে মাগরিবের আগেই পৌঁছলাম চন্দ্রঘোনা শহরে। উঠলাম তাবলিগের ভাষায় মারকাজ মানে অস্থায়ী আবাসস্থল বাংলাদেশ পেপার মিলের ইস্পাহানি মসজিদে। সে আমলে মসজিদটি ছিলে খুবই আধুনিক ও সুদৃশ্য। পুরো মসজিদের মেঝে দামি মার্বেল পাথরে মোড়া এবং চারদিকের দেয়াল জুড়ে দামি বিদেশি টাইলস। অজুখানাসহ বাথরুম টয়লেটে বসানো হয়েছে আধুনিক সুবিধাবলি। মাগরিবের নামাজের পর মসজিদ অভ্যন্তরে শুরু হলো কোরআন-হাদিস নিয়ে মূল্যবান আলোচনা আর মসজিদের বাইরে একজন মুরুব্বি একা একা সামলাচ্ছেন রান্নার পর্ব।
পরদিন স্যারের নেতৃত্ব আমরা কয়েকজন গেলাম মিলের ভেতর দ্বীনের দাওয়াত দিতে। সেখানে পরিচয় হলো মিলের বড় কর্মকর্তার সঙ্গে, যার বাড়ি সিলেটে। দাওয়াত পর্ব সেরে আমাদের কয়েকজনের আগ্রহে সিলেটী ম্যানেজার সাহেব অনুমতি দিলেন কারখানাটি ঘুরে দেখার। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে স্যারের সঙ্গে ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ একান্তে কথা বললেন। বিষয়টা সারা জীবন অজানাই রয়ে যেত, যদি না পরদিন স্যারের সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবের বাংলোতে না যেতাম। পরদিন বেলা ১০টার দিকে স্যারের সঙ্গে গেলাম বড় কর্তার বাংলোতে। বসার ঘরে অনেকক্ষণ বসার পর রুমে এসে প্রবেশ করলেন ক্রাচে ভর দেওয়া এক তরুণ। সালাম সম্ভাষণ পর্ব শেষ করে প্রথমে স্যার শুরু করলেন আল্লাহ এবং আল্লাহের কুদরত আর নেয়ামতের ওপর আলোচনা পাশাপাশি কলেমার দাওয়াত। প্রতি উত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো (পরে জানা) মুক্তিযোদ্ধা ভদ্রলোক যিনি ম্যানেজার সাহেবের আপন ছোট ভাই, এমন আপত্তিকর কথাবার্তা শুরু করলেন তা শুনে আমাদের রাগ চরমে। নানা ধরনের অশালীন ভাষায় আল্লাহ এবং তার রাসুল সম্পর্কে চরম আপত্তিজনক অশালীন মন্তব্য অবিরাম চলছেই। অথচ পাহাড় সমান ধৈর্য শক্তির অধিকারী শ্রদ্ধেয় মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার ধীরস্থির আর শান্তির মূর্ত প্রতীক হয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সব ধরনের অভিযোগসহ জীবনের সব হতাশা আর ব্যর্থতার কথা নীরবে শুনেই চলছেন। মাঝে মাঝে থেমে থেমে কোরআন শরিফ থেকে বিভিন্ন আয়াত তিলাওয়াত করছেন, সঙ্গে বাংলায় অনুবাদ—তাও খুব ধীরে ধীরে আকাশচুম্বী সহনশীলতা প্রদর্শনের মাধ্যমে। অথচ স্যারের সঙ্গী হিসেবে আমরা দুবন্ধু রীতিমতো রাগে কাঁপছি। ঘণ্টা তিনেক চলল এক তরফে প্রচুর অশালীন এবং অমার্জনীয় কুৎসিত আচার-আচরণ। অন্যদিকে সহ্য আর ধৈর্যের চরম উদাহরণ। মাঝখানে বসা আমরা দুজন অধৈর্য আর স্বল্প সহ্য নিয়ে বসে থাকা দুজন আদম সন্তান।
মাঝে চলে গেল অনেক দিন আর বছর। কমপক্ষে ১৩/১৪ বছর তো হবেই। ১৯৯৩ সালে আমি তখন সিলেটের স্বল্প সময়ের অধিবাসী। কমার্স কলেজের সহপাঠী বর্তমানে প্রয়াত সিলেট বেসিক ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার পারবান চৌধুরীর মাধ্যমে একটি মন খুশি করা খবর পেলাম। মোয়াজ্জেম স্যার সিলেটের প্রধান তাবলিগ মারকাজ খোঁজার খলা মসজিদে এসেছেন।
প্রতি বৃহস্পতিবার মারকাজে চলে রাতব্যাপী বয়ান আর জামায়াত বন্দীর পুণ্যময় কার্যক্রম। আসরের নামাজের আগেই হাতে সময় নিয়ে আর মনে মনে স্যারকে দেখার নিয়তে গেলাম নদীর অপর পারে খোঁজার খলা মসজিদে। আল্লাহের হুকুমে নিয়ত পুরো হলো। স্যারের সঙ্গে দেখা হলো, সঙ্গে বিরাট এক বিস্ময় নিয়ে।
স্যারকে দেখামাত্রই চিনে ফেললাম। চেহারায় অনেক পরিবর্তন। দাঁড়ির বেশির ভাগ সাদা। চেহারায় প্রৌঢ়ত্বের ছাপ। তবে সেই অনেক কাল আগে দেখা চমৎকার মন ভুলানো হাসিটি এখনো সেই আগের মত। স্যারকে এতকাল পর দেখে এত বেশি উতলা ছিলাম, পাশে যে একজন ভদ্রলোক ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তা খেয়ালেই আসেনি।
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে হাত মেলাতে যাব, ঠিক তখন স্যারের জিজ্ঞাসা, ইশতিয়াক উনাকে চিনেছ? তোমার সঙ্গে ওনার দেখা হয়েছিল অনেক আগে চট্টগ্রামের পাহাড় আর লেকবেষ্টিত এক শিল্প নগরে। ঘণ্টা দু-এক তুমি ওনার পাশে বসেও ছিলে।
পুরোপুরি সুন্নতি লেবাস পরিহিত পুরো মুখভর্তি দাঁড়ি আর তসবি হাতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে এক নিমেষে চলে গেলাম চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের বড় কর্তার বাংলোর বসার ঘরে। যার মুখে ছিলে আল্লাহ আর রাসুলকে নিয়ে নানা কটূক্তি। অথচ সেই তিনি আজ আল্লাহের রাস্তায়, দ্বীনের দাওয়াতে, কলেমার দাওয়াতে।
তা এই বিস্ময় পরিবর্তনের রহস্য কি? স্যারকে জিজ্ঞেস করে জবাব পেয়ে গেলাম এক কথায়। স্যার আমার প্রশ্ন শুনে উত্তরে বললেন, ইশতিয়াক অসীম ধৈর্য আর সবুর, ক্ষণিকের দুনিয়ার অনেক মতপার্থক্য কম সময়ে বদলে দিতে পারে। প্রশ্ন হলো, আলোচ্য বিষয়ে তোমার আন্তরিকতার পরিমাণ কী পরিমাণ এবং সব ভালো মন্দ শোনার ধৈর্য তোমার আছে কিনা। বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় স্যারের শেষ কথাটি ছিলে, আল্লাহের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন মঞ্জিলের মূল্যবান এই আয়াতখানা জীবনে স্মরণ ও চর্চা করার চেষ্টা করিও।
যারা বিশ্বাস করেছ, শোনো: ধৈর্য-নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করো এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের সঙ্গে আছেন—(আল কোরআন)