মেঝ মামা

আমার মেঝ মামা একদম ভিন্ন মেজাজের মানুষ, দেখতে সুদর্শন ছিলেন বেশ। এত পরিপাটি ছিলেন, কখনো শার্টে একটা ভাঁজ দেখিনি। প্রচণ্ড শৌখিন একজন মানুষ। সব ঠিক ছিল। কিন্তু কেন জানি আমাদের সঙ্গে কথা খুব কম বলতেন। পুরোপুরি গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষ, তাও বলা যাবে না।
মেঝ মামা আমাদের কাছে এক বিস্ময়। খুব আস্তে কথা বলতেন। আমি কখনো তাকে জোরে কথা বলতে শুনিনি। অথচ বাড়ির বড়-ছোট সবাই তার নামে এমন ভয় পেত যে, প্রচণ্ড রোদে সে যদি বলত আজ ঠান্ডা, সবাই হয়তো শীত শীত মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতো।
মানুষের জন্য কিনা তিনি করতেন। পকেটে যদি ১০ হাজার টাকা থাকে, নিজের জন্য ১০ টাকা খরচ করতেন কিনা সন্দেহ আছে। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলেই যেন খুশি। উনি ইসলামপুরে ব্যবসা করতেন। সকালে যেতেন, রাতে আসতেন।
আমাদের বাসা ছিল আজব এক বাসা। সব বাসায় সন্ধ্যার পর সবাই পড়াশোনা করতে বসে, আর আমাদের বাসায় সব আড্ডা মারতে বসে বা ক্যারমবোর্ড খেলে। হোটেল থেকে নাশতা বা বাসায় বানানো খাবার থাকত প্রতিদিন। রাত দশটায় সবাই ঘুমাতে যায়, আর আমার বাসায় তখন যে যার রুমে পড়তে বসে। মেঝমামা আমাদের বাসায় আসার পর থেকে আড্ডার সময়সীমাও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। রাত দশটায় সমাপ্তি। দশটা বাজে যে যার রুমে যাওয়ার আরেক অন্যতম কারণ মেঝ মামা।
মেঝ মামা প্রতিদিন প্রায় রাত দশটার দিকে বাসায় আসেন। ওই সময় থেকে পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত আমাদের বাসায় কারফিউ চলত। ওনার কিছু মজার সংকেত ছিল। ঘুম থেকে উঠে একটা কাশি দিতেন, বাড়ির সবাই বুঝে যেতেন কারফিউ শুরু। তার সামনে পড়ার ভয়ে কেউ রুম থেকে খুব দরকার না হলে বের হতেন না। তার দ্বিতীয় কাশি ছিল উনি ওয়াশ রুমে যাবেন, মোটামুটি তার রুম থেকে বাথরুম পর্যন্ত রাস্তায় কেউ তখন থাকত না। আর তৃতীয় কাশির অর্থ হল নাশতার জন্য তিনি তৈরি।
আমার মা অসম্ভব ভালোবাসেন তার ভাইবোন সবাইকে। মেঝ মামাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তার এই দাদাকে কেন যে এত ভয় পেতেন, আল্লাহই জানে। ভয় মনে হয় সংক্রামক ধরনের রোগ।
আমার ধারণা, মায়ের ভয় থেকেই মেঝ মামার প্রতি সবার ভয় ভয় রোগটা জন্মেছিল। কয়েক বছর ছিলেন আমাদের বাসায়। তারপর চলে গেলেন অন্য মামাদের বাসায়।
মামা ছিলেন চিরকুমার। বিয়ে করেননি। একাই ছিল তার জীবন।
সেই মেঝ মামা, আমার বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর আবারও আমাদের বাসায় আসলেন। কারণ অত বড় বাসায় আমি আর মা ছাড়া তখন কেউ থাকত না। তখন সব ভাইবোন দেশের বাইরে থাকে। মেঝ মামা আসায় আমি আর মা বেশ খুশিই হয়েছিলাম। এখনো আগের মতোই চুপচাপ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার ভয় আগের চেয়ে কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের ভয় সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে তখনো বাচ্চা মেয়েদের মতো ভয় পেত। মামার সব রুটিন আগের মতোই ছিল।
আমাদের বাসায় আমার এক কাজিন বিদেশ থেকে বেড়াতে আসল। ভালোই লাগছিল। একসময় এত মানুষ বাস করত আমাদের বাসায়। সারাক্ষণ হই হই রই রই অবস্থা ছিল। এখন কেমন জানি বাসাটা নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা টেনে বসে থাকে। আমার যে কাজিন এসেছে বাসায়, ওর বয়স বেশি না। ও বাইরে থাকলেও ওর ইমনকে তার খুব পছন্দ। ইমন বাংলালিংকের মডেল। ইমনকে তার এতই পছন্দ যে, ও আসার কয়েকদিন পর আমার রুম বাংলালিংকের শোরুম মনে হচ্ছিল। ইমনের যত পোস্টার পেত, সব নিয়ে এসে দেয়ালে লাগিয়ে দিত।
রোজা শুরু হলো। রোজার মাসে এমনি কেন জানি ভয় লাগে, বাবা মারা গেছেন ওই রোজার মাসে, হয়তো সে জন্য। আমার কাজিন আজ মহাখুশি। চার রোজার দিন সে ইমনের সঙ্গে দেখা করতে যাবে রেডিও সেন্টারে। সঙ্গে নাকি আমাকেও যেতে হবে। ওকে এমনিও একা ছাড়ব না, তাই না বললেও আমি ওর সঙ্গে যেতাম।
তিন রোজা শেষ করলাম। মাঝ রাতে সাহরি খেলাম আমরা। মেজ মামাও আমাদের সঙ্গে খেলেন। সাহরি খেয়ে যে যার রুমে চলে আসলাম। আমার কাজিনের সেদিন চোখে ঘুম নেই। পরের দিন সকালে যাবে ইমনের সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের বাসায় সাহরি খাওয়ার পর পর সবার রুমে চা চলে আসে। চায়ের আমাদের ভীষণ নেশা। সেদিন মেজ মামাকে আমি চা দিয়ে আসলাম। আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করল রেখে যেতে। আমিও ভদ্র মেয়ের মতো টেবিলে রেখে চলে আসি। মা বসে কোরআন শরিফ পড়ছেন। আমি আমার কাজিন গল্প করছিলাম। আজান দিলে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমানোর পরিকল্পনা আমাদের।
হঠাৎ মায়ের এক চিৎকার কানে আসল। দেখি মায়ের কোরআন শরিফ পড়ে আছে, মা নেই। আবারও আরেকটা চিৎকার। খেয়াল করে শুনলাম, মেঝ মামার রুম থেকে আসছে। আমরা দৌড়ে ওই রুমে গেলাম। আমাকে দেখেই মা বলছে, দাদার বুকে অনেক ব্যথা করছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
আমি ওখানে আর না দাঁড়িয়ে নিচে নেমে দারোয়ানকে ডেকে ওঠালাম। ভোরের দিকে ড্রাইভারও যে যার বাসায়। দারোয়ানকে বললাম, একটা সিএনজি ডেকে নিয়ে এসো।
আমাদের বাসার কাছেই হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল। কোনো কিছু ভাবনায় আসল না আর। শুধু মনে হচ্ছে, ওখানে নিয়ে যেতে হবে। আমি মামার কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই বলছে, অনেক ব্যথা করছে বুকে। বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। সিএনজি আসলেই আমরা বের হয়ে যাব।
জানি না, কেন জানি মনটা উদাস হয়ে গেল। দুদিন আগে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের একটা প্রতিবেশী নতুন ঘর তুলেছে অনেক সুন্দর করে। নানি, মেঝ মামা সবাই ওই ঘরে বসে আম খাচ্ছে। আমি ওই বাসায় যেতে চাইলাম কিন্তু কেউ দরজা খুলে দিল না।
নিজেকেই নিজেই বুঝলাম, ওটা কিছু না, শুধুই স্বপ্ন। এর মধ্যে সিএনজি চলে আসল। আমি আমার কাজিন দুজন দুই পাশে ধরে মামাকে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। যাওয়ার সময় আমার সেজো মামাকে ফোন দিলাম হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিছুটা পথ যেতেই মামা বমি করলেন। বমি আসে পড়ল আমার হাতের ওপর। মেঝ মামা খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। আমি মামার হাত চেপে দিয়ে বললাম, চিন্তা করো না। আমি মুছে নিচ্ছি।
নিজেই নিজের কথা শুনে অবাক হলাম। মামাকে আমি সব সময় আপনি করে বলি। আজ তাকে তুমি করে কথা বলেই যাচ্ছি। চিন্তার সমাপ্তি হওয়ার আগেই হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। মেঝ মামাকে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হলো। ডাক্তাররা তাকে আইসিউতে নিয়ে গেল। পাঁচ নম্বর বেডে।
আমিও মেজ মামার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলাম। মেঝ মামা আমার হাত ধরে বললেন, বুকে অনেক ব্যথা। হাতটা বেশ গরম। বুকে হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম, এখন আর চিন্তা নেই, হাসপাতালে চলে এসেছি সব ঠিক হয়ে যাবে। খুব অসহায় লাগছিল।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তাররা এসে আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলল। তারা রোগীকে দেখবে। আমি বের হয়ে দেখি সেজ মামা চলে এসেছেন। মা, মামি সবাই এক এক করে চলে এসেছেন হাসপাতালে।
সবাই এমনভাবে কাঁদছে দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ মারা গেছে। একদিকে মেঝ মামা, অন্য দিকে তারা। তাদের কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না।
এদিকে আমার সেই চিন্তা, রাতে কে থাকবে? আমার কাজিনদের ফোন দিলাম। আমার মামির ভাইয়েরা একে একে সব আসতে শুরু করেছে। আমার মেজ মামার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকেও খবর দিলাম।
উনি আমার আরেক মামা। মেজ মামার কাজিন। মামার তেরো দিনের বড়। দুজন ছিল মানিক জোড়। এই দুই ভাইয়ের এত মিল! বন্ধুরতম ছিলেন দুজন। এই মামার ছেলে–মেয়েদের নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। শুধু এই পরিবারের সঙ্গে মামার ছিল অন্যরকম সম্পর্ক। তারা মামাকে চিনে ভিন্ন রকম মেজাজে। খুব গল্প করছেন, মুভি দেখছেন। হিন্দিতে গানও গাইছেন। আমি যেদিন প্রথম এই মেঝ মামাকে দেখলাম খুব অবাক হয়েছিলাম। এক মানুষ দুই মানুষের মতো হতে পারে ভাবতেই অবাক লাগত।
কিন্তু কখনোই জানতে পারিনি, এই হাসিখুশি মানুষটা আমাদের কাছে কেন সব সময় এত গম্ভীর হয়ে থাকতেন। অকারণে তাকে ভয় পাওয়াটা একটা কারণ হতে পারে। আমরাও ভয় পেতাম, মামাও আমাদের ভয় আর কখনো কাটায়নি। এরই মধ্যে আরেকবার আইসিউতে ঢুকলাম। ডাক্তাররা চিকিৎসা করছে। গিয়ে মামার হাতটা ধরলাম। মেঝ মামা বাচ্চাদের মতো আমার হাত শক্ত করে ধরলেন। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে দেখলাম। বললেন, বুকে অনেক ব্যথা। আমি চোখের পানি মুছে দিলাম আর বললাম, চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেঝ মামার চোখের জল মুছে দিলেও নিজের চোখের জল আটকাতে পারিনি সেদিন। সরে আসলাম মামার কাছে থেকে। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি অবস্থা? তারা বলল, আমরা দেখছি। আইসিউ থেকে বের হয়ে মাকে মিথ্যা বললাম। কান্নাকাটি থামাও, ডাক্তারদের সঙ্গে কথা হয়েছে আগের চাইতে ভালো। মা আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আরও জোরে কাঁদতে লাগল।
এতক্ষণে আমার সেজো খালাও চলে এসেছেন। মায়েদের ভাইবোনের মধ্যে অসম্ভব ভালো সম্পর্ক। ভালোবাসা ছিল একে অন্যের প্রতি অফুরন্ত। তিনজনই সোন তালে কাঁদতে শুরু করলেন। এদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল। বুঝতে পারলাম, ভুল জায়গায় মিথ্যা বলে ফেলেছি। আমার মা খুব ভালো বুঝে আমাকে। না চাইতেও মায়ের সঙ্গে রাগ করলাম। কঠিন গলায় বললাম, খুব বেশি কাঁদতে ইচ্ছে করলে বাসায় গিয়ে কাঁদো। আইসিউর সামনে বসে কাঁদবার কোনো দরকার নেই। অন্য মানুষও এখানে আছে।
উঠে মেঝ মামার কিছু ওষুধ লাগবে, সেগুলো আনতে গেলাম। পাশেই ফার্মেসি, ওখান থেকে ওষুধ আনার সময় লোকটাকে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা মলিন চেহারায়। ওরা মনে হয় সব সময় রোগীর সঙ্গে আসা আমার মতো লোকদের দেখে অভ্যস্ত। ওদের মুখে কোনো ভাষা থাকে না, কেবল নিঃশব্দ দুইটা চোখ তাকিয়ে থাকে। আমি নীরবে চোখের পানি মুছে যাচ্ছি।
হঠাৎ দেখি আমার ছোট খালা ফোন দিল। এত সকালে আমাকে কেউ সাধারণত ফোন দেয় না। কী অদ্ভুত! তাদের মেজদা অসুস্থ, সেটি কাউকে বলে দিতে হয়নি। বললাম, হ্যালো। খালার প্রথম প্রশ্ন সবাই ভালো আছিস? দ্বিতীয় প্রশ্ন কোথায় তুই?
বললাম হাসপাতালে, মিথ্যা বলতে ইচ্ছে হয়নি। সব সত্যিই বললাম। বাকি প্রশ্নগুলোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু কোনো প্রশ্ন শুনতে পেলাম না, শুধু কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বললাম, ফোন রাখো, দোয়া করো ঠিক হয়ে যাবে। ঘণ্টা কয়েক পর আবার ফোন দিল।
খুব শক্ত গলায় কথাগুলো বললেও চোখের পানি আটকে রাখা কষ্টের ছিল। হঠাৎ আইসিউর সামনে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ শুনতে পারলাম। এক মিনিটে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। পা ভারী হয়ে আসল, সামান্য পথটুকু যেতে পারছিলাম না। এক মুহূর্তে হাজার রকম বাজে চিন্তা মাথায় আসতে লাগল। আমি যখন এসে পৌঁছালাম, দেখি একজন অপরিচিত মহিলা আইসিউর সামনে দরজার সামনে চিৎকার করে কাঁদছে। পরে জানতে পারলাম, তার স্বামীকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে, অবস্থা খুব খারাপ। ওই রোগী ছিলেন এক নম্বর বেডে। তার সঙ্গে কোনো আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না। সঙ্গে ছিল পাঁচ বছরের একটা মেয়ে। মেয়েকে ধরে বিলাপ করেই যাচ্ছেন, তোর বাবার কিছু হলে আমাদের কী হবে। একটু একটু করে তার কাছে গিয়ে বসলাম।
খুব যত্ন করে ওই মহিলার হাত ধরে উঠতে অনুরোধ করলাম। সে কিছুতেই ওখান থেকে সরবে না। বললাম, আপনি এত জোরে কাঁদলে আপনার মেয়েটা ভয় পাবে। তা ছাড়া ডাক্তাররা রাগ করবেন, তারা আপনার স্বামীকে ঠিকমতো চিকিৎসা করতে পারবে না। আর যদি মনে করেন কাঁদলে উনি ভালো হয়ে যাবেন, তাহলে আরও বেশি চিৎকার করে কাঁদুন। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আমাকে তার পছন্দ হয়নি। মনে মনে হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু আমার তখন তাঁকে ওখানে বসে থাকতে দিতেও ইচ্ছে করছিল না। তার এত বড় বিপদে আজ পাশে কেউ নেই। যতটা পারলাম তাকে বুঝিয়ে চেয়ারে বসালাম। আইসিইউতে আমি ঢুকতে চাইলাম মামাকে দেখার জন্য। ডাক্তাররা সবাই এক নম্বর বেডের রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই যেতে পারিনি কাছে। দূর থেকেই দেখলাম, মামাকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছে। একজন ডাক্তার মনিটর করছেন। মনে হলো, এবারের মতো ঝড় থেমে গেছে। সারা বেলা পর একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগছে। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে।
আমাদের আত্মীয়স্বজন এরই মধ্যে হাসপাতালে আসছে। এক নম্বর বেড থেকে ডাক্তাররা এক এক করে সরে যাচ্ছে। এক নম্বর বেডের রোগীটি কিছুটা ভালোর দিকে। তার স্ত্রী একটু দূরে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। তার চোখে পানি নেই এখন। তবে দেখে মনে হচ্ছে, ভয় এখনো কাটেনি। আমি সেই ভাবনায় আছি, রাতে কে থাকবে মেঝ মামার সঙ্গে। কাজিনদের সঙ্গে কথা হলো। ওরা রাতে থাকবে জানাল। কিছুটা নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ হল। রাতের চিন্তা থেকে রেহাই পেলাম। মা, খালার কান্নাও কমেছে। সবকিছু একটা শান্ত গতিতে চলছে। হঠাৎ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছে। মনটা খারাপ হল, ভাবলাম এক নম্বর বেডের লোকটার অবস্থা আবারও মনে হয় খারাপ হল। বাচ্চাটার জন্য খারাপ লাগছিল। অল্প সময় হলো ঘুমিয়েছে।
মনটা বড্ড অশান্ত হতে লাগলে। অস্থিরতা ছেয়ে গেল মনে। কী মনে করে আবারও দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডাক্তাররা এক নম্বর বেডের সামনে কেউ নেই। চোখ পড়ল মেঝ মামার বেডে সবাই অস্থির হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে একজন এসে আমাকে কিছু ওষুধ আনতে বলল। আমি এক দৌড়ে ফার্মাসিতে চলে গেলাম। ওষুধ নিয়ে এসে দেখি, আমার মেঝ মামার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তাঁর কাজিন সেই মামাও এসেছে।
আমার সেই মামা কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে ভেতরে চলে গেলেন। মামি আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে। ব্রেইনে কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মামাকে দেখলাম, রুম থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তার দিকে চলে গেলেন। মামিও তার পেছনে পেছনে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।
কিছুই বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে। একজন এসে বলল, এগুলোর বিল পে করেন। সেজ মামা বিল দিতে চলে গেলেন আর আমাকে ভেতরে আসতে বললেন, যখন অনুমতি মিলল ভেতরে যাওয়ার। সবাই মনে হল আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। আস্তে আস্তে মামার বেডের সামনে গেলাম। একজন ডাক্তার ডিফিব্রিলেটর দিয়ে মামার হার্টবিট ঠিক করার চেষ্টা করে গেলেন। কিন্তু পাশের মনিটরে লম্বা একটা রেখার মতো একটা লাইন দেখতে পেলাম। সেখানে হৃদয়ের কোনো শব্দ শুনতে পাইনি।
আমি মামার হাতটা ধরলাম। হঠাৎ কান্না যেন গলার মধ্যে জমাট বেঁধে রইল। এত অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের গরম হাত ঠান্ডা হয়ে যায়! আমি বুকের ওপর হাত রাখলাম যেখানে ব্যথা ছিল। আমি মামাকে ভুল বলেছিলাম, চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। সারা গায়ে হাত বুলাচ্ছি কোথাও যদি এক বিন্দু শ্বাস লুকিয়ে থাকে। থর থর করে কাঁপছে আমার শরীর।
কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, কী বলব বাইরে গিয়ে। ওদের সামলাব কী করে। চোখমুখ মুছে বের হলাম। মাথায় তখন অনেক চিন্তা। মায়েদের বাসায় নিতে হবে। মেঝ মামাকে নিয়ে যেতে হবে। একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করা হলো। আমার এক কাজিনকে বললাম বাসায় যেতে, দারোয়ানকে বলতে বাড়ির সামনের জায়গাটা যেন ঝেড়ে পরিষ্কার করিয়ে রাখে।
আমি মাকে বললাম, বাসায় যাও। এখানে কষ্ট করে বসে থেকে কী হবে। রাতে আবার এসো। মা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। অনেকটা পেরেছিলামও, কিন্তু হঠাৎ মায়ের এক কাজিন এল, সে মারা যাওয়ার খবর শুনেই হাসপাতালে এসেছে। মায়েদের দেখেই কান্না শুরু করে দিলেন। ভাই তোকে এখনই চলে যেতে হবে। আমার মায়ের বুঝতে আর বাকি থাকল না। কেন আমি তাকে বাসায় পাঠাচ্ছিলাম।
এরই মধ্যে অনেক আত্মীয় চলে এসেছেন। মৃত্যুর খবর যেন বাতাসের মতো ছড়ায়। সবাইকে পাঠানো গেলেও মাকে কিছুতেই বাসায় পাঠানো গেল না। মা বাইরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মামার সঙ্গেই বাসায় যাবে।
সবকিছু ঠিক করার পর মামাকে যখন নিতে যাব, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটা কাগজ আমাকে দিয়ে বলল, এখানে লিখে সাইন করতে হবে। আমি লাশ বুঝে পেলাম। কিছুক্ষণ আগেও যিনি আমাকে ভর করে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলেন। আমার হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন।
আজ কেবল একটা লাশ!