বিদেশি কয়েদিকে নিয়ে বিড়ম্বনা

কিছু স্মৃতি কখনো সহসা এসে দাঁড়ায় মনের দরজায়; আবার চটজলদি তা মিলিয়েও যায়। ফেলে আসা দিনে জমা হওয়া হাজারো স্মৃতির মধ্যে কোনো কোনোটি আবার ফিরে ফিরে আসে। কড়া নাড়ে অবিরত। এই যেমন গত শতকের নব্বই দশকের কিছু স্মৃতি কড়া নাড়ছে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় তখন। শহরের জেলা কারাগারে প্রশাসন থেকে একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নাম প্রস্তাব করে ঢাকায় নাম পাঠানো হতো, যাকে রুটিন মতো জেলা কারাগার পরিদর্শন করতে হতো নারী-পুরুষ কয়েদিদের ভালো-মন্দের দেখভালের জন্য। জরুরি কারণেও মাঝেমধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ বিশেষ নাগরিকদের স্মরণ করতেন। জেলা প্রশাসনের পাঠানো তালিকায় আমার নাম ছিল টানা কয়েক বছর। মাসে দু-তিনটি সভায় অংশ নেওয়া ছাড়া আসল কাজ ছিল জেলের অভ্যন্তরে কয়েদিরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কি না, তা দেখা।
১৯৯১ সালের গ্রীষ্মে জরুরি একটি ফোন এল জেলা কারাগার থেকে। বিদেশি এক নারী অনুপ্রবেশকারীকে নিয়ে জেল গেটে এসেছে তৎকালীন বিডিআর কর্তৃপক্ষ। জেল কর্তৃপক্ষকে ওই বিদেশি কোনোভাবেই সহায়তা করছেন না। উদ্ভূত পরিবেশ নিয়ে সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। জরুরি সভার আয়োজন করা হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটা উপায় বের করতে। জেলা কারাগার তখন নদীর পাড়ে ছিল। পুরোনো হাসপাতাল-সংলগ্ন। রিকশাযোগে ছুটলাম জেলের উদ্দেশ্যে। অপেক্ষমাণ ডিস্ট্রিক্ট জেলার জেল গেটে স্বাগত জানালেন। জানতাম যে, জেলার সাহেব বেশ করিতকর্মা লোক। সব দিক ম্যানেজ করতে পারদর্শী। কিন্তু এক বিদেশির বেলায় তিনি কেন ব্যর্থ হলেন, আমি তা বুঝতে পারছি না। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ভেতরে জেলার সাহেবের অফিসে। গিয়ে দেখি তিনজন বিডিআর সদস্য বেষ্টিত হয়ে চেয়ারে বসে আছেন দীর্ঘদেহী এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশি নারী। কর্তৃপক্ষ জানালেন, অজ্ঞাত এই আমেরিকান তরুণীকে সীমান্ত এলাকায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরার সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আটক করা হয়েছে। তখনো নাম না জানা এই বিদেশি তরুণী সুনামগঞ্জ ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এই দুর্গম সীমান্তে কাগজপত্র ছাড়া কীভাবে এলেন, তা দু দেশের সীমান্তরক্ষীদের
কাছে ছিল বিস্ময়ের।
ফিরে আসি মূল গল্পে। আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী মার্কিন তরুণীকে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার করা হলো তাহিরপুর সীমান্তে। সীমান্তে স্বল্প সুবিধা সংবলিত বিওপিতে বিদেশি আধুনিক নারীকে রাখা নিয়ে শুরুতেই নানা সমস্যা দেখা দেয়। জরুরি বার্তা পাঠানো হলো জেলা সদরের ব্যাটালিয়ন কমান্ড অফিসে, যার অবস্থান ছিল শহরের উত্তর-পূর্বাংশে শহরের একমাত্র শ্মশানঘাটে যাওয়ার পথে সুরমা নদীর পাড়ে। বর্তমানে অবশ্য জেলা সদর দপ্তরটি শহরে ঢোকার মুখে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পশ্চিম পাশের বিস্তীর্ণ ধানি খেতের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৩০/৩১ বছর আগে তৎকালীন বিডিআরের প্রধান ছিলেন সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার রনকেলী গ্রামের কৃতি সন্তান মেজর জেনারেল শফী আহমদ চৌধুরী। তিনি সুনামগঞ্জ এলেন জেলায় বিডিআরের সদর দপ্তরের স্থান নির্বাচনের জন্য। স্থানীয় প্রশাসন সে সময় বর্তমান স্থানটি প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব করে, যা ধান খেতসহ ছোট ছোট জলাশয়ে পরিপূর্ণ ছিল। সুনামগঞ্জের বর্তমান ভিআইপি সার্কিট হাউসের জায়গার মূল মালিক ছিলেন আমার এক প্রবাসী চাচাতো ভাই। সেটা ছিল ১৯৮৬ সাল। ওই বছরই ছিল আমার বিয়ের বছর।
উল্লেখিত স্থান নির্বাচনের পর সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে দর কষাকষিসহ যাবতীয় বিষয়াদি সম্পন্ন হয়েছিল আমার মাধ্যমেই। বিডিআর প্রধান প্রশাসনের লোক পাঠালেন আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে জানিয়ে। পুরোনো সার্কিট হাউসে যাওয়ার পর জানতে চাইলেন, ‘এত নিচু জমি, যা খাল-ডোবায় পরিপূর্ণ, তা এত দামি কৃষি জমি কেমন করে হলো? এখনো স্পষ্ট মনে আছে উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘আপনার দেখা এসব বোরো জমিতে ফসল ফলে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ মন ধান। বিপরীতে আপনার গ্রামের বাড়িসংলগ্ন কৃষি জমিতে ধান ফলে ৫/৬ মন। সেই অনুর্বর জমি যদি বেশি দামে ক্রয়-বিক্রয় হতে পারে তো আমাদের ডোবা ও জলাশয়ে-পূর্ণ বেশি ফসল উৎপাদনে সক্ষম জমির মূল্য তিন-চার গুণ বেশি হওয়া তো স্বাভাবিক।’ উত্তর শুনে তৎকালীন বিডিআর প্রধান বিষয়টি নিয়ে আর বেশি এগোতে চাননি বলে সত্ত্বর সভা ছেড়ে বিদায় নিতে হয়েছিল।
যাক মূল গল্পে ফিরে আসি। পরে শুনেছি হাওর ও পাহাড় পরিবেষ্টিত তাহিরপুর সীমান্তে ধৃত আমেরিকান তরুণীর অমানবিক উৎপাত আর বিরূপ ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে জরুরি ভিত্তিতে স্পিডবোট পাঠিয়ে তাঁকে দ্রুত জেলা সদরে আনা হয়। বিস্ময়কর বিষয় ছিল সেই সময়কার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ আমেরিকান অধিবাসীকে আইন মোতাবেক হ্যান্ডকাপ পরাতে ব্যর্থ হন, যা সেই বিদেশিনীকেও বেশ অবাক করেছিল। সুনামগঞ্জে মাসখানেক অবস্থানকালে এক সাক্ষাতে গুরুতর অপরাধ করার পরও তাঁকে কর্তৃপক্ষ হ্যান্ডকাপ কেন পরাল না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে দেখা গেছে। আমিও বিদেশি ওই তরুণীকে এর কোনো সঠিক জবাব দিতে পারিনি।
ছোট এই মফস্বল শহরের আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের সে সময় কি এত সাহস ছিল যে একজন আমেরিকান রূপসী তরুণীর হাতে হাতকড়া পরাতে পারে? তবে বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি সব প্রতিষ্ঠান অনেক এগিয়েছে বটে। এখন আর দেশি-বিদেশি কোনো অপরাধীই আইনের বাইরে নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশ আরও এগিয়ে যাক, তা আমাদের কাম্য।
যা হোক জেলা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের দুজন কর্মকর্তাসহ জেল কর্তৃপক্ষের (আমিসহ) জরুরি সভা বসেছে বিদেশি তরুণীকে সামলানোর সঠিক ও শান্তিপূর্ণ উপায় বের করতে। সিদ্ধান্ত হলো তরুণী কয়েদির সঙ্গে শান্তি আলোচনার শুরুর প্রথম বৈঠকে আমরা দুজন থাকব। আমার সঙ্গে আরেকজন এডিসি জেনারেল; তাঁর নামটি এই মুহূর্তে মনে আসছে না। জেলার সাহেবের অফিসে শুরু হলো শান্তি আলোচনা। কেতাবি ইংরেজিতে কথা বলে বারবার জানার চেষ্টা করা হলো জেলের ভেতরে থাকাকালে তিনি কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হবেন বলে মনে করেন। তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল, আনুমানিক কত দিন তাঁকে জেলে বাস করতে হবে? বিনা মূল্যে কোনো আইনি পরামর্শ পাওয়া যাবে কি না? দুঃখের বিষয় প্রথম প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারও জানা ছিল না। তবে বিদেশি কয়েদিকে একবার জেলের ভেতর তাঁর সম্ভাব্য থাকার জায়গা একবার দেখে আসার প্রস্তাব দেওয়া গেল। শুনে তিনি রাজি হলেন।
মহিলা কয়েদিদের থাকার আবাসস্থল বলে পরিচিত জেনানা সেলে যাওয়ার আগে সেই বিদেশিনী নতুন একটি শর্ত জুড়ে দিলেন। জেদ ধরলেন আমাদেরও যেতে হবে তাঁর সঙ্গে জেনানা সেলে। আবারও বোঝানোর চেষ্টা হলো, জেলকোড অনুযায়ী কোনো পুরুষ জেনানা সেলে প্রবেশ করতে পারবে না। মুশকিল হলো সেই মার্কিন তরুণী কোনো কোড মানতে রাজি নন। তাঁর সঙ্গে আমাদের যেতেই হবে। শেষ পর্যন্ত জেলার সাহেবও রাজি হলেন আমাদের সঙ্গী হতে। জেল গেটের ঠিক উল্টো দিকে উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল জেনানা সেল। রওনা দেওয়ার আগে একজন প্রবীণ সুবেদার (জেলারের পর যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী), একজন সিপাহিকে ডেকে কানে কানে কী যেন বলে আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলেন জেলার সাহেব। মিনিট পাঁচেক পর বেশ স্বাস্থ্যবান মধ্যবয়স্কা এক মহিলা আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
জেলার সাহেবের কাছে গিয়ে নিচু স্বরে কী যেন জানালেন সুবেদার সাহেব। স্বাভাবিক বাঙালি নারীদের চেয়ে উঁচু গড়নের এই নারী নিজের স্বামীকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। খুনের মতো বড় ধরনের অপরাধ, সঙ্গে বড়সড় দৈহিক গড়নের কারণে তিনি ছিলেন জেনানা সেলের সর্দারনি। তাঁর হুকুম ছাড়া জেনানা সেলে মশা-মাছিও প্রবেশ করতে পারত না। এ যেন সরকার দ্বারা পরিচালিত কারা কর্তৃপক্ষের ভেতরে আরেকটি সরকার, যার প্রধান থাকেন কোনো বড় মাপের অপরাধ করে আসা সাজাপ্রাপ্ত পুরুষ বা নারী কয়েদি। সদ্য জেলা কারাগারে নিয়ে আসা বিদেশি কয়েদির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত সেল পরিদর্শনে জেনানা ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা চার পুরুষ। এখানেও আইনের বাধা-নিষেধ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আইন হচ্ছে জেনানা সেলে কোনো পুরুষ একমাত্র পাগলা ঘণ্টি বাজলে প্রবেশ করতে পারবে। অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে এটি নিষিদ্ধ।
এই অবস্থায় দুটো রাস্তা আছে। কারাগারে পাগলা ঘণ্টি বাজাতে হবে অথবা সেই সর্দারনীর দেখে আসা সার্বিক চিত্রকে নিজ চোখে দেখা চিত্র বলে মেনে নিতে হবে। জেলার জানালেন পাগলা ঘণ্টি বাজালে ওপর মহলে কারণ জানাতে হবে। তার মানে পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। এখন থাকল বিদেশি কয়েদি ও সেল মেটের দেওয়া বিবরণে নির্ভর করা। আমাদের পরের মাধ্যমটির শরণ নিতে হলো। দেশি ও বিদেশি দুজন অঘোষিত পরিদর্শকের জেনানা সেলের তাৎক্ষণিক পরিদর্শন বিবরণ বেশি দীর্ঘ না হওয়াতে এর সমস্যা সমাধানে বসা গেল জেলার সাহেবের অফিস কক্ষে।
পরিদর্শনে পাওয়া ডজনখানেক অভিযোগের প্রধান অভিযোগ ছিল দুটি। প্রথমটি, কক্ষে আলো-বাতাস কম। এবং দ্বিতীয়টি হলো টয়লেটের কমোড পুরোনো স্টাইলের, যা বিদেশির জন্য ব্যবহার অসুবিধাজনক। প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নিলেন জেলার সাহেব। তাঁর মতে, মাত্র দু ঘণ্টায় এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। তবে পরের সমস্যা সমাধান সময় সাপেক্ষ। কমপক্ষে ২/৩ দিল লাগতে পারে। এদিকে বিদেশি কয়েদি গো ধরলেন, টয়লেটের সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত সেলে যাবেন না। জেলার সাহেব পড়লেন মহা ঝামেলায়। হঠাৎ করেই আমার মাথায় খেলে গেল এক বুদ্ধি। আমাদের আব্বার একবার হাঁটুতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্যানে বসে টয়লেট করতে সমস্যা হতো। এর সহজ সমাধান করা হয়েছিল বেতের তৈরি মোড়ার উপরিভাগ মাপমতো কেটে প্যানের ওপর বসিয়ে। ঠিক এটিই করা হয়েছিল ওই বিদেশি তরুণীর জন্য। মফস্বল শহরের নামমাত্র জেলা কারাগারের জেনানা সেলের দেশি টয়লেটকে জরুরি ভিত্তিতে বিদেশি আদলের হাই কমোডে রূপান্তর করা হয়েছিল শক্ত ও উঁচু মাপের বেতের মোড়া ব্যবহার করে। এত দিন পর বিস্তারিত সব মনে না পড়লেও জেলে গেটে আমাদের বিদায় জানাতে আসা জেলার সাহেবের শেষ কথা আজও ভুলিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘ভাইজান, বাঁচালেন আমাকে।’