বেহালা ছোঁয়া দরজা

বুবু খুব করে বলে দিয়েছিলেন নতুন বাসায় ওঠেই রেজিয়া যেন কোরআন খতম দেওয়ায়। সে রকম হলে কোরআনের সিডি কিনে এনেও যেন লাগিয়ে রাখে। একেকটা আয়াতের সঙ্গে বাড়িতে ছুঁয়ে থাকা আত্মা, বালা, অশুভ দূরে ভেসে যাচ্ছে ভাবতে বেশ লাগে। অবশ্য এমন চমৎকার বাড়িতে অশুভ কিছু থাকতে পারে, ভাবতেই ইচ্ছে করে না রেজিয়ার। সংসারের এ বাড়ির সবকিছু বড় ভালো। হতে পারে, এসব তার প্রথম সংসার পাতার উচ্ছ্বাস। মা না থাকায়, এর সংসার ওর সংসারে ভাগ নিতে নিতে বিপর্যস্ত মেয়ের আস্ত একটা সংসার পাওয়ায় উচ্ছ্বাস হয় বৈকি। কিংবা হয়তো বাড়িটা এমনই, আপন আপন এক গন্ধ আছে।
সামনের বাগান থেকে ছুটে আসছে ফুলের সব ঘ্রাণ। পাশের বাসার ভাবি বলেছিল, ছাতিম ফুলের গন্ধটাই বেশি জেঁকে বসে এই সময়টায়। এই ঘ্রাণের পারফেক্টনেসের জন্য যতটুকু নির্জনতা দরকার, সেটুকু বাড়িটা পেয়েছে বলে আরও বেশি মুগ্ধতা কাজ করে। বুবু দেখলে ঠিক বলতেন, ‘ফুলের বাগান করেছে, তার মানে লোকটার ধৈর্য আছে আর মনটা বড় ভালো।’ কেবল ফলের বাগান থাকলে বুবু খিটমিট করতেন ‘বড় হিসেবি বাড়িওয়ালা।’
নিজেদের মধ্যকার পার্থক্যের বলয় নিয়ে দুঘরের দম্পতি বেশ মানিয়ে গেলেও, অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ওই ছাদে ওঠার সিঁড়ির পাশের ঘর, সে ঘরের সংসার। পাশের বাসার ভাবি এক দুপুরে মেজাজ খারাপ করে জানিয়েছিল, এক খিটখিটে মেজাজের বুড়ি থাকেন ও ঘরে, বাড়িওয়ালার পিসি। বুড়ি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, ব্যস্ত রাখেন ওদেরও। রাত দুটো তিনটি হলেই খটখট শব্দ করেন, কীসব হাতি-ঘোড়া টানাটানি করেন। ছাদে রঙিন শাড়ি শুকোতে দিলে গায়েব করে দেবে, তারপর ফের ফেরত দেবে। মাঝেসাজে কী বিকট গন্ধ বেরোয়, যেন এক মাস কেউ গোসল করেনি। আর থাকে একটা কাকাতুয়া, ঠিক আরামের সময়টা বুঝে বুঝেই ডাকাডাকি শুরু করবে। একটা কাকাতুয়া নিয়ে বৃদ্ধা থাকেন বটে, কিন্তু ওঁকে ওরা কখনো দেখেনি।
পাশের ভাবি বৃদ্ধার গল্প জেনেছিল ভাড়া তুলতে আসা বাড়িওয়ালার দোকানের ম্যানেজারের বউয়ের কাছে। সে বউ শুনেছিল, কোনো এক দূর সম্পর্কের খালার কাছ থেকে, খালা শুনেছিল ওনার এক বান্ধবীর কাছে, সেই বান্ধবীও শুনেছে অন্য কারও কাছ থেকে। এভাবেই ওরা জেনেছিল, বৃদ্ধা এককালে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। পরীক্ষার হলে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত দেখে থ’ হয়ে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন। দারুণ বেহালা বাজাতেন। তবে সুখের ঘরের ঘুলঘুলিতেও তো অনাহূত পাখি এসে বাসা বাঁধে। যা হয় আর কি! পাড়ার এক মজনু দিশেহারা হয়ে অ্যাসিড ছুড়ে। সেই থেকে বড় একটা বেরোতেন না। এখন আত্মীয়দের থেকেও দূরে থাকেন। বয়স হয়েছে, অসুখও হয়তো ধরেছে কিছু, তাঁকে হয়তো আরও বেশি কুৎসিত দেখায়।
সৌন্দর্যের কাছে মানুষ কিছুটা ভব্য-সভ্য। কুৎসিতের সঙ্গে কুৎসিত হতে বাধা কোথায়! রেজিয়া নিজেকে দিয়েই বুঝে, সংসারে বৃদ্ধা কতটা অনাহূত, অপ্রস্তুত। তাই ওর সহানুভূতি, মায়া দরজার ওপাশের মানুষটার জন্য টলমল করে। নক্ষত্রের জন্য সন্ধ্যার বুকে যেমন হয়। খেতে বসলে মনে হয় কাকাতুয়াটা, বুড়ো মানুষটা খেয়েছে তো। ছাদে যাওয়ার সময় দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় কড়া নাড়লেই কি বিরক্তিরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে? চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ও শব্দ খুঁজে, খুঁজে শব্দের মানে।
এক সময় ওর মনে হতে থাকে দরজা থেকেও তাকে কেউ দেখছে। চারটে অবাক চোখ টের পাচ্ছে তার এই দাঁড়িয়ে থাকা। খুন্তি হঠাৎ থামিয়ে আবার জোরে নাড়াতে নাড়াতে ভ্রু কুচকে কেউ বলে উঠছেন, অভাগার বেটি এখানে কি করতেছিস! রাতে রেজিয়ার ঘুম ভেঙে গেলে সে অপেক্ষায় থাকে ওপরের শব্দ শোনার। চেয়ারটা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, তার মানে বাগানের জানালা বরাবর। রেজিয়াও ছোটে সেদিকে, তখন ফুলের ঘ্রাণ এত তীব্র হয়ে ওঠে। যতটা তীব্র হলে আমরা ভাবি প্রথম আসমানেও ছড়িয়ে গেছে ঘ্রাণ, ঠিক তখনই ওর মনে হয়, কেউ যেন বেহালা বাজায়।
রেজিয়ার মা মারা গিয়েছিল আগুনে পুড়ে। মা মরে যাওয়ার ছয় মাস পরও বুবু বলতেন, ‘বউয়ের পোড়া গন্ধ পাইরে।’ একের পর এক ফুলের গাছে ভরে যেত লাগল বাড়ি। বুবু সারা দিন ফুলের বাগান নিয়ে থাকতেন। অথচ শতেক ফুলের ঘ্রাণও মাকে ম্লান করতে পারেনি। ছোট চাচা সেবার আধা স্যুটকেস ভর্তি করে সুগন্ধী এনেছিল বুবুর জন্য, দেশে ফেরার সময়। বুবু একের পর এক শিশি খুলে শরীরে মাখতেন, বিছানায় ঢালতেন আর বলতেন ‘পোড়া গন্ধ, পোড়া গন্ধ’। সবাই ভেবেছিল বুবু বুঝি পাগলই হতে চলেছে।
সবকিছু বদলে গেল যেদিন বাড়ির কেউ একজন রেজিয়াকে বুবুর কাছে এনে দিল। যেমন লোকে আতরের ঘ্রাণ নেয়, রেজিয়াকে শুঁকে শুঁকে শান্ত হলেন বুবু। বুবু এখনো বলেন, রেজিয়ার শরীরে ফুলের বাস আছে। ছোটবেলায় মা মারা গেলে সন্তানের শরীরে অমন বেহেশতের বাগানের ঘ্রাণ হয়, মা-ই সেই ঘ্রাণ রেখে যায়। সে বাসে সাপ, প্রেত ছুটে আসে। বুবু তাই রেজিয়াকে তাবিজ পড়িয়ে রাখতেন, প্রতি সন্ধ্যায় ওর দিঘল চুলে ধূপ-আগরের ধোঁয়া দিতেন।
বুড়ো মানুষটাও কি রেজিয়ার কাছে আসতে পারে না, যে বাসে সাপ ছুটে আসে, ছুটে আসে আত্মা? হয়তো রেজিয়া সেই অপেক্ষায় কোনো দিন কড়া না নেড়েও কড়া নাড়তে থাকে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও বুঝি পুড়ে যাওয়া মাকেই দেখতে পায়। কত কিছু উপহার দিতে সাধ হয় রেজিয়ার। রেজিয়া যা দেখেছে, যে জীবন মায়ের সঙ্গে ভাগ করতে পারেনি, তারই কিছু সে ভাগ দিতে চায়। প্রথম দিন দরজার কাছে রেখে এসেছিল বাগানের প্রথম শেফালি। কে জানে, কত যুগ মানুষটা শেফালি ফুল ছুঁয়ে দেখেননি। বিকেলে ফুলগুলো দেখতে না পেয়ে কী যে খুশি হয়েছিল রেজিয়া, যেন মানুষটা প্রথম কথা বলে উঠলেন রেজিয়ার সঙ্গে। তারপর কোনো কোনো দিন সে দিয়ে গেছে কলা পাতা, তাতে রাখা শবে বরাতের হালুয়া রুটি, সূর্যমুখীর বীজ, ছোট্টবেলায় বাক্সে জমিয়ে রাখা চিল পাখির ডানা, লাল কাচের চুড়ি, তিতাসের জল, কুড়ানো পাথর, পাঁচ ঝিনুক, নিজের শরীর ঘষে ঘষে তোলা বেহেশতের ফুলের ঘ্রাণ।
আচ্ছা, দুটি প্রতিবেশীর গভীরে জেগে ওঠা এই অদ্ভুত ভালোবাসাটুকু আপনি তো অনায়াসেই কল্পনা করে নিতে পারেন। তাহলে চলুন, আমরা বরং ভেসে যাই ওদের প্রথম ঘন শ্রাবণে। সিঁড়ি ছাড়িয়ে পানি গড়াচ্ছে। ছুটে নেমেছে দুই দম্পতির দরজায়, যেন এক্কা–দোক্কা খেলছে কোনো এক দস্যি মেয়ে। জলের মতো অমন জাদু কে জেনেছে আর! এমনিতেই শহরের এদিকটায় বেশ কেঁচো, ঘরে-বাইরে পানি পেয়ে থইথই করতে থাকে অসংখ্য কেঁচোর শরীর। পাশের বাসার ভাবির জোঁক-কেঁচোতে ভয় পাওয়া একটানা চিৎকার বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে কাকাতুয়ার ডাকের মতন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পিসির ঘর থেকেই এই পানি নামছে। বিরক্তির শেষ সীমায় গিয়ে কর্তারা গর্জে ওঠেন, ‘এত দিন মায়ায় পড়ে অনেক সহ্য করেছি। আর তো নেওয়া যাচ্ছে না। কী শুরু করেছে বুড়ি! বাথরুমের সব পানি বালতি বালতি ফেলছে নাকি?’ ওরা গিয়ে তখন দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। রেজিয়ার মন বড় কেমন করে। বেহালা রঙের ও দরজায় প্রথম শব্দ কেমন হবে সেই সব সুন্দর ভাবনাকে দুমড়ে ফেলেছে এক জোড়া দস্যু। এতসব ধাক্কাধাক্কির পরেও কাজ না হলে বেসামাল ক্ষেপে ওঠে ওরা। ‘বুড়া মাগী’ বলে লাথি চালাতে থাকে এবার। হিম হিম কাঁপুনি নিয়ে রেজিয়া দরজা আগলে দাঁড়ায়। যেন আগলাতে চায় দরজায় কতকালের থমকে থাকা এক বিষণ্ন বেহালা, আগলাতে চায় একটি বুড়ো মানুষ, পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা কেড়ে নিয়েছে যার তাবৎ বেঁচে থাকার রং। ওকেও একপাশের জলে ছুড়ে দেয় একরোখা হাতের অহম। আহা, কখনো যদি ওই সব জলের মতো গলে যাওয়া যেত।
শেষমেশ অবশ্য পরাস্ত হয়ে বাড়িওয়ালাকেই ফোন করে আসতে বলে ওরা। লোকটা আসলে দুটো নীতি কথা যোগ হয়, অভিযোগের শেষে ‘দেখুন আপনার পিসির কাণ্ড। একটা না একটা সমস্যা প্রতিদিন আপনার পিসি করবেই। আপনার কি ধর্ম বলেও কিছু নেই? এভাবে একা ফেলে রাখলে যে কেউ পাগল হতে বাধ্য।’
তড়িৎকর্মা বাড়িওয়ালা কেঁচো পেরোতে পেরোতে, ছাতা সামলাতে সামলাতে বলেন, ‘শান্ত হোন, শান্ত হোন। পুরোনো বাড়ি, এই একটানা ঝড়-বৃষ্টিতে ছাদটার ওপাশটায় বোধ হয় সমস্যা হচ্ছে। চলুন তো দেখি গিয়ে। আর আমার পিসিই বা কোথায় পেলেন? জলজ্যান্ত একটা মানুষ! আমার তো পিসি–মাসি নেই কোনো।’
সত্যি তাই, বিলেতি ধাঁচের দরজার হাতলের লক খোলার পর আমরা বুঝতে পারি, ওখানে কোনো মানুষ নেই। কখনো ছিল না কেউ, নেই কোনো চেয়ার টেনে নেওয়া, কাকাতুয়া অথবা কোনো পালকের গল্প। একটা আপাত শূন্য ঘরে, সিলিং থেকে কেবল গড়িয়ে পড়ছে হু হু করা জল-টুপ, টুপ, টুপ, টুপ...