বিপদ বাড়ছে ট্রাম্পের

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসনের জন্য উন্মুক্ত শুনানি শুরু হয়েছে। ১৩ নভেম্বর আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম প্রেসিডেন্টকে অপসারণে তদন্ত কার্যক্রমের উন্মুক্ত শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে উঠে আসে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের স্বার্থে আমেরিকাকেও জলাঞ্জলি দিতে পারেন।
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর জন্য ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কিনা—তা নিয়েই এ তদন্ত শুরু হয়েছে।

প্রতিনিধি পরিষদে এই অভিশংসন তদন্তের পদ্ধতি সম্পর্কিত প্রস্তাবটি পাসের পর ১৩ নভেম্বর থেকে শুরু হয় উন্মুক্ত শুনানি, যা সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। তদন্তকারী হাউস ইনটেলিজেন্স কমিটি এই শুনানি গ্রহণ করে। শুরুতেই কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম শিফ এ ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এই শুনানি শুধু ট্রাম্পকে কেন্দ্র করেই নয়। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্সি কীভাবে কাজ করে, আইনসভা ও নির্বাহী শাখার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও সংবিধান অনুযায়ী জবাবদিহির উপায়গুলো নিয়েও এখানে কথা হবে। এসব প্রশ্নের বিপরীতে আমাদের দেওয়া উত্তর এই প্রেসিডেন্সির পথকেই শুধু নয়, প্রেসিডেন্সির ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করবে। এর মাধ্যমে নির্ধারণ হবে, আমেরিকার জনগণ তাদের প্রধান নেতার কাছ থেকে কোন ধরনের আচরণ চাইতে পারে।’

এই শুনানিতে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ বিষয়ে শিফ বলেন, ‘প্রশাসনের এই পদক্ষেপ মার্কিন জাতির প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে এই প্রশাসনের আরও বেশি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাব্যতার বিষয়টি।’ তিনি বলেন, ‘আমেরিকানরা কি তাদের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশা করে? এটি অভিশংসনযোগ্য না হলে, কোনটি হবে?’
অ্যাডাম শিফ এই শুনানিকে কোনো দলীয় বিষয় নয় উল্লেখ করে একে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য জরুরি বলে আখ্যা দেন। নিজের বক্তব্যে তিনি সংবিধানের প্রসঙ্গ টানেন। একই সঙ্গে বলেন, একজন প্রেসিডেন্ট সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে আমেরিকার সব আইন মেনে চলার শপথ নেন, যেখানে রাষ্ট্রের সব শাখার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শপথ নেন, আমেরিকা যেন রাজতান্ত্রিক কোনো দেশে পরিণত না হয়, সে সুরক্ষা দিতে। এদিক থেকে এই শুনানি কোনো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট বা কোনো দলের বিরুদ্ধে নয়। বরং মার্কিন জনগণ আমেরিকার সরকারকে কীভাবে কাজ করতে দেখতে চায়, তা বের করে আনাটাই এ শুনানির লক্ষ্য।

শুনানি শুরুর আগে মঞ্চের পেছনে জড়ো হওয়া রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দ পুরো তদন্ত কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে—এমন কিছু প্রতীক প্রদর্শন করেন। তাঁরা এটিকে ‘তামাশা’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেন। হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটিতে থাকা ক্যালিফোর্নিয়ার রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ডেভিন নুনস এই শুনানি সম্পর্কে বলেন, ‘এটি ডেমোক্র্যাটদের ২০১৬ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দেওয়ার এক করুণা উদ্রেককারী চেষ্টা। যে হুইসেলব্লোয়ার অভিযোগটি তুলেছেন, তিনি ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত।’ তিনি এই শুনানি স্থলকে এমনকি ‘স্টার চেম্বার’ বলেও অভিহিত করেন।

কিন্তু শুনানি শুরু হওয়ার পরই ডেভিন নুনসের এই বক্তব্য হাস্যকর হয়ে ওঠে। কারণ প্রথম সাক্ষ্যটিই ছিল ট্রাম্পের পায়ের তলার মাটি নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। গত ২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলোনস্কিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফোন করা এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর চাপ প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্ফোরক তথ্য আগেই এসেছিল। শুনানির প্রথম দিন ওই অভিযোগ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য হাজির করেন ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন কর্মকর্তা বিল টেইলর।

শুনানিতে বিল টেইলর জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুইলিয়ানির নেতৃত্বে ইউক্রেনের সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ তৈরি করা হয়েছিল। এই যোগাযোগ মাঝেমধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে হাজির হতো। এমনকি ওই অঞ্চলে আমেরিকার দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধেও রুডি জুইলিয়ানির নেতৃত্বাধীন অপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগটি দাঁড়িয়েছে।

শুনানিতে বিল টেইলর আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত গর্ডন সন্ডল্যান্ড ও ইউক্রেনের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে বিভিন্ন তথ্য দেন। তিনি এই ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুস্পষ্টভাবে জানান, ইউক্রেনের প্রাকৃতিক গ্যাসের কোম্পানি বোরিসমা হোল্ডিংসের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ শুরুর ঘোষণার আগ পর্যন্ত ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা কেন বন্ধ রাখা হবে-তা তাঁর বোধগম্য নয়।
এই বোরিসমা হোল্ডিংসের পরিচালনা পরিষদেই রয়েছেন হান্টার বাইডেন, যিনি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে।

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি এ শুনানিতে উঠে এসেছে, তা হলো ট্রাম্পের কাছে আমেরিকার চেয়ে নিজের স্বার্থ বড়। বিল টেইলর জানান, গত ২৬ জুলাই, ট্রাম্প-জেলেনস্কির বিতর্কিত ফোনালাপের পরদিন গর্ডন সন্ডল্যান্ড জেলেনস্কির এক শীর্ষ উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তাঁদের মধ্যে হওয়া আলোচনার বিষয়ে জানাতে সন্ডল্যান্ড ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফোন করেন। সে সময় টেইলরের এক উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন সেখানে, যিনি ট্রাম্পকে স্পষ্টভাবে ‘তদন্ত’ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শোনেন। এর পর ইউক্রেন সম্পর্কে ট্রাম্পের ভাবনা জানতে সন্ডল্যান্ডকে প্রশ্ন করেন ওই উপদেষ্টা। উত্তরে সন্ডল্যান্ড জানান, ‘প্রেসিডেন্ট অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বাইডেন সম্পর্কিত তদন্তকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।’
এই একটি তথ্যই সবকিছুকে ওলটপালট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ, বাইডেন সম্পর্কিত তদন্তটি মূলত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ইউক্রেন আমেরিকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত যদি প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে তা আমেরিকার জনগণের স্বার্থকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। কিন্তু এ অবস্থায়ও ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেইন’ স্লোগান তোলা ট্রাম্প নিজের স্বার্থটিকেই সর্বাগ্রে রাখতে চান। আমেরিকা কেন কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের পক্ষেই এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। আর এমন অগ্রহণযোগ্য আচরণের সাক্ষ্যটি উন্মুক্ত শুনানির প্রথম দিনেই উঠে এল, যা ট্রাম্পকে নিঃসন্দেহে বিপাকে ফেলবে।

অবশ্য শুনানির পর দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প বলেছেন, এগুলোর কোনো মূল্য তাঁর কাছে নেই। তিনি অনেক ব্যস্ত। ফলে শুনানিটি তিনি দেখতে পারেননি। মুখে যা-ই বলুন না কেন, রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতিক্রিয়া বলে দিচ্ছে, পুরো প্রশাসনকে নিয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প পাঁকে পড়েছেন। সেখান থেকে তিনি ও তাঁর প্রশাসন উঠে আসতে পারে কিনা, তা এখন দেখার বিষয়।