অশ্রুসিক্ত ভুট্টোর ওয়াক আউট

(পর্ব ৩৪)
ঢাকা যখন প্রায় শত্রুমুক্ত তখন জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুদ্ধ থামানোর পাকিস্তানি প্রচেষ্টায় জুলফিকার আলী ভুট্টো সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি বিফল মনোরথ হয়ে জাতিসংঘকে ভর্ৎসনা করে ক্রন্দনরত অবস্থায় অধিবেশন ত্যাগ করেন। সংবাদটি নিউইয়র্ক টাইমস বিস্তারিত প্রকাশ করে। জাতিসংঘ নিউইয়র্ক থেকে নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা হেনরি টেনারের সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘ভর্ৎসনা করে ক্রন্দনরত ভুট্টোর পরিষদ ত্যাগ’ [Bhutto denounces council and walks out in tears]

সংবাদটি সংক্ষেপে এরকম—
আজ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘকে ‘আগ্রাসনের বৈধতা দানকারী’ অভিযুক্ত করে চেহারায় অশ্রুর রেখা নিয়ে অধিবেশন ত্যাগ করেন।
চেম্বারের বাইরে তিনি বলেন, ‘আমি পরিষদকে ঘৃণা করি। আমরা আর এদের মুখ দেখতে চাই না। তার চেয়ে আমি ধ্বংসপ্রাপ্ত পাকিস্তানে ফিরে যাব।’ তিনি কক্ষ ত্যাগ করলে গোমড়া মুখে তার প্রতিনিধি দলের সাত সদস্যও তাঁকে অনুসরণ করেন, যাদের মধ্যে পাকিস্তানের নিয়মিত প্রতিনিধি আগা শাহীও ছিলেন।
পরিষদের কক্ষ ত্যাগ করার আগে ভুট্টো তার চেয়ারটাকে পেছনে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ান তার নথি ছিঁড়ে ফেলেন এবং বলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমি ইঁদুর নই। আমার জীবনে কোন নিচু কাজ আমি করিনি। আমি হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হয়েছি। আমি জেল খেটেছি। আজ আমি কোন নিচু কাজ করছি না, তবে নিরাপত্তা পরিষদের সভা ত্যাগ করছি।’
আমি মনে করি, আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা আমাদের জন্য এবং আমার দেশের জন্য মর্যাদা হানিকর...আমাদের ওপর আগ্রাসন বৈধকরণ হচ্ছে, বৈধকরণ হচ্ছে ভোগ দখল। এমন একটি চুক্তি করা হচ্ছে যা ‘ভারসেলিস’ (Versailles)-এর চেয়েও খারাপ। আমি এর অংশীদার হতে পারি না, আমরা লড়ব। আমার দেশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে আমার সময় ক্ষেপণ করব? আমি আমার দেশের জন্য লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের অংশ হতে পারি না। আপনারা নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ে থাকুন, আমি চললাম।’
মি. ভুট্টো অন্যান্য কূটনীতিককে অবাক করে কার্পেট বিছানো মূল কক্ষ ত্যাগ করে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে গাড়িতে চলে যান। তার এমন আচরণের কারণ জানা যায়নি, কিন্তু সেটি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে ভোট গ্রহণে রাশিয়ার ‘বিলম্বকরণ কৌশল’ এবং ‘ফিলিবাস্টারিং’ [Filibustering] (প্রতিনিধি কর্তৃক বক্তৃতা দিয়ে সময়ক্ষেপণ) বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে ভারতের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন রয়েছে।

বিতর্ক অব্যাহত
ভুট্টোর চলে যাওয়ার দিকে পরিষদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল। এরপর যথারীতি নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল বি টেইলর কামারা তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি রিচার্ড ডাইসকে ফ্লোর দিলেন। সভা চলতে থাকল, যেমনিভাবে গত দুই দিন চলেছে।
চলে যাওয়ার পথে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বললেন, পাকিস্তান জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে না। তিনি বললেন, ‘অ্যাম্বাসেডর শাহ্‌ আলী থাকবেন’। পরিষদ দুবার মিলিত হয়েছে, পরিষদ সন্ধ্যায় দুইবার মিলিত হলো। প্রথম সান্ধ্য পর্বে চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরাই ছিলেন মূল বক্তা, একে অপরের নীতি নিয়ে তিক্ত বাক্য বিনিময় করেন। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় রাত ১১টার কিছু পরে। সেখানে আভাস পাওয়া গেল, আগামীকাল বৃহৎ শক্তিগুলো অচলাবস্থা ভাঙতে পারে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের প্রতিনিধি স্যার কলিন ক্রো ও জ্যাক কসিসকো-মরিয়েট একটি যৌথ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন যার মূল হলো যুদ্ধবিরতি। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি ইয়াকভ এ মেলিক যুদ্ধবিরতিসহ আলোচনার আরেকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পশ্চিমা কূটনীতিকদের কাছ থকে গুঞ্জন শোনা গেল, ঢাকার পতন আসন্ন। অনেক কূটনীতিক মনে করেন, ভারতকে সমর্থনকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন ঢাকা পতনের পর পরিষদকে কাজ করতে দেবে।
নিরাপত্তা পরিষদ ত্যাগের পর সাংবাদিকদের জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘আমি মনে করেছি, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে আসা আমার জন্য অপরিহার্য ছিল। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, নিরাপত্তা পরিষদ আমার দেশকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। আমি শঙ্কিত, নিরাপত্তা পরিষদ ‘ফিলিবাস্টারিং’-এর কলায় সময় ক্ষেপণের দক্ষতা অর্জন করেছে। আমি দেখলাম, অধিবেশন পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা নাকি ১১টায় বসবে—এই বিতর্কে গতকাল পুরো একটি ঘণ্টা নষ্ট হলো।
সোমালিয়ার রাষ্ট্রদূত পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৬০ লাখ বলে উল্লেখ করেছিল, পরবর্তীতে সংশোধন করে বলেছে ৭ কোটি ৬০ লাখ।
ভুট্টো বলেন, “আমার মনে হয়, আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে তার আর সংশোধন করার দরকার পড়ত না, কারণ লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। ‘ভেটো’ দেখে আমরা হতাশ। কিন্তু মনে রাখতে হবে বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ আজ আমরা গিনিপিগ, ভবিষ্যতে আর কেউ হবে না।”
ভুট্টো তার হোটেলে সাংবাদিকের বলেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে একটি শর্তে আলোচনার পক্ষে যেখানে ‘পাকিস্তান’ একটি সত্তা হিসাবে থকবে। পূর্ব ও পশ্চিমের সম্পর্ক হবে খুব শিথিল। ঢাকার পতন হলে কীভাবে সেটা সম্ভব হবে, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, স্বাধীনতাকামীদের নেতারা এটাতে উৎসাহ দেখাবেন, তারা দরজা বন্ধ করবেন না। তারা ভারতের সঙ্গেও আলোচনা করতে চান।’
ভুট্টো বলেন, ফ্রান্স-ব্রিটেন যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে, সেখানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অথচ তারাই বাঙালি জাতি হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। ভুট্টো আরও বলেন, রাশিয়া পাকিস্তানের ওপর ধারণাতীত চাপ প্রয়োগ করেছে। তিনি আশঙ্কা করেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখলের পর পশ্চিমে কাশ্মীরের দিকে যাবে। তার পুরো সাক্ষাৎকারেই তিনি পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে বর্তমান ঘটনা মোকাবিলায় অসমর্থ বলে বর্ণনা করে পাকিস্তানে জনসরকার অবশ্যম্ভাবী বলে মন্তব্য করেন।
সাক্ষাৎকারকালে ভুট্টো তাঁর অষ্টাদশী তনয়ার কাছ থেকে ফোন পান যিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সরকার’ নিয়ে অধ্যয়ন করছেন। কথোপকথনের এক অংশে তিনি তাঁকে বলেন, ‘আমি বর্জন করেছি, কারণ এটি ছিল একটি প্রহসন, কিছু সত্যি আমার বলা দরকার ছিল। না আমি মেজাজ হারাইনি।’ (চলবে)

লেখক: গল্পকার, কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]