আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে

প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত

আমার বাসার কাছে একটা ন্যাশনাল পার্ক আছে। ঠিক খুব কাছেও না। পাহাড়-বন ডিঙিয়ে পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে।

সেখানে একটা ছোট জলপ্রপাতও আছে। নাম লিটল রিভার ফলস—ছোট নদীর ঝরনা।

একবার ঘুরতে গিয়ে সেই ঝরনার খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। সেফটির জন্য সেখানে একটা বাউন্ডারি দেওয়া আছে। খেয়াল করিনি। হঠাৎ কোত্থেকে পার্কের নারী রেঞ্জার উদয় হলেন। দূর থেকে হয়তো গতিবিধি নজরে রাখছিলেন।

রেঞ্জার ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এই সীমার ভেতরে ঢোকা নিষেধ। বিপদ হতে পারে। চলো, তোমাকে এগিয়ে দিই।’

রেঞ্জারের সঙ্গে যেতে যেতে কথা বলছিলাম। ভদ্রমহিলা বেশ বয়স্ক। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি হবে। এই বয়সে ক্যানিয়ন পার্কের মতো দুর্গম জায়গায় রেঞ্জারের কাজ করছেন ভেবে খারাপই লাগল। আমি এই বয়সে পৌঁছালে রিটায়ার করে আরাম করে সারা দিন ঘুমাতাম।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে কত দিন ধরে কাজ করো?’

ভদ্রমহিলা হেসে জবাব দিলেন, ‘আমি এখানে কাজ করি না। আমি ভলান্টিয়ার।’

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। ইউনিফর্ম পরা ন্যাশনাল পার্কের রেঞ্জার, আবার ভলান্টিয়ার! ফেডারেল সরকারের কি টাকার অভাব? ভদ্রমহিলার জন্য আরও খারাপই লাগল। কাজ করেও পয়সা পাচ্ছেন না।

আমার মনে প্রশ্ন আন্দাজ করে ভদ্রমহিলা নিজেই বলা শুরু করলেন, ‘আমি রিটায়ার করেছি পাঁচ বছর হলো। আমার ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে গিয়েছে।’ এটুকু বলে পার্কের উলটা দিকে একটা পাহাড় দেখিয়ে বললেন, ‘আমি ওই পাহাড়ে থাকি। এই পার্ক সব সময় পর্যটকে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু এদের লোকবল নেই। তাই আমি এখানে সপ্তাহে তিন দিন ভলান্টিয়ার রেঞ্জার হিসেবে হেল্প করি।’

তারপর একটু থেমে বললেন, ‘দিস ইজ মাই নেইবারহুড। আই লাইক টু কিপ ইট ক্লিন।’

আমাকে সেই জলপ্রপাত এসে যেন ধাক্কা দিল। এই ভদ্রমহিলাকে আমি করুণার দৃষ্টিতে দেখেছিলাম। অথচ আমি নিজেই কত ক্ষুদ্র তাঁর কাছে। তাঁর কাছে ট্রাম্পের মতো লোকেরাও কত তুচ্ছ।

আমার কাছে আমেরিকা মানে এই রেঞ্জারের মতো মানবিক মানুষেরা। পথ চলতে তাঁদের দেখা আমি অসংখ্যবার পেয়েছি।

গত বছর এক হাসপাতালে যখন গিয়েছিলাম, তখন সেখানে দেখেছি ঝাঁকে ঝাঁকে ভলান্টিয়ার এই রেঞ্জারের মতো পেশেন্টদের হাসিমুখে সাহায্য করছেন। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখানে ভলান্টিয়ার কেন? বললেন, এই হাসপাতাল আমার জীবন বাঁচিয়েছে। তাই মাঝেমধ্যে এখানে আসি কিছু সময় দিতে।

আমেরিকানরা স্বেচ্ছাসেবার দিক থেকে পৃথিবীতে সেরা। গত বছর আমেরিকান নাগরিকেরা ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ঘণ্টা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। যার অর্থমূল্য ছিল ১৬৭ বিলিয়ন ডলার।

(সূত্র: nationalservice.gov/newsroom/press-releases/2018/volunteering-us-hits-record-high-worth-167-billion)

রিটায়ার করে কী করব এখনো কিছু ঠিক করিনি। ছোটবেলায় পোর্টসমাউথের খোঁড়া মুচি জন পাউন্ডস হতে চেয়েছিলাম। আলুভাজি টোপ দিয়ে যিনি অনাথ শিশুদের খুঁজে খুঁজে তার পাঠশালায় নিয়ে আসতেন। আলুভাজির লোভে সেই অত্যাশ্চর্য পাঠশালায় ‘যে একবার আসত, আর কখনো ফিরত না’।

লিটল রিভার ফলস। ছবি: সংগৃহীত
লিটল রিভার ফলস। ছবি: সংগৃহীত

এই রেঞ্জারকে দেখে মনে হলো আমার এখনো সেই খোঁড়া মুচির পাঠশালা খোলার সময় আছে। কিংবা তাতে ব্যর্থ হলে হতে পারি আমার মেয়ের স্কুলের বৃদ্ধ ভেটারান মি. রেইনমেকার। সকালে আর স্কুল ছুটির সময় যিনি কার রাইডার লাইনে দাঁড়িয়ে হেল্প করেন। আমি জানি, কেন তিনি এই কাজ করেন।

এরা সবাই সেই রেঞ্জারের মতো, ‘Ask not what your country can do for you...।’ দেশ তাদের কাছে কিছু চাওয়ার আগে, নিজেরাই কর্তব্য মনে করে শেষ বয়সে যেকোনো কাজে স্বেচ্ছাসেবা দিতে এগিয়ে আসেন আর বলেন, ‘দিস ইজ মাই নেইবারহুড। আই লাইক টু কিপ ইট ক্লিন।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন—

‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর

রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,

দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—

তার পরে ছুটি নিব।’