ট্রাম্পের অভিশংসন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত এ মাসেই

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব জানিয়েছেন, এ বছরের বড়দিনের আগেই অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন বা ইম্পিচমেন্ট প্রশ্নে প্রতিনিধি পরিষদে ভোট গৃহীত হবে। কংগ্রেসের এই নিম্নকক্ষে তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ট্রাম্প অভিশংসিত হবেন, এ কথা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু ক্ষমতা থেকে যে অপসারিত হবেন না, সে কথাও প্রায় নিশ্চিত।

অভিশংসনের পর প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা হবে কি না, সে প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শুধু সিনেটের। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৭ জন সিনেটরের হ্যাঁ–সূচক ভোটে তাঁকে অপসারণের বিধান রয়েছে। বর্তমানে সিনেটে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যা যথাক্রমে ৫৩ ও ৪৭। নাটকীয় কোনো ঘটনা না ঘটলে এক বা দুজনের বেশি রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পকে অপসারণের পক্ষে ভোট দেবেন না, এ কথা বলা মোটেই অযৌক্তিক নয়। একাধিক মধ্যমপন্থী ডেমোক্রেটিক সিনেটর যদি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন, তাতেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

ট্রাম্প অপসারিত হবেন না, এ কথা জানার পরও ডেমোক্র্যাটরা কেন মাসের পর মাস অভিশংসন নিয়ে পড়ে আছেন? কোনো কোনো রক্ষণশীল বিশ্লেষক মনে করেন, অভিশংসন নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ফলে ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা বড় রকমের ধাক্কা খেতে পারেন। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা ১৯৯৮ সালে রিপাবলিকানদের হাতে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অভিশংসনের উদাহরণটি দেখাতে ভালোবাসেন। সে সময় প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাধিক্য থাকায় তাঁরা অনায়াসে ক্লিনটনকে বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি ও মিথ্যা বলার অপরাধে অভিশংসিত করেন। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পাওয়ায় সিনেটে তাঁদের সে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এই অভিশংসনপ্রক্রিয়ার ফলে ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়, কোনো বাধা ছাড়াই তিনি নিজের দ্বিতীয় দফা শাসনকাল অতিবাহিত করেন। একই কারণে পরবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে রিপাবলিকান পার্টি চারটি আসন হারায়।

অভিশংসনবিরোধীরা মনে করেন, ২০২০ সালের নির্বাচনেও অভিশংসনকে বর্ম করে ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা সহজেই উতরে যাবেন। অভিশংসন-সমর্থকেরা অবশ্য যুক্তি দেখিয়েছেন, নিজের অনুগত সমর্থকদের বাইরে ট্রাম্পের জনসমর্থন নেই, নারী, সংখ্যালঘু ও শিক্ষিত-শহুরে নাগরিকদের মধ্যে তিনি রীতিমতো ধিক্কৃত। এ অবস্থায় অভিশংসন শুনানির ফলে ট্রাম্পের ক্ষমতার অপব্যবহারের যে প্রমাণপত্র বেরিয়ে এসেছে, তাতে তাঁর প্রতি বিরোধিতা আরও বাড়বে। এটি কেবল সময়ের ব্যাপার।

>

ট্রাম্প অভিশংসিত হবেন, এ কথা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু ক্ষমতা থেকে অপসারিত হবেন না, সে কথাও নিশ্চিত।

দীর্ঘদিন শুনানি ও ক্ষতিকর নানা তথ্য ফাঁস হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্পের প্রতি জনসমর্থন এখন পর্যন্ত মোটের ওপর একই রকম। অভিশংসন প্রশ্নেও জনমতের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। পরপর তিন সপ্তাহ উন্মুক্ত শুনানি শেষে এখন অভিশংসন সমর্থন করে, এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ১৫ দিন আগের তুলনায় সামান্য কম। বিপক্ষে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ৫। এ হিসাবটি এসেছে অত্যন্ত নির্ভরশীল হিসেবে বিবেচিত নির্বাচনী বিশ্লেষক নেট সিলিভারের ফাইভ-থার্টি-এইট ওয়েবসাইট থেকে।

অন্যান্য প্রশ্নের মতো অভিশংসন প্রশ্নেও মার্কিন জনমত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—দুই ভাগে বিভক্ত। অধিকাংশ ডেমোক্র্যাট (৮৪ শতাংশ) অভিশংসনের পক্ষে এবং অধিকাংশ রিপাবলিকান (৮৯ শতাংশ) অভিশংসনের বিপক্ষে। অভিশংসনপ্রক্রিয়ার গোড়া থেকেই এই দুই দলের সমর্থকদের অবস্থা কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ডেমোক্র্যাটদের জন্য সুখবর, উন্মুক্ত শুনানি শেষে স্বতন্ত্র ভোটারদের মধ্যে অভিশংসনের পক্ষে সমর্থন সামান্য বেড়েছে। নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে ডেমোক্র্যাটরা তাঁদের মুখের দিকেই চেয়ে আছেন। অভিশংসন ঘিরে উভয় দলের সমর্থকেরাই আগের চেয়ে অধিক উজ্জীবিত, আগামী নির্বাচনে তাঁদের এই চাঙা মনোভাব বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে ভাবা হচ্ছে।

এই স্পষ্ট বিভক্তির মুখে ডেমোক্র্যাটদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কী কারণে তাঁরা ট্রাম্পকে অভিশংসিত করতে চান, তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে কংগ্রেসে উত্থাপন করা। ‘অভিশংসন ধারা’ বা আর্টিকেলস অব ইম্পিচমেন্ট লেখার দায়িত্ব কংগ্রেসের বিচার বিভাগীয় কমিটির। এই কমিটি কাল বুধবার থেকে দ্বিতীয় দফা উন্মুক্ত শুনানির ব্যবস্থা করেছে, যেখানে মূলত শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হবে। কমিটির প্রধান কংগ্রেসম্যান জেরি ন্যাডলার ট্রাম্প ও তাঁর আইনজীবীদের এই শুনানিতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ট্রাম্প সে প্রস্তাবে ‘না’ বলেছেন। তাঁর চোখে অভিশংসনের পুরো ব্যাপারটাই অবৈধ, বিচার বিভাগীয় কমিটির শুনানিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে প্রক্রিয়াকে আইনসিদ্ধ করা হবে, সেই কারণেই এই প্রত্যাখ্যান।

ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় পার্টিই আগামী নির্বাচনে অভিশংসনের প্রশ্নটি যার যার তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী। এই মুহূর্তে ডেমোক্র্যাটরা ২৩৩-১৯৭ সদস্যের সংখ্যাধিক্য নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। ট্রাম্পের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট, বিশেষ করে নারী ও শহুরে ভোটারদের কাঁধে ভর করে তাঁরা ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেন। যে ৪০টির মতো নতুন আসন তাঁরা দখল করেছেন, তার অনেকগুলোই রিপাবলিকান হিসেবে বিবেচিত, এমন অঞ্চল থেকে। অভিশংসনের প্রশ্নটি যদি ডেমোক্র্যাটরা গুবলেট করে ফেলেন, তাহলে এসব আসনের গোটাকয় ছিটকে যেতে পারেন। নিদেনপক্ষে রিপাবলিকানদের সেটাই আশা। তবে তাঁদের জন্য বড় মাথাব্যথা সিনেটে তাঁদের বর্তমান ৫৩-৪৭ আসনের সংখ্যাধিক্য ধরে রাখা। তাঁদের মধ্যে অন্ততপক্ষে পাঁচজন সিনেটর ডেমোক্রেটিক প্রভাবিত অঞ্চলের। অভিশংসন প্রশ্নে ট্রাম্পের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট সম্ভবত আগামী নির্বাচনে তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি অবশ্য বলে আসছেন, অভিশংসন প্রশ্নে নির্বাচনী বিবেচনা দ্বারা তাঁরা প্রভাবিত হবেন না। এটি শাসনতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্ন। ট্রাম্প রাজা নন, যা খুশি করার বা নিজের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য হোয়াইট হাউসকে ব্যবহার করতে তিনি পারেন না।

এ প্রশ্নে কংগ্রেস এ মাসেই তার সিদ্ধান্ত নেবে। এই সিদ্ধান্তের ওপর কেবল ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ নয়, কংগ্রেসের উভয় কক্ষের ওপর কার কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, সে প্রশ্নেরও সমাধান হবে।