আমার মা রেনু

এক.
রেনু কিছুতেই বুঝতে পারে না, চারপাশে এত হট্টগোল কেন! কেমন যেন জনশূন্য লাগছে। এত মানুষ তাকে ঘিরে, এত হইচই! কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত তার গায়ে অনেক ব্যথা লাগছিল। অসহ্য যন্ত্রণা। মাথা শরীর থেঁতলে গেছে এটাও নিশ্চিত। কিন্তু কেউ এখনো থামছে না। মেরেই যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ কেন তাকে ধরে এভাবে মারছে, তার অপরাধ কী, কী সুখ পাচ্ছে তারা, কিছুতেই বুঝতে পারছিল না রেনু। অবশ্য এখন বুঝতেও চাইছে না। তার শরীরে এখন এতটুকু ব্যথা লাগছে না। এখন শূন্যতায় বসবাস রেনুর। কত মানুষ, তাকে ঘিরে। কেউ লাথি মারছে, কেউ কিল ঘুষি, কেউ জোগাড় করে এনেছে মোটাসোটা লাঠি! লোহার, কাঠের শক্তপোক্ত কিছু একটা। একজন মানুষকে গুঁড়িয়ে দিতে যার যেমন চাই। এসব কিছু কি সব সময় তৈরিই থাকে! হাতের কাছে!
এখন অবশ্য এত কিছু ভাবতে চায় না রেনু। সময় বড় কম। চোখের সামনে এখন কেবল ভাসছে তুবার মুখ। ওই তো মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়ে। প্রাণপণ চিৎকার করছে। বলছে, ‘তোমরা আমার মাকে এভাবে মারছ কেন? কি করেছে আমার মা? আমাকে স্কুলে ভর্তি করাবে, তার জন্য খোঁজ নিতে যাওয়াই কি অপরাধ?’ হাজারো ক্রুদ্ধ মানুষের ভিড় ঠেলে তুবা কিছুতেই মায়ের সামনে যেতে পারছে না। রেনু মানুষের ভিড় ঠেলে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ দিয়ে দু-একফোটা পানিও বোধ হয় গড়িয়ে পড়ল। নোনা রক্তের সঙ্গে মিশে গেল, নোনা চোখের জল। কেউ কিছু পেল না। ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাসও হয়তো ফেলল রেনু। ‘তুবা...মা..আমি তোমার জন্য ড্রেস নিয়ে চলে আসব। খুব শিগগিরই আসব। তুমি কেঁদো না মা। আমার একদম ব্যথা লাগছে না। তবে যেটা লাগছে, তার নাম ঘৃণা। মানুষরূপী একদল পাষণ্ডের প্রতি তীব্র ঘৃণা।’

দুই.
‘রেনুর কথা তোমাদের কারও মনে আছে? রেনু আমার মা।’
সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। মনে হয় বুঝতে পারছে না, এই শিশু কী বলছে! অসংখ্য মানুষ বসে আছে সামনে। সংখ্যায় কত হবে! কোটি, তার চেয়েও অনেক বেশি। কোটি কোটি। একটা উঁচু মঞ্চের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা শিশু। বয়স চার বছর, নাম তুবা। ঠিকমতো কথাই বলতে জানে না যে শিশু, আজ তার কণ্ঠ এই পৃথিবীর কঠিনতম। কয়েক দিন আগেও কেবল মায়ের আদর খুঁজত যে শিশু, আজ গোটা পৃথিবীর কাছে তার কঠিন প্রশ্ন।
‘আপনারা ভুলে গেছেন, তাই তো? মাত্র কয়েক মাসেই ভুলে বসে আছেন। অবশ্য চারপাশে কত ঘটনা। রেনুর কথা মনে রাখার সময় কোথায় আপনাদের! একটি যায়, সামনে এসে দাঁড়ায় আরেকটি ঘটনা। খুব মুখরোচক, খুব আলোচনা হয়! আপনাদের ফেসবুকে দেওয়ার মতো এক একটা ছবি হয়, ভিডিও হয়। দেশোদ্ধার করেন আপনারা। আবার ভুলে যান।’
সামনে বসে থাকা মানুষগুলো নিশ্চুপ। কারও মুখে কোনো কথা নেই। অসংখ্য মানুষ মাথা নিচু করে বসে আছে। তুবার দিকে তাকাতেও যেন তারা লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু মানুষদের আসলেই কি লজ্জা আছে? ভেবে পায় না শিশুটা।
‘যারা ভুলে গেছেন, তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আমার মা রেনু। দুই বছর আগে আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। এরপর থেকে আমি আর আমার ভাইকে নিয়ে চলছিল মায়ের সংসার। অনেক কষ্ট, অনেক টানাপোড়েন। মাকে প্রায়ই দেখতাম খুবই অস্থির থাকত। এরপরও আমাদের প্রতি তার ভালোবাসায় এতটুকু কমতি ছিল না। মা না খেয়ে আমাদের খাওয়াত। মায়েরা তো এমনি হয়। আপনাদেরও মা ছিল, মা আছে, তাই না? আপনাদের মায়েরাও তো ঠিক এমনিভাবে আপনাদের ভালোবাসে। বাসে তো?’
তুবার চারপাশ থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। দেব শিশু যেন।
এবারও কারও মুখে কোনো কথা নেই। সুনসান নীরবতা। যেন কারও কাছে কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। সম্ভব হলে তারা কানে আঙুল দিয়ে রাখত, কিংবা এখান থেকে পালিয়ে যেতো। এত কঠিন কঠিন কথা তারা শুনতে চায় না। তার চেয়ে গান-বাজনা কিংবা একটু নাচ হলে মন্দ হতো না; ভাবখানা যেন এমনই।
‘আমাদের বাঁচাতে একটা বেসরকারি অফিসে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ নেন মা। আমরা থাকতাম মহাখালী ওয়্যারলেস গেট এলাকায়। ছোট্ট একটা ভাড়া বাড়ি। আগামী বছরের জানুয়ারিতে আমার বড় মামা আলী আজগরের কাছে আমেরিকায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে মা ভাবলেন, মেয়েটা বড় হচ্ছে, তাকে স্কুলে ভর্তি করানো দরকার। গেলেন খোঁজ নিতে। উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে একদল ‘বাহাদুর’ এগিয়ে এলেন। বললেন, আমার মা রেনু একটা ছেলেধরা। তারপর কী হলো, বলুন তো?
এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর কেউ দিল না। সবাই খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কীসব বলছে এই বাচ্চা মেয়েটা। বিবেকের কাছে শিশুর প্রশ্ন। মানুষগুলো বিরক্ত। কেউ কেউ অবশ্য ‘আহা’ ‘উঁহু’ করছে। তাদের বিবেকের বন্ধ দরজাটা বোধ হয় একটু খোলা। কিন্তু লাভ কি তাতে? রেনু কি ফিরবে তুবার কাছে?
তুবা বলতে থাকে, ‘আমি মামাদের কাছ থেকে শুনেছি, ছোট বেলা থেকেই নাকি আমার মা একটু নার্ভাস ধরনের ছিল। তবে লেখাপড়ায় ছিল খুবই ভালো। আমার নানা মাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। কিংবা বিসিএস অফিসার। গাড়ি দিয়ে চলাফেরা করবে। নিজের একটা বাড়ি থাকবে। থাকবে সুখ। কিন্তু মায়ের জীবন সুখের হয়নি।’
একটু থামে সে। তুবার চোখে আজ কোনো পানি নেই। কেবল অসংখ্য জিজ্ঞাসা। সেই সঙ্গে প্রবল ঘৃণা।
চার বছরের তুবা বলতে থাকে, ‘সেদিন মা বাসার কাছের প্রাইমারি স্কুলটায় গিলেছিল আমাকে ভর্তি করাবে বলে। কিন্তু হঠাৎ কিছু বখাটে লোক অহেতুক প্রশ্ন করতে করতে আমার মাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। আজব-আজব সেই সব প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় মা। কিছুটা এলোমেলো, চেনা উত্তরও হারিয়ে ফেলে সে। অন্তর্মুখী মায়ের অন্তরাত্মাটা মুহূর্তেই শুকিয়ে যায় তখন। মা আমার পরিষ্কার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। অযাচিত প্রশ্নে ঘাবড়ে যায়। সেখানে উপস্থিত লোকগুলো কত ক্রুদ্ধ। যেন তারাই পুলিশ, তারাই সাক্ষী আর তারাই বিচারক। এখানে কারও কোনো কথা শোনার কিছু নেই, বুঝবার কিছু নেই, বোঝাবার নেই!’
তুবার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে ওঠে। তার রাগ হয়। কষ্ট হয়। হারানোর যন্ত্রণা হয়। আবার বলতে শুরু করে, ‘আপনাদের মনে আছে, কীভাবে উন্মত্ত জনতা পেটাতে শুরু করল আমার মাকে! তখন আমার মায়ের কী মনে হয়েছিল, কেবল সেটাই জানতে ইচ্ছে করে। মা নিশ্চয়ই আমার কথা, আমার বড় ভাইটার কথাই ভাবছিল? নিজের জীবনের কথা না। মা কেবল চাইতো আমরা ভালো থাকি। ধরুন কেউ যদি এসে বলত, ‘শোনো রেনু, তুমি দশ তলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়বে, তাতে করে তোমার ছেলে-মেয়ে দুটোর সারা জীবন উজ্জ্বল হবে, এই নিশ্চয়তা দিলাম।’—এমন নিশ্চয়তা পেলে চোখ বন্ধ করে লাফিয়ে পড়তে দ্বিধা করত না মা। আমাদের দুজনের সুখ ছাড়া আর কিছুই যে চাওয়ার ছিল না তার।’
সেদিন প্রখর খরতাপ ছিল। দিনটা ছিল গুমোট। মানুষের ভেতর থেকে মমতা হারিয়ে গিয়েছিল।
তুবা বলতে থাকে, ‘আপনারা দেখেছেন তো, কীভাবেই না আমার মাকে পেটানো হয়েছিল। কি নৃশংসতা! মায়ের সারা শরীর থেঁতলে দিয়েছিল ওরা। নিশ্বাসটা বের হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেও মা তাকিয়েছিল ওদের দিকে। যদি একটু দয়া হয়। আপনারা বুঝতে পারছেন, আমি বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলছি না, একটু ‘দয়া’র কথা বলছি! অমানুষের কাছ থেকে একটু ‘দয়া’ ভিক্ষার কথা বলছি। আমার মা নিশ্চয়ই তেমন কিছু ভেবেছিল। ভেবেছিল, হয়তো ছেড়ে দেবে। রক্তমাখা মুখ, কপালে রক্ত আর ঘামে ভেজা চুলগুলো কেমন লেপ্টে ছিল, দেখেছেন আপনারা? হয়তো শেষ মুহূর্তেও মা তাদের বোঝাতে চেয়েছেন। চিৎকার করে বলেছেন, ‘ভাইগো ও ভাই, আমি এখানে এসেছিলাম আমার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে।’ কিন্তু সেই চিৎকার কারও কানে গিয়ে পৌঁছায়নি।
তুবা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘মা নিশ্চয়ই বলেছিলেন, “আমি ছেলে ধরা না। আমার নাম রেনু। আমার দুটো ফুটফুটে বাচ্চা আছে। আমি মরে গেলে ওদেরকে দেখার কেউ থাকবে না। এখনো সময় আছে। আপনারা আমাকে যদি হাসপাতালে নিয়ে যান, আমি মরব না। আমি সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাই। বাসায় বাচ্চাগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে”। নাকি মা কিছুই বলতে পারেনি। বোবার মতো পাষণ্ডগুলোর দিকে কেবল তাকিয়ে ছিল। নাকি মা কিছুই ভাবতে পারেনি!’
ঘোরলাগা চোখে তুবার মা রেনু সেদিন লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। কতজন পাস থেকে ভিডিও ধারণ করে দায়িত্ব পালন করেছে। তুবা জানতে চায়, “আপনাদের মধ্যেও কি তেমন কেউ আছেন নাকি যারা ভিডিও করেছিলেন, ছবি তুলেছিলেন? কত ‘মজার’ একটা দৃশ্য সেদিন পেয়ে গিয়েছিলেন আপনারা। ভালো কাটতি হয়েছিল নিশ্চয়ই? আপনাদের ফেসবুকে সেই ছবিতে নিশ্চয়ই অনেক লাইক পড়েছে, শেয়ার হয়েছে। দুঃসাহসী কাজ করেছেন আপনারা। আপনাদের ধন্যবাদ। তা ছাড়া আপনারা তো মারেননি আমার মাকে। বাঁচাতেও যাননি। একবার বলেনওনি, এভাবে মেরো না। যদি সত্যিই এই নারী ছেলেধরা হয়, সেটা দেখার জন্য পুলিশ আছে। দেশে আদালত আছে। চলো আমরা তাকে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিই’। বলেছেন কেউ?”
কারও মুখে কোনো কথা নেই। বদলে যাওয়া সমাজের বেশির ভাগ মানুষ এতটাই স্মার্ট যে, তারা কেবল চুপ থাকতে পারে। কখনো কখনো প্রতিবাদের পালে হাওয়া লাগলেও, অন্য একটি ঝড়ে তার গতি পাল্টে যায়। এই তো জীবন। চার বছরের তুবা ঠিকমতো পৃথিবীকে জানে না। পৃথিবীর হৃদয়হীনতা বোঝে না। কেবল সে জানে, মা নেই। যদি প্রশ্ন করার ক্ষমতা তার থাকত কিংবা হয় কখনো, তাহলে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর কি আছে এই সমাজের কাছে? নাকি দিনে দিনে সবাই বোবা হয়ে বেঁচে থাকতেই কেবল শিখবে? প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই।

(ছেলেধরা সন্দেহে একদল ‘অমানুষ’–এর হাতে নৃশংসভাবে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর ভাই রিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক পোস্টের ছায়া অবলম্বনে লেখা।)