এ কী ভাগ্যলিপি!

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় শাহেদের। চোখ বন্ধ করে বিছানার এ মাথা থেকে ও মাথায় কয়েকবার গড়াগড়ি করতে করতে, কখন ঘুমিয়েছিল সে কথা মনে করতেই ভেসে ওঠে গত রাতের কথা।
কার্তিকের সন্ধ্যা। বেলা ডুবতে না ডুবতেই পূর্বের আকাশে গোল থালার মতো মস্ত একটা চাঁদ! হিমেল হাওয়ায় নিস্তব্ধ গোধূলি! চারদিকে মন কেমন করা এক মায়া যেন ঝরে ঝরে পড়ে। বৃক্ষগুলো সুনসান নীরবতার ভেতরে চাঁদের আলোয় লুকোচুরি খেলছে। চাঁদের আলোয় মন ভাসিয়ে যেতে যেতে শাহেদের কবিতা লেখার কথা মনে হলো। মনে হলো কার্তিকের সকাল-সন্ধ্যা নিয়ে একটি মিষ্টি প্রেমের কবিতা সে লিখবে। প্রেমের কথা মনে হতেই শাহেদের ঠোঁটের কোণে এক ঝলক হাসি খেলা করে গেল। দেখা গেল একটি নারী মূর্তি চাঁদের আলোয় লুকোচুরি খেলছে। শাহেদ নিজেকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা এটা কি সময় হলো আগমনের? দেখাই যদি হবে তবে বছর কয়েক আগে হলে কী এমন ক্ষতি হতো? কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা শ্মশ্রুর ভেতরে হাত ঘষতে ঘষতে দ্রুত চলে যাওয়া সময়ের কথাই ভাবে সে। ভাবনার ভেতরে ভেসে ওঠে সেই নারী মুখ। সে জীবনে না এলে কার্তিকের এই সন্ধ্যা কি এত মনোমুগ্ধকর হতো? এমনি চাঁদের আলোয় কি মন ভিজিয়ে যেত উর্বর নিসর্গ? এই লতা-গুল্ম-বৃক্ষ কি এমনিভাবে দোলপূর্ণিমার মতো দোলা দিত ওর মনে? ঘরে ঢুকেই শাহেদ ভাবে আজ যেমন করেই হোক বিথিকে জানাবে মনের কথাটি। কত দিন কতবার বলবে বলবে করেও হয়নি বলা। বয়স বেশি হলে বোধ হয় অনেক কথাই আর সহজে যায় না বলা। এক ধরনের সীমাবদ্ধতায় পেয়ে বসে। আবছায়া জীবনের কথাগুলো কুয়াশার জালের ভেতরে ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকে, কিন্তু পায় না কোনো ভাষা। আজও তেমনি শত চেষ্টাতেও পারেনি সে কোনো কিছু বলতে। অক্ষম না বলা কথাগুলো ভাষা খুঁজে খুঁজে এক সময় যখন ক্লান্ত হয়ে শূন্যে মিলায়, তখনই শাহেদের ভেতর-বাহির বিষাদে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিষণ্নতায় বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একসময় সে লং ড্রাইভে যেত। আর আজকাল ওকে লং স্লিপে পেয়ে বসে। রাতের খাবার না খেয়েই আজও ঘুমিয়েছিল সে অন্য রাতের মতো।
রাতে খাওয়া হয়নি ভাবতেই খিদে আরও চাঙা হলো। এমন সময় ফজরের আজান পড়ল মাইকে। এই সময়টা শাহেদের খুব প্রিয়। চারদিকে এক সঙ্গে আজানের ধ্বনিতে মনে হয় প্রকৃতি যেন পুণ্যভূমি হয়ে ওঠে। চুপচাপ শুয়ে শুয়ে আজান শোনে সে। ভাবে নামাজে যাওয়ার কথা, প্রাতর্ভ্রমণে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো কিছুই আজ আর করতে ওর মন সায় দেয় না।
আজান অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো প্রবেশ করেছে ঘরে। বাইরে পাখ-পাখালির কিচিরমিচির। বিছানায় আড়মোড়া দিতে দিতে ওর মনে হলো পাখির ভাষা যদি যেত জানা, খুব ভালো হতো তবে। যেভাবে ক্লান্তিহীন ডেকে ডেকে যায়, কী বলে পাখি অমন নিরবচ্ছিন্নভাবে! মনে মনে ভাবল, পরজনমে সৃষ্টিকর্তার কাছে পাখির ভাষা জানার জন্য সে বর চাইবে! স্রষ্টার কথা মনে হতেই আবারও নামাজের কথা মনে হলো। তাড়াতাড়ি নামাজ শেষে যখন সে ঘরের বাইরে তখন পূর্বের আকাশে লাল সূর্য উঠি উঠি করছে।
ভোরের সকাল শাহেদের খুব প্রিয়। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ এখন পিচঢালা। চারদিকে সবুজের সমারোহ, কার্তিকের ধান খেত, তার ওপরে কুয়াশার সাদা সাদা ধূম্রজাল, ঘুঘু পাখির একটানা ডাকাডাকি শুনতে শুনতে বট বৃক্ষের তলে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। হাজারো রকমের পাখি বসেছে বিশাল বৃক্ষের ডালে ডালে। অসংখ্য পাখির কুজনে মনটা আবারও আনমনা হলো, বিথির কথা মনে হলো আবারও। পাখি ভীষণ প্রিয় বিথির। কোকিল ওর তত প্রিয় নয়, যতটা শালিক। শালিকের হলুদ ঠোঁট আর বক পাখির সাদা ডানা বিথির খুব প্রিয়। গতকাল সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে একটি কবিতা মনে মনে সাজিয়েছিল শাহেদ। প্রাণপণ মনে করার চেষ্টা করেও কিছুই এল না মাথায়। একটানা লম্বা একটি গাঢ় ঘুম ছাড়া ওর আর কোনো কিছুই নেই মাথায়।
ঘন কুয়াশা থাকায় চারিধার এখনো বেশ অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট প্রকৃতির কুয়াশার ধূম্রজাল কেটে কেটে সামনে এগোতেই দেখে অনেক মানুষের জটলা। এত ভোরে এত মানুষের জটলা কেন? কৌতূহলী মন নিয়ে সেই দিকে দ্রুত পা চালাল শাহেদ। কাছে যেতেই কান্নার আওয়াজ কানে এল ওর। ভাবল নিশ্চয় কোনো দুঃসংবাদ। মনটা টনটন করে উঠল। কাছে আসতেই দেখে বিমল কাকা মাথায় হাত দিয়ে হতভম্বের মতো বসে, আর পাশে তাঁর স্ত্রী প্রভা রানি বিলাপ করে করে কান্না করছেন। শাহেদের গ্রামেরই মানুষ সব, তবু এই কুয়াশা ভেজা সকালে সবাইকে ভীষণ শোকার্ত দেখাচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে ধীর পায়ে বিমল কাকার কাছে এসে কাঁধে হাত রাখে শাহেদ। বিমল কাকা মাথা তুলে একবার ওকে দেখে আবারও মাথা নিচু করেন। একটু সময় নিয়ে শাহেদ আবারও জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বিমল কাকা? কাকা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবারে শাহেদকে কাছে পেয়ে তিনিও উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলেন। কাকা কিছুটা শান্ত হলে সে আবারও জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে কাকা? আপনি কাঁদছেন কেন? বিমল কাকা তেমনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার মেয়ে স্বপ্না আর বেঁচে নেই বাবা!
—কেন? কী হয়েছে স্বপ্নার?
স্বপ্না বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে বাবা!
হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগল বুকের ভেতরে। কোনো রকমে সামলে নিয়ে বললাম, বলেন কী? বিষ খাবে কেন? ওর তো ভালো ঘরেই বিয়ে হয়েছিল!
চোখের জল মুছতে মুছতে কাকা বললেন, সেই ভালো ঘরই তো আজ বিষের শিশি হলো বাবা! শাহেদের বুকটা আবারও মোচড় দিয়ে উঠল। কেমন যেন শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ওর। আমাকে বলুন না কাকা, স্বপ্নার কী হয়েছিল?
বিমল কাকা কুয়াশা ঘেরা মাঠের দিকে উদাস তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলেন, স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে সোনার সংসার ছিল স্বপ্নার। ওদের একটা ফুটফুটে মেয়েও আছে, কিন্তু স্বপ্নার স্বামী ছিল বদমেজাজি। কোনো কারণ ছাড়াই এবং স্বপ্নার বিরোধিতা সত্ত্বেও একদিন ছেলেটি ওর বাবা-মাকে আলাদা করে দিল। এতে ভীষণ দুঃখ পেল স্বপ্না। জীবনে দারুণ একটা চোট পেলেও বদমেজাজি স্বামীর ভয়ে মুখ ফুটে কোনো দিন কিছু বলেনি।
খুব জেদি মেয়ে ছিল স্বপ্না। কষ্টের কথা আমাদেরও তেমন কিছু বলত না। স্বামীর অত্যাচারের ভয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে স্বপ্না দিন-রাত পরিশ্রম করত। পৃথক হলেও ওরা একই বাড়িতে আলাদা আলাদা ঘরে বসবাস করত। একই আঙিনায় পৃথক পৃথক রান্না ঘর। তারপরও মেয়ে আমার স্বামীর মন রক্ষা করে চলত, মনে কষ্ট থাকলেও মেয়ে আমার কোনো দিন আমাদের কিছু বলেনি। বলেই কাকা একটু থামলেন।
তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর?
বিমল কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, গতকাল দুপুরে স্বপ্নার শ্বশুর স্বপ্নাকে না জানিয়ে স্বপ্নাদের ভাতের মাড় নিজের গরুকে খাওয়াতে দেখে মেয়ে আমার ভয়ে ভয়ে শ্বশুরকে বলে, আপনি কী করলেন বাবা! আপনার ছেলে কাজ থেকে এসে ভাতের মাড় না পেলে আমাকে তো মারধর করবে, আপনি তো আপনার ছেলেকে খুব ভালো করেই জানেন বাবা।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কাকা আবারও থামলেন।
আমি কৌতূহলী হয়ে আবারও জানতে চাইলাম, তারপর?
কাকা একটু ভেবে বললেন, আমার মেয়ে একটু রাগ করে শ্বশুরকে শুধু বলেছিল, আমি একটু ভালো থাকতে চাই, সেটাও আপনারা চান না।
ব্যস, এটুকুই বাবা।
দুপুরে আমার মেয়ের জামাই কাজ শেষে ঘরে ফিরে দেখে, মা-বাবা জোরে জোরে কান্না করছেন। জামাই কারণ জানতে চাইলে, তাঁরা আরও জোরে কান্না করতে করতে স্বপ্নার শাশুড়ি বলেন, আজ আমাদের মৃত্যু হলেই ভালো ছিল বাবা। ছি ছি ছি, একটু ভাতের মাড়ের জন্য স্বপ্না আজ এভাবে আমার স্বামীকে অপমান করল। কোনো বউ কি কখনো তার শ্বশুরকে এভাবে বলে?
স্বপ্নার স্বামী আমার মেয়ের কাছ থেকে কোনো কিছু না শুনেই, ওর মায়ের কথায় বিশ্বাস করে সবার সামনে আমার আদরের পাখিকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বেদম প্রহারে জর্জরিত করল!
প্রাণের জাদুপাখি আমার সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে আমাদের চিরদিনের জন্য শূন্য করে চলে গেল রে বাবা! আমি এখন কী নিয়ে বাঁচি বলো দিকি বাপু! বলেই কাকাবাবু আবারও কান্না শুরু করলেন। ওপাশে প্রভা রানি তখনো হাত-পা রাস্তায় ছড়িয়ে বিলাপ করছেন! পাড়ার অনেক মেয়ে তাঁকে গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে।
মৃত্যুর কোনো সান্ত্বনা হয় না জানি। আর এ রকম মৃত্যুতে আরও তেমন কিছুই যায় না বলা।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দুটি মানুষের হৃদয় বিদারক কান্না শুনলাম। এরই মধ্যে গাঁয়ের আরও অনেক মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছেন। পুরো গ্রামটিতে তখন যেন এক শোকের মাতম!
দেখতে পাচ্ছি কুয়াশার জালে আটকে যাচ্ছে গভীর কান্না। হিমেল হাওয়ায় নড়ছে প্রভা রানির মাথার চুল! আর ক্রন্দনরত সিঁথির সিঁদুর!
মনে হয় আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, উনুনে টগবগ করে ফুটছে ভাতের পাতিল, সেই পাতিল ভর্তি ভাতের ফেনার ওপরে এক মারাত্মক বিষধর সাপ ক্রমাগত দংশন করছে স্বপ্নার আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে।
চৌরাস্তার মোড়ের সেই প্রকাণ্ড বট গাছে এখন আর একটিও পাখি নেই। কিচিরমিচির নেই! প্রভা রানির হৃদয় ভাঙা বিলাপে উড়ে গেছে পাখি।
শাহেদের মনে হলো পুরো গ্রামটি এখন যেন পাখিশূন্য! গভীর শ্বাস নিতে নিতে শাহেদ বিড়বিড় করে বলতে লাগল—ভাতের মাড়ের জন্য হারাল স্বপ্নার স্বপ্ন জীবন
ভাতের মাড়ের ভেতরে দেখি এ কী ভাগ্য লিখন!