অপরাহ্ন সুসমিতোর তিনটি কবিতা

আজ বর আসিবে না

বিবাহের প্রস্তুত হলো ধনবাদী সমারোহণ
হাসতে হাসতে সমস্ত হলুদ জড়ো করল সে
পায়ে-পায়ে গায়েহলুদ নেই তবু পায়ে-পায়ে মাখলো সমুত্থান কাঞ্জিভরম

বাঈ এসে পান খেতে খেতে ধরল বাবু গান
কন্যাদানের প্রতিশ্রুতিতে জমি বিক্রি করতে করতে
পণের টাকা জোগাড় করতে করতে জোগাড় করতে করতে
বর হো হো করে উঠল কামদেবের পুষ্পময় ধনু আর প্রবুদ্ধ

বর মেতে উঠল প্রাক–বিবাহের প্রমোদে
বিবাহের প্রস্তুত হলো জননীর আটচালায়

পণ নামছে মেঘের মল্লারে তান উঠছে বিসমিল্লা জয়তু বলে
নাগেশ্বরে কাঁদছে একাকী পিতা
পায়ে হলুদের রোদে পিতা জবা গাছটির সমানে ঝুঁকে কাঁদছে
শ্যামবর্ণা বালিকার পায়ে আর হলুদ পড়ছে না
হলুদাভ রুপমতী একাকী রুপমোহে গাইছে গোলাপের রেখা গণিত

আ জ ব র আ সি বে না।


নিজস্ব মৃত্যু
আমার মৃত্যু সংবাদ লিখছি। খটাখট টাইপ করছি। নামের বানান লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় অপরাহ্ণ লিখে ফেলছি যেমন অধিকাংশ বন্ধুজন লেখেন। আবার টাইপ করতে গিয়ে নিজের কাছেই দ্বন্দ্ব হচ্ছে। কম্পিউটারে বানান ভুলে সমস্যা নেই, মুহূর্তে ঠিক করতে পারছি। 

অগ্রিম দেখতে পাচ্ছি নুরজাহান চক্রবর্তী লাইক দিচ্ছেন। জাহ্নবী মাসি সংক্ষেপে আরআইপি লিখছেন। যে সূচালু আহমেদের কাছে ১৪,৩০০ টাকা পেতাম, তিনি সবচেয়ে বড় কমেন্ট লিখছেন বিনিয়ে ইনিয়ে। মধু ভাই এখনো জানেন না। উনি প্রতি মাসের ২৮ তারিখ বেতন পান, সেদিন ফেসবুকে লগ-ইন করেন। উনি খুব কষ্ট পাবেন ভাবতেই একটা কষ্ট কাবেরী নদীর মতো তিরতির করল বুকের হিমালয় পাদদেশে।

আমি যে মন্ত্রণালয়ে কাজ করি, সেখানে বেশুমার ঘুষ। সহকর্মীরা চটজলদি চাঁদা দিতে শুরু করেন স্মরণ সভার। ঘুষখোর লোকজন খুব উদার হয় এ রকম দান খয়রাতে। বেতনের টাকায় গয়া কাশি যায়, হজ করে আর ঘুষের টাকায় বউকে বাদামি ব্রা কিনে দেয়। ফেসিয়াল করে, এবেনটি বায়স্কোপ করে।
আমার ড. যে হাসপাতালে কাজ করেন সেখানে ৮০% কর্মকর্তা–কর্মচারী পরস্পর প্রেম করেন। ড. আমার ডেথ সার্টিফিকেট খসখস লিখতে লিখতে খিকখিক হাসেন—
প্রেমের আবার প্রথম শেষ কি?
সামরান হুদা মাথা নিচু করে গল্প লিখছেন পাতার পর পাতা। মনটা রাজশাহী আমের মতো টুপলু হয়ে আছে; আহা সামরানের লেখা আর পড়ব না। মৃত্যুর পরেও আমার ইমেইল একই পাসওয়ার্ড থাকবে। খনাকে কি পাসওয়ার্ড দিয়ে যাব? সে আমার হয়ে জবাব দেবে।

খনা ছলছল কাঁদতে কাঁদতে বলবে—
: এই আমি মানস কন্যা, কত মানুষ স্বপ্নে নদীর ছবি আঁকে। তুমি এঁকেছিলে ছায়ায় ছায়ায় আমাকে। দাও রক্ত দাও এক প্রভু জীবন।
হাঁটতে হাঁটতে পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম, বাসার চাবির রিং, ফোনে অণু টেক্সট। তুমি ঘরে ফিরছ। কচুর লতি দিয়ে হাপুস হুপুস ভাত খাচ্ছ। খাবার সময় কাউকে সুন্দর লাগে না কেবল ছোট দুধের শিশু ছাড়া।
মৃত্তিকা নতুন ছবি পোস্ট করেছে। এত মুটিয়েছে তবুও শরণার্থী ভক্তের থকথকে দল কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। এত কবি আমাদের বাংলা ভাষায়। টেলিভিশনে কবিতা, গুলিস্তানে কবিতা, রিকশায় জড়াজড়ি কবিতা, আওয়ামী বিএনপি কবিতা, ফালতু কবিতা, নমশূদ্র কবিতা, সৈয়দ কবিতা...
এই সব পাঠ করে করেই নিজস্ব মৃত্যুর নোট লিখছি...

ঘুমাও, মেয়ে
আমি হাঁটু মুড়ে তোমার নাম ধরে বিনয় করে ডাকছি, তুমি উঠছ না কেন?
এত গাঢ় তোমার ঘুম? আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে...
ঘুমাও তুমি, ঘুমু করো মেয়ে।
এত শিশ্ন অধ্যুষিত পুরুষ তোমার চারপাশে অসভ্য লোলুপ ঘুরে বেড়ায়
শহরের কিলবিল অস্থি মজ্জায়
তুমি আর একাকী জ্যোৎস্না দেখবে না, বাড়ি ফিরে গেলে মা আর তোমার নাম ধরে ডাকবে না
তুমি ঘুমাও বালিকা তুমি ঘুমাও।
হাসপাতালের জানালা দিয়ে সবুজ গাছে সবুজ টিয়েগুলি যখন উড়ে গেল কোলাহলে
তোমার সমস্ত বুক অক্সিজেনের জন্য হা করে উঠেছিল
তুমি আর লম্বা বারান্দা ধরে হাঁটছ না। ও মেয়ে তুমি আর বাবার জন্য গ্লাস ভরে কোনো দিন পানি ঢালবে না।
নগর পিতা তোমার জন্য শহর বানায়নি, তোমার জন্য মধ্যরাত বানায়নি ঈশ্বর, পুরুষযন্ত্রও তোমার জন্য ছিল না বালিকা।
তুমি আর বাসে চড়বে না। ইচ্ছেমতো ইচ্ছার দূর পরিবহনে চড়বে না। তোমার কোনো ছেলেবন্ধু থাকতে নেই। নগরপিতা তোমাকে সিনেমা দেখতে দেবে না। ভয়ংকর পুরুষ তোমাকে তাল তাল মাংস মনে করেছে। তোমাকে লোহার পাত মনে করেছে, খেলতে খেলতে তোমার বুক ছিদ্র করেছে। আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি উপমহাদেশ, তোমাকে ক্রিকেট বলের মতো বাউন্ডারি পার করেছি মধ্যরাতের পরিবহন থেকে।
ও মেয়ে, তুমি রাস্তার পাশে ছিন্ন পড়েছিলে। তোমার স্যান্ডেল, হাতব্যাগ, প্রিয় মুখ দেখার আয়না কী সুন্দর তোমার পাশে সতেজ শুয়ে আছে
তুমি দেখোনি তোমার হাত ধরে পাশে বসেছিল তোমার মা শীর্ণ হাতে, বাবা কাঁদছিল।
কী কী প্রার্থনা করেছিল বলো তো?
এই মেয়ে, আমি তোমাকে ডাকছি। আমার সমস্ত শব্দ তোমার নিথর শয্যায় মাথা নত করে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এই মেয়ে, এই বালিকা তুমি আর রাত জেগে ক্লাসের পড়া পড়বে না?
ঘুমাও, ঘুমাও
পুরুষ তোমাকে জনমের মতো ঘুমের দেশে পাঠিয়েছে।