মানুষের জন্মগত অধিকার

কয়েক দিন আগে আমার আমার জন্মদিন চলে গেল। ছোট বা বড়বেলা কখনো তেমন ঘটা করে জন্মদিন পালন করার সুযোগ হয়নি। একান্নবর্তী পরিবার, সাত ভাই-বোনের সংসার। আব্বা ছিলেন ব্যাংকার। অভাব না থাকলেও প্রাচুর্য ছিল না। ষাটের দশকে জন্ম আমার। সেকালে কেক কেটে মোমবাতি জ্বালিয়ে কয়জন বাঙালিই বা জন্মদিন পালন করত? ধনী পরিবারের খবর জানি না। তবে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে নৈব নৈবচ! তবে এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে ঘরে উন্নতমানের খাবার পরিবেশনের নিয়ম ছিল। শাহী খাবার না হলেও পোলাও, মুরগির কোর্মা, ডিম ভুনা, ঝাল গরুর মাংস আর শেষ পাতে ঘন দুধের পায়েস। এসব ছিল খুব প্রচলিত ফিস্ট।
ছোটবেলায় আমাদের সব ভাই–বোনেরই মুরগির কোর্মা আর ডিম ভুনা খুব প্রিয় ছিল। সত্তরের দশকে আমাদের একমাত্র ছোট ভাইটির জন্ম হয়। তার চার বা পাঁচ বছর বয়স হলে আমরা বড় ছয়টি ‘পারুল বোন’ মিলে একমাত্র ‘চম্পা ভাই’–এর জন্মদিন ঘটা করে পালন শুরু করি। তত দিনে আমাদের সংসারও ছোট হয়ে এসেছে। চাচা, ফুফুরা তাদের নিজস্ব সংসার শুরু করেছে। দাদা-দাদিরা ভ্রাম্যমাণ অতিথির মতো মাঝেমধ্যে এদিক–সেদিক যান। মন চাইলে পুরোনো ঢাকা বা বিক্রমপুরের বাড়িতে গিয়ে থাকেন। আব্বারও চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। মফস্বলের ছোট্ট শহরে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে আমরাও অভিজাত ও গণ্যমান্য বলে পরিচিত হয়ে উঠেছি। সুতরাং ধনী পরিবারের ছোঁয়া ও বাতাস তখন আমাদের পরিবারেও একটু-আধটু বইতে শুরু করেছে।
এখন অবশ্য ফেসবুকের কল্যাণে মহাধুমধামেই জন্মদিন পালন করছি। তারিখ আসতে না আসতেই জন্মদিনের শুভকামনার টাইমলাইনে পুষ্পবৃষ্টি হতে শুরু করে। এতে আনন্দ যে হচ্ছে না, তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না। খুবই আনন্দ হচ্ছে। আমার মতো আমজনতাকে একটি বিশেষ দিনে এত এত মানুষ মনে করছে, বিষয়টি হৃদয়কে অবশ্যই আন্দোলিত করে। মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর মনোযোগ পাওয়া মানবজীবনের একটি বিরাট প্রত্যাশা। কাছের বা দূরের মানুষ সে যেই হোক, ভালোবাসলে, দুটি সুন্দর কথা বললে কার না ভালো লাগে? ভার্চুয়াল জগতের বন্ধু থেকে শুরু করে চেনা–জানা ঘরের লোকজনও এখন ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানায়। আমি নিজেও অন্যদের যেকোনো বিশেষ উপলক্ষে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন, সহানুভূতি জানাতে কার্পণ্য করি না। আমার মনে হয়, এই জিনিসগুলোর অনেক পজিটিভ ইমপ্যাক্ট আছে। আমরা মানুষের জন্য আর কিছু করতে না পারলেও দুটি ভালো কথা, ভালোবাসার কথা বলে তার মন অবশ্যই ভালো করে দিতে পারি।
সেই সত্তরের দশক থেকে পারিবারিকভাবে পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের জন্মদিন পালন শুরু হয়েছিল কেক কেটে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে। কিন্তু পরিবারের যে কর্তাটি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করছেন, সবার প্রয়োজন আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে খোঁজ রাখছেন, সেই মানুষটির জন্য একটি পার্টি করে হয়তো তাকে চমকে দেওয়া যেত। খানিকটা আনন্দ দেওয়া যেত। যেটা এই যুগে আমাদের সন্তানেরা করছে। আজ বড় আফসোস হয়। সেই শিক্ষা, ধ্যানধারণা বা কালচারটা আমাদের তখন ছিল না। সামান্য আয়োজনও যে জীবনে অসামান্য আনন্দ আনতে পারে, সেটা শিখতেও কেটে গেল বহু বছর। আব্বা চলে গেলেন একদমই আচমকা। তাঁর জন্য কখনো কিছুই করা হয়নি। সুযোগও মিলল না!
আজকের জন্মদিনটি উদ্‌যাপন করতে গিয়ে মনে পড়ল শেষ কবে জন্মদিনের সমসংখ্যক মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন করেছিলাম? মনে নেই এবং মনে নেই, এটি আমার আসল জন্মদিন কিনা। আব্বার একটি ডায়েরিতে আমাদের ভাই–বোনদের জন্মের সব খতিয়ান লেখা ছিল। সেখানে দিন, তারিখ মাস, জন্মক্ষণও লেখা ছিল। এমনকি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা এবং আরবি মাসও সেখানে উল্লেখ ছিল। আব্বার মৃত্যুর পর নানা জায়গা বদল আর হাতবদলের কারণে ডায়েরিটি হারিয়ে গেল। জন্ম তারিখ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের নাক গলানোর কারণেও বিষয়টি এখন বেশ গোলমেলে হয়ে গেছে। আমার জানামতে, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যে সব বাংলাদেশির জন্ম বাংলাদেশে হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই জন্মদিনটি মনগড়া। সম্ভাব্য এসএসসি পাশের জন্য মানান সই একটা বয়স হিসাব করে ফরম ভরাট করাই ছিল আমাদের বাঙালি দস্তুর। মার্কিন মুল্লুকে এসে দেখলাম, এরা হাসপাতাল থেকেই বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু করে জন্মদিনের খতিয়ান লিপিবদ্ধ করে রাখে। সুতরাং জন্ম তারিখ নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘঁষামাজা করার আর কোনো সুযোগ এখানে নেই। সুতরাং এদের জন্মদিন একটিই। আমাদের মতো দুটি নয়। আমাদের একটি আসল, অন্যটি সার্টিফিকেটের।
নামের বেলায়ও সেই একই গোলমাল। একটি আসল নাম, আরেকটি ডাকনাম। এই নিয়ে গোলকধাঁধার শেষ নেই। সমস্যা হলো পশ্চিমের জাগরণ পূর্বে পৌঁছাতে পৌঁছাতে, আমরা তা আয়ত্ত করতে করতে প্রায় এক শ বছর পার হয়ে যায়। অপসংস্কৃতি যত দ্রুত মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে, জরুরি প্রয়োজনগুলো জানতে বা শিখতে আমাদের ততই দেরি হয়ে যায়। তবে আশার কথা হলো, শুনছি দেশেও এখন রীতিনীতি পাল্টাতে শুরু করেছে। জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র করার নিয়ম কড়াকড়িভাবেই চালু হয়েছে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন ন্যাশনাল আইডি ছাড়া করা সম্ভব হচ্ছে না। পশ্চিমের হাওয়া অনেক দেরিতে হলেও পুবে বইতে শুরু করেছে।
সেই চল্লিশ পেরোনোর পর মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন করতে আর ইচ্ছেও করেনি। এটা কী শুধুই বয়স লুকানোর জন্য? ঠিক তাও নয়। আসলে মোমবাতির সংখ্যা তো বাড়ছেই। এমন হলো, শেষতক মোমবাতির জটলা লেগে গেল। চল্লিশের পরে আর বয়স গোনাগুনি করে লাভইবা কী? বয়স বাড়ুক বয়সের নিয়মে। আমি অন্তত আমার মনের তারুণ্য একটুও কমতে দিতে চাই না। বয়সে প্রবীণ হলেও মননে নবীনই থাকতে চাই। আজ দুপুরেই শতদলের স্রষ্টা কবীর কিরণ ভাই ফোন করলেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। তখন তার সঙ্গেই কথা হচ্ছিল, বয়স নিয়ে। বললাম, বয়স হিসাব কষার সময় কোথায়? ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। চল্লিশের পরে বয়স গুনতে বসলে বুকে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগে। ধাক্কাটা শুরু হয়েছিল বেশ আগেই। জীবন এত ছোট, এত সংক্ষিপ্ত। ডাক এলেই চলে যেতে হবে। এই ভাবনাগুলো মাথায় ঢুকতে চাইল। আমি মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেললাম। সেই থেকে বয়স গোনা মুলতবি করেছি।
আসল কথায় না গিয়ে তো কোনো উপায় নেই। কোথায় লুকাব? পালাবার কোনো পথ নেই। এই পৃথিবীতে যখন এসেছিলাম, কোনো চিন্তা, ভাবনা, প্রস্তুতি না নিয়েই এসেছিলাম। বেশ তো একটা মায়া–মমতা ভরা, সুখ দুঃখের পাঁচমিশালি জীবন পেয়ে গেলাম। মর্ত্যলোকের এই জীবনের জন্য মায়ের পেটের অন্ধকার গুহায় বসে কোনো তপস্যা বা ধ্যান করতে হয়েছিল কিনা, মনেও নেই। যদি তাই হয়, মাতৃগর্ভের সেই নিষ্পাপ সময়গুলো সবাই তো একই নিয়মে, একই মন্ত্র জপ করেই বেড়ে উঠেছিলাম। কিন্তু কী ফল হলো? কেউ হিন্দুর ঘরে জন্মেছে বলে হিন্দু হয়ে গেল। কেউ বাপদাদা মুসলিম বলে মুসলিম হয়ে জন্মাল। বাপ–ধনী বলে আরাম–আয়াসে বড় হতে লাগল কেউ কেউ। গরিবের ঘরে জন্মাবার কুফল সারা জীবনভর বইতে হচ্ছে কোনো কোনো হতচ্ছাড়াকে। এখানে দোষ বা গুণ কার? কার কর্মফল? দৈবাৎ কিছু কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ হয়তো তাদের বিধির লিখন খণ্ডাতে পেরেছে। তাঁরা অতি অবশ্যই নমস্য। কিন্তু রাম, শাম, যদু, মধু এদের কী দোষ? জানলাম জন্মের সুফল বা কুফল বয়ে বেড়ানোই আমাদের নিয়তি। এই নিয়তিকে খণ্ডানোর জন্যই আমাদের ঈশ্বরের সাধনা করতে হবে।
একজন সর্বশক্তিমান, অতি জ্ঞানী, অতি দয়ালু স্রষ্টা বা ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট মানুষকে খুব ভালোবাসেন, শুধু বিনিময়ে চান আমাদের ভালোবাসা, প্রার্থনা ও বাধ্যবাধকতা। স্রষ্টার সামনে তাই মাথা নিচু করে হাঁটু গেড়ে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করাই যুক্তিসংগত।
লিখতে লিখতেই একটি খবর জানতে পারলাম। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ ১৩ নভেম্বর দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এই দিনটি জনপ্রিয় এই লেখকের জন্মদিন। গুলতেনিক শুভ একটি দিনকেই তাঁর শুভ পরিণয়ের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আশা করি, দেশবাসী এবং হুমায়ূন ভক্তরা এটাকে ইতিবাচক চোখেই দেখবেন। ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে প্রতিটি মানুষেরই সুখী হওয়ার অধিকার আছে। হ‌ুমায়ুন আহমেদও সুখী হওয়ার জন্যই দ্বিতীয় বিয়েটি করেছিলেন। জন্ম ও মৃত্যু মানুষ নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবে নিয়তির হাতে ছেড়ে না দিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা অবশ্যই মানুষ করতে পারে। এটা মানুষের জন্মগত অধিকার!