শুধু দিয়েই গেছেন রফি আহমেদ

রফি আহমেদ কিদওয়াই, হিন্দিতে সম্ভবত রেফি আহমেদ কাদ্ওয়াই ও উর্দুতে রাফিয়েদ আবদুল কাদওয়াতী। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎদের অন্যতম ও সত্যিকারের একজন নিরলসকর্মী ছিলেন। রাজনীতিক মতাদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন যাকে বলা যায় সমাজতন্ত্রী। অনেকে তাঁকে মাঝে মাঝে ইসলামি সমাজতন্ত্রবাদী বলেও অভিহিত করত। তাঁর জন্মস্থান ভারতের অধুনা উত্তর প্রদেশের বারাবানকী জেলার মাসৌলি গ্রামে। ১৮৯৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম, আর মৃত্যু ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর।
বংশ পরিচয় ও প্রাথমিক জীবন
রফি আহমেদ ছিলেন ইমতিয়াজ আলী কিদওয়াইয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর মায়ের নাম রশিদ উন-নিসা। সাংসারিক দিক থেকে ইমতিয়াজ আলী ছিলেন মোটামুটি একজন সমৃদ্ধ জমিদার। এ ছাড়া তিনি সরকারি চাকরিতেও যোগ দিয়েছিলেন। তাই জমিদারি ও চাকরি মিলিয়ে সমাজে তিনি বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিলেন।
রফি আহমেদের চাচা উইলিয়াত আলী ছিলেন একাধারে একজন রাজনীতিবিদ ও সক্রিয় আইনজীবী। রফি আহমেদের শিক্ষার হাতে খড়ি নিজেদের বাড়িতে, একজন গৃহশিক্ষকের কাছে। গ্রামের স্কুল থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি বারাবানকির সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি আলিগড়ের মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে (এমএও) ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯১৮ সালে বিএ পাস করেন। সেখানে তিনি এলএলবি ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনাও শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। কারণ ১৯২০-২১ সালে একদিকে তিনি মহাত্মা গান্ধীর প্রথম সর্বভারতীয় অসহযোগ আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হন। আবার একই সময়ে প্রায় সমান্তরালভাবে চলতে থাকা খিলাফত আন্দোলনের দ্বারাও প্রভাবিত হন। এ ধরনের ব্রিটিশ রাজবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের শাস্তি হিসেবে তাঁকে জেলে যেতে হয়।
প্রসঙ্গত, আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজই পরবর্তীকালে রূপ নেয় আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে।
১৯১২ সালে রফি আহমেদ, মজিদ-আন-নিসা নামে উত্তর প্রদেশে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন। মজিদ আন নিসাও একই ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ ছিলেন। সে সময় ভারতীয় ক্রিকেট টিম তাদের পরিবারের দ্বারাই পরিচালিত হতো। বিশ্ব ক্রিকেট ম্যাচে জয়লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরা ভারতীয় ক্রিকেট দলকে একটি সুসংহত টিম হিসেবে গড়ে তোলেন। রফি আহমেদদের সংসারে আশীর্বাদ স্বরূপ একটি পুত্রসন্তান জন্মেছিল। দুর্ভাগ্যবশত মাত্র সাত বছর বয়সে কোন এক অজ্ঞাত, দুরারোগ্য অসুখে সেই শিশু সন্তানের মৃত্যু হয়।
রফির ছোট আরও চারটি ভাই ছিল—শফি আহমেদ কিদওয়াই, মেহফুজ আহমদ কিদওয়াই, আলী কামিল কিদওয়াই ও হুসেন কামিল কিদওয়াই। তাঁর ভাই শফি আহমেদ ছিলেন একজন কমিউনিস্ট কর্মী। শফির পত্নী ছিলেন লেখক আনিস কিদওয়াই, যিনি রাজ্যসভার একজন সদস্য ছিলেন। শফি-আনিস, এই গুণী দম্পতির নাতনীরা হলেন জেএনইউয়ের (জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি) কট্টর নারীবাদী ও রাজনীতিতে কমিউনিস্ট মতাদর্শে নিবেদিত প্রাণ আয়শা কিদওয়াই এবং বিখ্যাত সাংবাদিক সীমা মুস্তফা। আরেক ভাই মেহফুজ আহমদের ছেলে ফরিদ কিদওয়াই উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির সদস্য এবং উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের একজন মন্ত্রী। রফির অন্য ভাতিজারা হলেন রিশাদ কামিল কিদওয়াই (মেহফুজ আহমেদ কিদওয়াইয়ের ছেলে), মুমতাজ কামিল কিদওয়াই (আলি কামিল কিদওয়াইয়ের ছেলে) এবং হাসান জাভেদ কিদওয়াই (হুসাইন কামিল কিদওয়াইয়ের ছেলে)।

প্রাক স্বাধীনতায় রফির রাজনৈতিক ভূমিকা
আলিগড়ের মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজে পড়াশোনার পর রফি আহমেদ কিদওয়াই খিলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯২৬ সালের নির্বাচনে অযোধ্যা থেকে তিনি স্বরাজ পার্টির প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত হন। ওই অ্যাসেম্বলিতে তিনি স্বরাজ পার্টির চিফ হুইপ হন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি পার্টির বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে অ্যাসেম্বলিতে তিনি স্বরাজ পার্টির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। তিনি মতিলাল নেহরুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর কংগ্রেস পার্টি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) পূর্ণ স্বরাজ দাবি করে এবং ১৯৩০ সালের জানুয়ারিতে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন যাত্রা শুরু করেন।
১৯৩৫ সালে ভারত সরকার আইন (ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট) পাস হলে রফি আহমেদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্য একটি অফিস উদ্বোধন করেন। ১৯৩৭ সালে কিদওয়াই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন স্কিমের আওতায় আগ্রার সংযুক্ত প্রদেশ ও অযোধ্যার গভর্নর গোবিন্দ বল্লভ পন্থের মন্ত্রিসভার রাজস্ব ও জেলমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার দায়িত্ব পালনকালে জমিদারি প্রথা শুধু যে লোপ পায় তাই নয়, এ ব্যাপারে উত্তর প্রদেশই (ইউপি) প্রথম প্রদেশ হিসেবে ভারতে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪০ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাবের ডাকে তিনি কেন্দ্রীয় আইন সভার (সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি) সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে তিনি প্রাদেশিক ইউপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকা
রফি আহমেদ কিদওয়াই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রধান সহযোগী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজ থেকে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কিদওয়াই ভারতের প্রথম যোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এই রফি আহমেদ কিদওয়াই এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ নেহরুর গঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রথম দুই মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিদওয়াই বাহরাখ থেকে নির্বাচিত হন। এক সময়ে নেহরু খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় দুটিই কিদওয়াইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

মৃত্যু
১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর মাত্র ৬০ বছর বয়সে রফি আহমেদ কিদওয়াই হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। একটি সভায় বক্তৃতাকালে তিনি অ্যাজমাজনিত শ্বসকষ্টে আক্রান্ত হন। তাঁর বাসভবনের মসজিদ প্রাঙ্গণের সমাধিস্থলে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিসৌধটি মোগলদের নকশা অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে।

কিদওয়াই নিয়ে আরও কিছু কথা
অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (আইসিএআর) কৃষি ক্ষেত্রে ভারতীয় গবেষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালে রফি আহমেদ কিদওয়াই পুরস্কার প্রবর্তন করে। এটি এক বছর পর পর দেওয়া হয়। পুরস্কারটি পদক, উদ্ধৃতি ও নগদ টাকা মিলিয়ে প্রদান করা হয়।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ভারত সরকার গাজিয়াবাদ ডাকবিভাগ স্টাফ কলেজের নাম রফি আহমেদ কিদওয়াইয়ের নামে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। জাতীয় একাডেমি ইউপিএসসি দ্বারা পরিচালিত সিভিল সার্ভিসেস প্রতিষ্ঠান, পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত ভারতীয় ডাক সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব নেয়। এই একাডেমিটি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নামে বরাদ্দ করা প্রশাসনিক একাডেমি এবং সরদার বল্লব ভাই প্যাটেলের নামে করা পুলিশ একাডেমির সমকক্ষ হিসেবে একই লিগে অবস্থানের মর্যাদা পেয়েছে।
কলকাতা শহরেও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই নায়ককে গৌরবান্বিত করার জন্য তাঁর নামে একটি বড় রাস্তার নামকরণ করা হয়। তাঁর মূর্তি ইন্দিরা নগর, লক্ষ্ণৌ, নতুন দিল্লির কৃষি ভবনে জাতির প্রতি তাঁর সেবার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট ভবনের কমিটি রুমে তাঁর একটি প্রতিকৃতি রক্ষিত রয়েছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অঙ্কোলজিও তাঁর নামে হয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁর বিরাট অবদানও আছে। তিনি ওই ক্যাম্পাসের জন্য ২০০ একর জমি ও নগদ সেদিনের ১০০ হাজার টাকা দান করেন।
রফি আহমেদের সম্মাননায় শিক্ষাবিদ আসাদ আলী ফারুকী উত্তর প্রদেশের হড়দি জেলায় রফি আহমেদ কিদওয়াই ইন্টারন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৮ সালে কলেজটি জুনিয়র হাইস্কুল হিসেবে চালু হয় এবং পরবর্তীতে এটি একটি ইন্টার কলেজ হয়ে ওঠে। সম্প্রতি রফি আহমদ কিদওয়াই ইন্টার কলেজের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে।
এত কিছুর পরেও একটা দুঃখ থেকে যায়। ঐতিহাসিক পল ব্রাসের মতে, কংগ্রেসের আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য বিশাল অর্থ সংগ্রহের এই অবিসংবাদিত নেতা তাঁর নিজের ধনসম্পদ থেকেও কোন বাছবিচার না করে সবাইকে দিয়ে গেছেন। মৃত্যুকালে প্রচুর ঋণ রেখে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। শেষ সময়ে তাঁর সম্বল ছিল, প্রায় ভেঙে পড়া তাঁর গ্রামের বাড়িটি।