সিঙ্গেল মাদার

অ্যালিসন কাজ শেষে যখন বাসায় ফিরে যখন মেয়ে নিকোলকে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় লিভিং রুমে সোফার ওপর দেখতে পেল, তখন সে একটু অকওয়ার্ড ফিল করল। কাউকে কিছু না বলে সে সোজা হেঁটে চলে গেল ডাইনিং এরিয়াতে। কাঁধ থেকে ব্যাগটি টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে গেল কিচেনে। ইলেকট্রিক ক্যাটলিতে পানি গরম দিল কফি বানানোর জন্য। যদিও কাজ থেকে ফিরে সে কফি খায় না। কিন্তু মেয়েকে ইন্টিমেট অবস্থায় দেখে ব্যাপারটাকে সে সহজভাবে নিতে পারছিল না। সে মনে মনে ভাবছিল, এসব কী হতে যাচ্ছে। যদিও আমেরিকার সমাজে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
নিজের অজান্তেই কখন যে ক্যাটলির পানি গরম হয়ে গেল; টেরও পাইনি। বড় একটা কফির মগে ব্ল্যাক কফির মধ্যে হালকা একটু চিনি দিয়ে নাড়তে থাকে। কফি নিয়ে বসে কিচেন আইল্যান্ডের চেয়ারে। ঠিক তখন তার মনের জানালায় ভেসে উঠল আজ থেকে প্রায় ষোলো বছর আগের কথা।
অ্যালিসনের প্রথম প্রেম; হাইস্কুল ‘সুইটহার্ট’ মাইকের কথা। সেই হাইস্কুল ‘প্রম নাইট’-এর কথা; মাইকের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোর কথা, অ্যালিসন কখনো ভুলতে পারবে না। সেই রাত, সেই মুহূর্ত; দুজনই ছিল অষ্টাদশ বর্ষীয় প্রাণবন্ত তরুণ-তরুণী। সেই রাতের পরও তারা অনেক ডেট-এ গিয়েছিল। ক্রমে তারা পরস্পরের ভালোবাসায় এতটাই মগ্ন হয় যে, একা দিন কাটে না, রাত কাটে না দশা। খুবই দ্রুতই সেই তরুণ-তরুণী ঠিক করে, বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে একসঙ্গে বাসা নিয়ে লিভ টুগেদার করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নতুন বাসা নিয়ে সেখানে উঠে পড়ল তারা। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন।
নতুন বাসায় ওঠার এক মাসের মধ্যে অ্যালিসন জানতে পারে যে, সে প্রেগন্যান্ট। দুজনের কারওরই এ খবরের জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না। মাত্রই জীবনটা শুরু করেছিল অ্যালিসন। নতুন বাসার কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েট্রেস হিসেবে চাকরি করত। আর মাইক তখন কাছেই একটি গাড়ির দোকানে মেকানিকের কাজ করত। দুজনের স্বল্প আয়ে তাদের এক রুমের বাসা ভাড়া, খাওয়াসহ অন্য খরচগুলো চলে যেত। সেই মুহূর্তে প্রেগনেন্সির খবর শুনে অনেক চিন্তায় পড়ে যায় দুজন। কারণ, একটি সন্তানের জন্য আর্থিক বা মানসিক কোনো প্রস্তুতিই তাদের ছিল না। ওই সময় মাইক অ্যালিসনকে অ্যাবরশনের কথা বলে। অ্যালিসন মনেপ্রাণে মাইককে গভীরভাবে ভালোবাসত। নিজের ভেতরে সে ধারণ করেছে মাইকের সন্তান, যার প্রতি তার ভালোবাসা শুরু হয়ে গেছে। এমন মুহূর্তে ভালোবাসার সেই বাচ্চা মেরে ফেলার কথা সে ভাবতেই পারে না।
শুরু হয় তর্ক। মনোমালিন্য হয়, আবার ভালোবাসার জোরে তা ঠিকও হয়ে যায়। এভাবে দিন যায়, মাস যায়। রেস্টুরেন্টের কাজ ছাড়ে না অ্যালিসন। কাজ ছাড়লে তো সংসার চলবে না। এদিকে মাইক অনেক চেষ্টা করে অ্যালিসনকে বোঝাতে। বাচ্চা হওয়ার পর তাকে অন্তত অ্যাডপশনে দেওয়ার কথা বলে। বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে কোনো ভালো পরিবারে বাচ্চাকে অ্যাডপশনে দেওয়া যায়। কিন্তু এই অপশনেও রাজি হচ্ছে না অ্যালিসন। তাকে কোনো কিছুতেই রাজি করাতে পারছে না মাইক। আরেকটা গ্রীষ্ম আসার আগেই নিকোলের জন্ম হয়। মাইকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জন্ম হয় নিকোলের। টানাটানির সংসার। বাচ্চা হওয়ায় অ্যালিসনের পক্ষে কিছুদিন কাজ করা সম্ভব হয় না। মাইকের একার আয়ে সংসার চালানোও কষ্টকর। এসব নিয়ে দুজনে ঝগড়া চলে। অ্যালিসন স্থানীয় কল্যাণ সংস্থা থেকে বাচ্চার খাওয়া, চিকিৎসাবাবদ সুবিধা নিতে শুরু করে।
এদিকে মাইক আরও উচ্চশিক্ষা অর্জনে অস্থির হয়ে ওঠে। তার স্বপ্ন ছিল অন্তত কলেজ গ্র্যাজুয়েশন করে একটা ভালো চাকরি করা। কিন্তু হাইস্কুলের সেই ভুল, গভীর প্রেমে পড়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এখন সন্তানের বাবা—সব মিলিয়ে মাইকের জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। একা একা বেশ কিছুদিন চেষ্টা করছিল কলেজে ভর্তি হতে। ফল সেমিস্টার কলেজে ভর্তির পরিকল্পনা করছিল সে। এদিকে অভাব-অনটনে দুজনের মধ্যে ঝগড়া বাড়তেই থাকে। বিভিন্ন কলেজে আবেদন করতে করতে একসময় অন্য এক অঙ্গরাজ্যে পূর্ণ বৃত্তিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যায় মাইক। এত বড় সুযোগ সে হারাতে চায় না। চলে যায়।
তিন মাসের ছোট্ট নিকোলকে নিয়ে একা হয়ে পড়ে অ্যালিসন। শুরু হয় তার নতুন সংগ্রাম। নিকোলকে ডেকেয়ারে দিয়ে অ্যালিসন আবার কাজ শুরু করে আগের সেই রেস্টুরেন্টে। কিন্তু এ দিয়েও একার পক্ষে বাসা ভাড়া চালানো কষ্টকর। ঠিক সেই মুহূর্তে এমিলি নামের এক নতুন সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এমিলি এই শহরের নতুন এসেছে এবং বাসা খুঁজছিল। অ্যালিসন তাকে বিস্তারিত বলার পর এমিলি বাসা শেয়ারে রাজি হয়। ঠিক তখন শুরু হয় অ্যালিসনের জীবনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাস্তব জীবন যে কত কঠিন, সে তখন হাড়ে হাড়ে টের পায়। এভাবে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। এভাবে নিকোলের বয়স পাঁচ বছর হয়ে যায়। নিকোল এবার কিন্ডারগার্টেন শুরু করবে।
অ্যালিসন ভাবল যেহেতু নিকোল স্কুল শুরু করেছে, তারও একটু পড়াশোনা করা দরকার একটা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। কারণ, রেস্টুরেন্টের কাজ দিয়ে সংসার চালাতে খুব সমস্যা হয়। তখন সে সিঙ্গেল মাদারদের জন্য থাকা শিক্ষাবৃত্তির আবেদন করল; পেয়েও গেল। ভর্তি হলো বাসার কাছেই এক কমিউনিটি কলেজের নার্সিং কোর্সে। চলতে থাকে পড়াশোনা। বাচ্চা, চাকরি ইত্যাদি সামলে দুই বছরের কোর্স শেষ করতে তার পাঁচ বছর লেগে যায়। নার্সিং সনদ পেয়ে কাছেই এক হাসপাতালে চাকরি নেয়। সচ্ছলতা এল সংসারে। নিকোলকে নিয়ে দুই বেডরুমের একটা বাসা ভাড়া নেয়; গাড়িও কেনে ছোট একটা। রুমমেট এমিলিও বয়ফ্রেন্ডসহ নতুন বাসায় চলে যায়।
অ্যালিসনের জীবনের দশটা বছর কীভাবে কেটেছে, সে বলতেও পারবে না। একা একা বাচ্চা বড় করেছে, অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, সহায়ক বলতে ছিল শুধু এমিলি। আপন বোনের মতো সাহায্য করেছে এমিলি। দশ বছরে এমিলির সঙ্গে অনেক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে অ্যালিসনের।
জীবনে সচ্ছলতা আসায় নিকোলকে ‘কোয়ালিটি টাইম’ দিতে শুরু করে অ্যালিসন। নিকোলকে মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক বেড়াতে নিয়ে যায়। খেতে যায় রেস্টুরেন্টে। শখের কেনাকাটাও চলে। এভাবে চলে যায় আরও কয়েক বছর। সেটল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু সঞ্চয়ও করে। সে একটা টাউনহাউস কিনে ফেলে একসময়। আজ সে অনেক সুখী। ভালো চাকরি আছে, আছে বাড়ি-গাড়ি—বলতে গেলে সব। একার চেষ্টাতেই সে সবকিছু করেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার বয়স এখন হয়েছে চৌত্রিশের কোঠায়। সেই ছোট্ট নিকোল এখন ষোলো বছরের। অ্যালিসনের জীবনেও নতুন মানুষ এসেছে। নিজেরই সহকর্মী এক পুরুষ নার্সের সঙ্গে ডেট শুরু করে সে। মাইক চলে যাওয়ার পর জীবনযুদ্ধে কীভাবে যে ষোলোটি বছর পেরিয়ে গেছে, টেরই পায়নি অ্যালিসন।
এমন নয় যে, অন্য কোনো পুরুষ তার জীবনে আসতে চায়নি। কিন্তু অ্যালিসন কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনি। জীবনের প্রায় সব চাহিদা পূরণের পর এখন হাঁপিয়ে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে, এখন সঙ্গী দরকার, অন্তত সুখ-দুঃখ শেয়ারের জন্য হলেও। এই ভাবনা থেকেই সহকর্মী নিককে জায়গা দেয় সে। নিক খুবই নম্র ধরনের ছেলে। কয়েক সপ্তাহ আলাপের পর গত রাতে সে ছিল নিকের সঙ্গে। সে টের পায়, নিক তার প্রশংসা করলে খুব মধুর লাগে। হ্যান্ডসাম দেখতে নিকের প্রেমে পড়ে অ্যালিসন। এই বয়সে এসে নিকের প্রেম যেন তাকে আবার জাগিয়ে তুলছে। নারীর জীবনে একজন পুরুষের ছোঁয়া কতটা জরুরি, তা অ্যালিসন গভীরভাবে অনুভব করতে শুরু করে। জীবনের এই সময়ে মনের মতো কাউকে পেয়ে সে সুখী বোধ করে। মন-প্রাণ দিয়ে সে নিককে ভালোবাসতে শুরু করে।
সঙ্গী যখন সব ধরনের চাহিদা নিখুঁতভাবে পূরণ করে, তখন নারীর আর কিছু চাওয়ার থাকে না। অ্যালিসন নিককে বাসায় আমন্ত্রণ জানায় মেয়ে নিকোলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। নিকোলকে সে আগেই নিকের বিষয়ে সব বলেছে। মাকে সুখী দেখে নিকোলও অনেক আনন্দিত। অ্যালিসন নিককে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। তার চেয়েও বড় কথা পুরুষ নিয়ে অ্যালিসনের ভয়টি আর নেই। কারণ, সে নিজে এখন প্রতিষ্ঠিত।
তাই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অ্যালিসন অনেক সুখী ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার মেয়ে নিকোলকে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে তার বুকের ভেতরটা প্রচণ্ড ব্যথায় মুষড়ে ওঠে। নিজের করা ভুল তাকে ভীত করছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই কিচেন থেকে সে চলে গেল বেডরুমে। কাঁদল কিছুক্ষণ। এদিকে নিক বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। অ্যালিসন ধরেনি। উদ্বিগ্ন নিক চলে এল বাসায়।
দরজা খুলে নিককে দেখেই কেঁদে ফেলে অ্যালিসন। নিক জড়িয়ে ধরে তাকে। জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে তোমার?’ কাঁদতে কাঁদতেই ঘটনাটা বলল নিককে। বলে, ‘এটা আমাকে ভেতরে-ভেতরে মেরে ফেলছে। আমি কী করব? আমার মেয়েটা যদি আমার মতো কোনো ভুল করে বসে, তাহলে আমি বাঁচব না।’ তাকে জড়িয়ে ধরে নিক আদর করতে থাকে। তাকে ধীরে ধীরে বোঝাতে থাকে, ‘নিকোল ভালো স্টুডেন্ট, ভালো মেয়ে। সে নিশ্চয়ই কখনো উল্টাপাল্টা কিছু করবে না, যাতে ওর সমস্যা হয়। আমরা দুজনে মিলে ওকে সুন্দর করে বোঝাব। তুমি চিন্তা করো না।’
নিক রাতে অ্যালিসনের সঙ্গে থেকে যায়। সকালে উঠে নিক চলে যায় কাজে। যাওয়ার আগে সে অ্যালিসনের জন্য ‘ব্রেকফাস্ট ইন ব্যাড’ বানিয়ে যায়। ক্রোসেন্ট ও অরেঞ্জ জুসের সঙ্গে সেখানে ছিল একটা ফুল; আর একটা খুদে চিঠিও; ভালোবাসার। চিঠিতে লেখা ছিল—
‘My sweetheart don’t worry, we are going to talk to Nicole and everything will be fine.
I love you so much-Nick’
চিঠিটা দেখে অ্যালিসনের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। ঘুম থেকে উঠে ট্রেটা নিয়ে নিচে চলে এল। তারপর কফি তৈরির আয়োজন করল, মাথাটা ধরে আছে তার। সকাল দশটা তখন। অ্যালিসন একা। নিকোল স্কুলে, আর নিক তো কাজেই। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। কিচেন থেকে লিভিং রুমে আসতে আসতে জানালা দিয়ে দেখল ড্রাইভওয়েতে একটা বিএমডব্লিউ কে যেন পার্ক করেছে। মনে মনে ভাবল হঠাৎ করে এত বড়লোক কে এল আমার বাসায়? দরজা খুলে তো অ্যালিসন হতভম্ব। তার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছে। তার সামনে মাইক। তার হাইস্কুল সুইটহার্ট মাইক। নিকোলের বাবা মাইক, গত ষোলো বছরে যার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সে চুপচাপ, নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাইক মনে মনে ভাবছিল, অ্যালিসন হয়তো তাকে জড়িয়ে ধরবে এত দিন পরে দেখে। কিন্তু মাইক অ্যালিসনকে এত কষ্ট দিয়েছে যে, তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অ্যালিসন হারিয়ে ফেলেছে সেই কবে। এখন মাইকের জন্য তার কাছে কিছুই নেই; না ভালোবাসা, না কোনো ঘৃণা।
কথাবার্তা ছাড়াই দুজন এগিয়ে গেল লিভিং রুমের দিকে; দুজন দুই সোফাতে বসল। অ্যালিসন প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার এত দিন পর? না সরি এত বছর পর হঠাৎ কী মনে করে?’ মাইক খুবই নিচু কণ্ঠে বলল, ‘এক কাপ কফি খেতে খেতে না হয় কথা বলা যাক।’ সোফা থেকে উঠে তারা কিচেনের দিকে গেল। কিচেনে গিয়ে অ্যালিসন দুজনের কফি বানানোর প্রস্তুতি নিল। কিচেন আইল্যান্ডে মাইক দেখল অ্যালিসনের ব্রেকফাস্ট ট্রেটা, যেখানে রয়েছে নিকের লেখা সেই ‘লাভ নোট’। মাইক বুঝল। ধীরে স্বাভাবিক হয়ে সে অ্যালিসনকে দেখতে লাগল। কফিসহ ডাইনিং রুমে এসে দুজনে বসে কথা শুরু করল। অ্যালিসনের সেই প্রশ্ন, ‘তারপর বল, কী মনে করে আসা হলো?’ মাইক বলল, ‘গত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল। সে জন্য তোমাদের সঙ্গে দেখা করা খুব জরুরি মনে হলো।’ মুচকি হেসে অ্যালিসন বলল, ‘এ জন্য তোমার মাত্র ষোলো বছর সময় লাগল। ভালো তো। বলো, শুনি তোমার স্টোরি।’
মাইক শুরু করল তার গল্প—‘তোমাদেরকে ছেড়ে যাওয়ার পর কলেজ গ্র্যাজুয়েশন করে ভালো চাকরি নিলাম। একটা কিছু হওয়ার খুব তাগিদ ছিল আমার মধ্যে। কাউকে নিয়ে তখন ভাবিনি। পড়াশোনা শেষে একটা রিয়েল স্টেটের চাকরি শুরু করি। কঠোর পরিশ্রম করে ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে যাই। সেই কোম্পানির মালিক ছিল ধনী। তার ছিল কয়েকটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। একদিন কোম্পানির এক পার্টিতে তার একমাত্র মেয়ে সিনথিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। সিনথিয়া ছিল হাইলি এডুকেটেড। একটা লাও ফার্মে জব করে। পরিচয়ের পর ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বাড়তে থাকে। একদিন আমি তাদের বাসায় যাই। এক বিশাল প্রাসাদের মতো বাসা তাদের। অনেক বিলাসী জীবন সিনথিয়ার। তার গভীর প্রেমে পড়েছিলাম আমি। অনেক কিছু দেখতে পাইনি তখন। সিনথিয়া খুবই কর্তৃত্বপরায়ণ মেয়ে। খুব পার্টি পছন্দ করত।
‘বেশ কিছুদিন ডেট করার পর আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তার এসব সোশ্যাল গ্যাদারিং আমার ভালো লাগত না। চেয়েছিলাম ভালোবেসে কারও সঙ্গে সুখে জীবন যাপন করতে, যা সিনথিয়ার সঙ্গে হওয়ার নয়। সে এ ধরনের মেয়েই নয়। আমি যখন তাদের পার্টিগুলোতে অ্যাটেন্ড করতে চাইতাম না, তখন সিনথিয়ার সঙ্গে মনোমালিন্য হতো। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। সম্পর্কটা ছিল মাত্র তিন মাসের। ব্রেকআপে পর আমি নিজেকে অনেক নিঃসঙ্গ মনে হতে থাকে। তোমাদের কথা মনে পড়ে। এখন আমার সবকিছু আছে। নিজের একটা রিয়েল এস্টেট বিজনেস আছে। কিন্তু ভেতরের যে শান্তি চেয়েছি, সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না। তাই তোমাদের সঙ্গে একবার দেখা করাটা অনেক দরকার ছিল, শুধু এটুকু জানতে যে, তোমরা ভালো আছ কিনা।’
‘বাহ, দারুণ গল্প’, হালকা হেসে বলল অ্যালিসন। ‘যা হোক, আমি একাই আমার মেয়েকে মানুষ করেছি। তার এখন ষোলো বছর বয়স। সে টেন গ্রেডে পড়ে। যদি আমার রুমমেট এমিলির সঙ্গে পরিচয় না হতো, তাহলে মনে হয় না কিছু করতে পারতাম। দশ বছর এমিলির সঙ্গে একটা অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করেছি, যেখানে তুমি আমাকে তিন মাসের বাচ্চাসহ একা রেখে চলে গিয়েছিলে। কয়েক মাস আগে এই টাউনহাউসটা কিনেছি। কয়েক সপ্তাহ হলো কো-ওয়ার্কার নিকের সঙ্গে ডেট করছি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর, নিকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে জীবন যেন সুখ খুঁজে পেয়েছে, যা গত ষোলো বছর অনেক দূরে লুকিয়েছিল। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি ছেড়ে গিয়েছিলে বলেই, আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। সে জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি তোমার বিজনেস কার্ড রেখে যেতে পার। তোমার মেয়ে নিকোল এলে আমি তাকে কার্ডটা দেব। সে চাইলে তোমার সঙ্গে দেখা করবে; আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। তুমি আজ আসতে পার, ধন্যবাদ।’
সেদিন বিকেলে যখন নিকোল স্কুল থেকে ফিরল, অ্যালিসন তাকে ডেকে বলে, ‘আজ বাসায় একজন লোক এসেছিল। সে তার বিজনেস কার্ড রেখে গেছে। তুমি যদি চাও তার সঙ্গে দেখা করতে পার। লোকটার নাম মাইকেল স্মিথ, তোমার বাবা।’ মায়ের মুখে এসব কথা শুনে নিকোল দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। বলল, ‘স্যরি মামি, আমি গতকাল যে ভুল করেছি, তার জন্য আমি অনেক স্যরি। আমি জানি তুমি খুব দুঃখ পেয়েছ। তুমি বিশ্বাস কর এমন আর কখনো হবে না। প্লিজ আমাকে মাফ কর। আই লাভ ইউ সো মাচ। তুমি আমার জন্য কোনো চিন্তা কর না। আমি অনেক পড়াশোনা করব; ভালো চাকরি করব। জীবনে সেটেল হওয়ার আগে কারও সঙ্গে কোনো রিলেশনে জড়াতে চাই না।’
মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে অ্যালিসনের চোখে পানি টলমল করছিল। মেয়ে যে এত কিছু বোঝে, তার সেই ধারণা ছিল না। মেয়েরা সত্যিই অনেক কিছু বোঝে। মেয়ের মুখ থেকে এসব কথা শুনে শান্তিতে প্রাণ জুড়িয়ে গেল অ্যালিসনের। মনে মনে ভাবল, ‘আজ আমার ষোলো বছরের সাধনা সার্থক হয়েছে।’