একজন ছায়া শিক্ষকের গল্প

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম
সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সবচেয়ে মেধাবী বাঙালি কে? নোবেলের সমমানের বিশ্ব-স্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথের পর কোন বাঙালির পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি? প্রশ্নগুলো করেছিল লিটন; আমার বন্ধু। সালটা ১৯৭৪, পড়ি ক্লাস এইটে। লিটন তুখোড় মেধাবী, সিলেট সরকারি বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র। ক্লাসে কোনো বছর সেকেন্ড হয়নি আমার জানামতে। আমি পড়ি সিলেট এইডেড হাইস্কুলে; মাঝামাঝি মানের ছাত্র, মিডিওকার যাকে বলে। সব বিষয়েই আগ্রহ, কোনো বিষয়েই লিটনের মতো তুখোড় নই। লিটন ও আমি ভিন্ন স্কুলে পড়লেও একই পাড়ায় থাকি, দুজনই কিছুটা ইঁচড়ে পাকা। ভাইবোনেরা সবাই আমাদের থেকে বড় হওয়ায়, অনেক বাংলা ক্লাসিকস পড়া হয়ে গেছে খুব কম বয়েসে; কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে। লিটনও পরিবারের সবার ছোট; আমিও তাই। বড় ভাইবোনদের সবার সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল। আমরা দুজন বড়দের নিয়ে আসা বইগুলো গোগ্রাসে গিলে নিজেরা পণ্ডিতের মতো আলোচনায় মশগুল হতাম। লিটনের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকত আমাদের সমবয়সী লিটনের ভাগনে টনি, পোশাকি নাম হাফিজ ইবনে সিকান্দার। টনিও সরকারি বালক বিদ্যালয়ে পড়ত। মামা-ভাগনে বন্ধুর মতো। প্রখর মেধাবী টনি পড়ত আমদের এক ক্লাস নিচে। লিটন, টনি দুজনই ইয়ং অবজারভারে ছবি এঁকে পাঠাত। তাদের ছবি ছাপা হতো সেকালের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের ছোটদের পাতায়; আর আমি লিখতাম ‘খেলাঘর’, ‘কচিকাঁচার আসর’, ‘সাত ভাই চম্পা’, আর ‘চাঁদের হাট’-এর পাতায়। আমার যখন ছড়া, গল্প ছাপা হতো, বিশেষ করে ঢাকার পত্রিকায়, সেগুলো ওদের দেখাতাম। আমরা ক্ষুদ্র সমালোচকেরা লেখার ভালোমন্দ নিয়ে রীতিমতো গভীর আলোচনা করতাম।
ফিরে আসি আবার প্রথম প্রশ্নে। রবীন্দ্রনাথের পর সেরা মেধাবী কে? লিটনের একটা বড় সুবিধা ছিল—ওর বড় ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, পরে একই বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। লিটনের কাছ থেকে ওর ‘মঞ্জু ভাইয়ের’ সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের সরস আলোচনার হুবহু সারসংক্ষেপ আমি পেয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে আমিও মঞ্জু ভাইয়ের ভক্ত হয়ে গেলাম। যদিও মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হতো না। তিনি থাকতেন ঢাকায়। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং পরে পড়াতেন।
বিভিন্ন ছুটিতে যখন তিনি সিলেট আসতেন, তখন দূর থেকে দেখার সুযোগ পেতাম। আমাদের চেয়ে বছর দশেক বড় বলে কথা বলার সাহস হতো না। তারপরও তিনি হয়ে গেলেন আমারও ‘মঞ্জু ভাই’ এবং পরোক্ষ শিক্ষক। সেরা মেধাবী বিষয়ে লিটনকে বলেছিলাম, ‘তুই বল। নিশ্চয়ই মঞ্জু ভাই তোকে এ ব্যাপারে অনেক কথা বলেছেন।’ লিটন বলল, ‘মঞ্জু ভাইয়ের ধারণা সত্যজিৎ রায় হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে মেধাবী বাঙালি এবং তিনিই একদিন নোবেলের সমমানের স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন।’ আমার প্রবল আগ্রহ, কেন তিনি সবচেয়ে প্রতিভাবান? এ ব্যাপারে মঞ্জু ভাইয়ের বক্তব্য কী? লিটন বলে চলে, ‘তাঁর প্রতিভার সীমা নেই, তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, চিত্রনাট্য লেখেন, চলচ্চিত্রের জন্য অসাধারণ সংগীত রচনা করেন। তাঁর চলচ্চিত্র গতানুগতিক ধারার বাইরে, বিশ্বমানের যেকোনো পরিচালকের মতো। তিনি বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করেন। তাঁর আঁকা প্রচ্ছদ তো অসাধারণ। সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা গল্পের জুড়ি নেই। তাঁর ‘ফেলু দা’ তো বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন।’ আমি গালে হাত দিয়ে চুপ করে শুনি, আর বিস্মিত হই।
মজার ব্যাপার হলো, এ রকম সাহিত্য আলোচনা আমরা আমাদের সব বন্ধুদের সঙ্গে করতাম না। এগুলো ছিল লিটন, টনি ও আমার মধ্যে ‘টপ সিক্রেট’ আলোচনা। ওই বয়সের সঙ্গে মানানসই নয় বলে আমাদের অন্য বন্ধুরা এমন আলোচনায় আগ্রহ পেত না। এমন আলোচনার জন্য আমরা সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম শহর থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে, ঢেউখেলানো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে, আমার মতে পৃথিবীর ‘সবচেয়ে সুন্দর’ শহুরে পথ—সিলেট বিমানবন্দর রোডে। একপাশে লাক্কাতুরা চা বাগান, অন্যপাশে মালিনীছড়া। চা গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ছায়াবৃক্ষ, রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া, শিরীষ, আরও কত কত নাম না জানা গাছ! মালিনীছড়া চা বাগানের নাট-মন্দিরের পাশে একটি অনিন্দ্য সুন্দর মাঠ। সেই মাঠের কোণে আমাদের এমন আলোচনা চলত নিয়মিত। তখনও ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্র দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাস পড়া হয়ে গেছে। বাড়তি তথ্য জানা হয়ে গেছে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালি’-এর সার্থক চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন সত্যজিৎ রায় ১৯৫৫ সালে। উপন্যাসের সময়কাল ১৯২৮ সালের দিকে। বিভূতিভূষণ সেই সময়ের বাংলার প্রান্তিক মানুষের জীবন-সংগ্রামের এক অনন্য আখ্যান হাজির করেছেন। আর তাঁর উপন্যাস হৃদয়ে ধারণ করে সত্যজিৎ সেই প্রান্তিক মানুষদের হাজির করেন বিশ্বের দর্শকদের সামনে। রেলগাড়ি দেখার জন্য অপু-দুর্গার কাশবনের মধ্য দিয়ে ছুটে যাওয়া। রেলগাড়ির চলে যাওয়া দেখে কিশোর অপুর মনে অপার বিস্ময়। সেই বিস্ময় আমার কিশোর মনে অনুরণিত হয়। চোখ বুজে কখনো কখনো অপুর চেহারা আঁকি, কখনো নিজেকেই অপু মনে হয়। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে প্রকৃতির বর্ণনা, কখনোবা প্রকৃতিতে মানব মনের ভাবালুতার প্রতিফলন মনের ভেতরে ঘোর তৈরি করত। কখনো বা এমন উপস্থাপনা কিশোর বয়সে বুঝতে না পেরে যন্ত্রণায় বিরক্তির উদ্রেক হতো। পরে বুঝেছি, বাংলার প্রকৃতির এত নিখুঁত ছবি তাঁর মতো করে আর কেউ আঁকতে পারেননি। পথের পাঁচালি পরে অসংখ্যবার পড়েছি। প্রকৃতির বর্ণনার মধ্যে মানব মনের অসাধারণ প্রতিফলন, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পড়ে মোহিত না হয়ে উপায় ছিল না। সপ্তম পরিচ্ছদে (আম আঁটির ভেঁপু) প্রকৃতির সুনিপুণ বর্ণনা পড়ে মনে হয়েছে, বিশ্ব সাহিত্যে একমাত্র টমাস হার্ডি ছাড়া এর সমতুল্য বর্ণনা খুব কম ঔপন্যাসিকই দিতে পেরেছেন।
কিশোর বয়সে মনে অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় করত। লিটনকে বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করিস তো মঞ্জু ভাইকে বিভূতিভূষণ কেন নোবেল পাবেন না? এ কথাটি জানা হয়নি কখনো। বড় হয়ে যতটুকু বুঝেছি, নোবেল পেতে হলে অনেক কিছু করতে হতো বিভূতি বাবুকে। তাঁর একজন ইয়েটসের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিক বন্ধুর প্রয়োজন ছিল; পথের পাঁচালির সার্থক অনুবাদের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল আরও অনেক কিছুর। যিনি কাপড়ের মলিন বোঁচকায় তাঁর লেখার পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন, তাঁর পক্ষে কী এসব সম্ভব ছিল? তাই এমন প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিতই রয়ে গেল। তবে নিজেদের করা আলোচনা থেকেই আমার বিপুল আগ্রহ ও কৌতূহল বেড়ে গেল, সত্যজিৎ রায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের বিষয়ে। আমাদের ছোটবেলা, সিলেট শহরে প্রতিটি পাড়ায় এক-দুটি দোকান ছিল যেখান থেকে ভাড়ায় বই নিয়ে পড়া যেত; দিন হিসাবে ভাড়া। গোয়েন্দা গল্প মাসুদ রানা ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তারপর ছিল নীহার রঞ্জনের কিরীটী সিরিজ। এমন ‘বই ভাড়ার’ দোকানের মাধ্যমে বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিতা’, ‘আরণ্যক’, ‘আদর্শ হোটেল’, ‘অশনিসংকেত’ ইত্যাদি বই আমার পড়া হয়ে গেল। ওই বয়সে দুর্ভিক্ষে পীড়িত অনঙ্গ বউয়ের দুঃখে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা হয়েছে অনেক।
আমাদের সাহিত্য আলোচনা, বই পড়ার ক্ষুধা, মঞ্জু ভাইয়ের অনেক অনেক মূল্যবান মন্তব্য ও পরামর্শ জীবনকে, স্বপ্নকে, মানসিকতাকে কেমন জানি বদলে দিল। আমার কাছে সে এক অপার বিস্ময়। একটা মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা হতো না। বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর মূল্যবান পরামর্শ, তত্ত্ব, তথ্য জেনে মানুষ এত প্রভাবিত হতে পারে? আমার মনে হয় মঞ্জু ভাই, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম এখনো জানেন না, আমরা তাঁর প্রখর আলোয় কতটুকু প্রভাবিত হয়েছি। লিটন, যার পোশাকি নাম সৈয়দ কামরুল ইসলাম, তাকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, তুই কি বন্ধু আমাদের গোপন সাহিত্য আলোচনার কথা তোর মঞ্জু ভাইকে বলেছিস? মেধাবী লিটন আমেরিকার বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কম্পিউটার বিজ্ঞানের নামজাদা শিক্ষক। এই ভূ-গ্রামে তো আমরা খুব কাছাকাছি বাস করি। লিটনের সঙ্গে দেখা হবে নিশ্চয় ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোনখানে’। প্রশ্নটা তোলা থাকল ততক্ষণ পর্যন্ত। না হয় প্রশ্নটা না-ই করলাম। এই বিশ্বে অনেক কিছুই তো রহস্যাবৃত থাকে। এ প্রশ্নও অমীমাংসিত থাকুক। তবে প্রজ্ঞাবান কথাসাহিত্যিক, সফল ও নিবেদিত শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম থাকুন চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের মতো, আমার ছায়া শিক্ষক হয়ে, যিনি প্রখর সূর্যের মতো আলো ছড়ান বেবিলনের আলোর ফেরিওয়ালার মতো। এ লেখা ছাপা হলে তাঁর চোখে কি পড়বে? তিনি দেখলে আমার কাছে কিশোরবেলার লজ্জা ও ভয় মিশ্রিত একটা অনুভূতি হবে—এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।