রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দায় হবে কেন?
মিয়ানমারের স্বৈরশাসক দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার জন্য বারবার তাদের ওপর আক্রমণ করছে। এথনিক মাইনরটি বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের বসবাস শুরু হয় এই অঞ্চলে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশান আর্মি প্রথম বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তে হামলা করে বলে অভিযোগ উঠে। দ্বিতীয় হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার যখন গণতন্ত্রের নামে দেশটিকে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, ঠিক তখনই ১৯৬২ সালের ২ মার্চ সুযোগ বুঝে সামরিক জান্তা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। টানা ২৬ বছর জেনারেল নেউইনের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। আবার সেনানিয়ন্ত্রিত প্রধানমন্ত্রী ইউ নুকে ক্ষমতায় বসিয়ে রাখা হয় বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
জাতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, আমলাতন্ত্র সবই ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত। মিয়ানমারের সেনানিয়ন্ত্রিত রেভ্যুলুশনারি কাউন্সিল একদল নিয়ে গঠিত নির্বাচিত বার্মা সোশালিস্ট পোগ্রাম পার্টির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আবার ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে (সোশালিস্ট পার্টি ব্যর্থ হলে) আবার সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির হাতে ক্ষমতা দেয়।
অং সাং সু চি বর্তমান মিয়ানমারের ফার্স্ট স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টের নির্বাচিত সদস্যও বটে। আর সু চির বাবা ছিলেন মেজর জেনারেল অং সান। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ এবং প্রতিবিপ্লবী নেতাও। ব্রিটিশ শাসিত মিয়ানমারের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ব্রিটিশ বার্মা কলোনিতে পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে খুন হন। অং সান সু চিও বারবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও ক্ষমতায় বসতে পারেনি। জেনারেল নেউইন এক নাগাড়ে ২৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখেন এবং সু চিকে গৃহবন্দী করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে পার্লামেন্টে সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সু চিকে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপস করেই সেনানিয়ন্ত্রণে থেকে স্টেট কাউন্সিলর হতে হয়েছে।
মূলত যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, কেন মিয়ানমারের ১০ লাখ লোক বিতাড়িত রোহিঙ্গা বাংলাদেশের লাইবেলেটি বা দায় হবে? রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাগরিক। তারা ব্রিটিশ শাসিত বার্মাতে প্রথম নিজেদের আবাসন গড়ে তোলে এবং তাদের ভাষা বাংলা এবং ধর্ম ইসলাম এবং তারা আরাকানি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার সঙ্গে মিল রয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার। যাই হোক তারা মিয়ানমারের বাসিন্দা। এ নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ নেই। আজকের বিশ্ব সভ্য জগতের মানুষের বসবাস উপযোগী একটি সভ্যতা বলে আমরা জানি। এই জগৎ সভ্য মানুষের আবাসভূমি, কোন মধ্যযুগীয় বর্বরদের বসবাস এখন পৃথিবীর কোথাও নাই। আর আছে কিছু যুদ্ধবাজ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা জোর করে, যুদ্ধ করে, মানুষ মেরে একটি সভ্যতাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নিজেদের দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমন কিছু বর্বর অসভ্য শাসক বা দেশ এখনো এই পৃথিবীতে আছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার শক্তি বা সাহস কারও নাই।
মোটামুটি জোর জার মুলুক তার, পৃথিবীটা এখন এভাবে চলছে। মানবাধিকার আর সভ্যতার কথা যেটা বলা হয়, সেটা কেবল কথার কথা। দরিদ্র দেশ হলে তখন সেখানে আসে মানবাধিকারের কথা। আর ধনী বা প্রভাব শালী দেশ আর সামরিক জান্তার শাসন হলে এসবের আর দরকার হয় না। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, মার্কিন প্রশাসনের ইরাক আক্রমণ ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতার নিদর্শন। আজকের মুসলিম সভ্যতার অন্যতম দেশ সিরিয়া জঙ্গি দমনের নামে আমেরিকা আর রাশিয়ার আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষাগারে পরিণত করা হয়েছে। লাখ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্বিচারে খুন করা হয়েছে।
ইরাকে ৩০ লাখ আর সিরিয়ার ২০ লাখ শিশুর জীবন গেল, মানবতার কোন খোঁজখবর নেই। আজকের ফিলিস্তিন একটি ধ্বংসস্তূপ, প্রতিদিন নিরীহ মানুষদের খুন করা যেন ইসরায়েলের নিত্যদিনের কাজের অংশ। নির্বিকার বিশ্ব সভ্যতা, নির্বিকার মানবতা। চুপ–চাপ, কেউ কোন কথা বলছে না। কেবল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে একটা বিবৃতেই শেষ।
আজ বাংলাদেশের অবস্থাও সেই পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমি বলব, বাংলাদেশকেও সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের শক্তিধর বর্বর রাষ্ট্রগুলো। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ভারত—মূলত এই চারটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের স্বৈরশাসকদের হাতে যখন বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল, তখন এই চার দেশসহ বিশ্বের সব দেশ বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছিল, বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে, বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিতে। যেহেতু মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্তও রয়েছে, সেই সুবাদে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সরকার মানবিক দিক বিবেচনা করেই ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়। তখন বিশ্ব সভ্যতা বাংলাদেশকে বাহবা জানায়, বাংলাদেশকে ধন্যবাদ দেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ প্রায় ৩ বছর হয়ে গেল রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরছে না। মিয়ানমারের সরকারও তাদের ফেরত নিচ্ছে না। নানা টালবাহানা করছে।
এখন তো বাংলাদেশ মহাবিপদে, ওদের তো জোর করে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। পাঠাতে হলে মিয়ানমারের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই হবে। কিন্তু তারা কোন কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। বিশ্ব বিবেকের জায়গা হলো জাতিসংঘ। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে সারা বিশ্বের নেতারা একত্রিত হন সদর দপ্তরে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশ আহ্বান জানায় রোহিঙ্গাদের যেন তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে রাজি করাতে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপনের চেষ্টা করলে কোন দেশ কর্ণপাত করেনি। তারা নিজেরা কোন কিছু করে না, মিয়ানমারকেও কিছু বলছে না, কোন চাপও দিচ্ছে না। বাংলাদেশ সাধারণ পরিষদে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করলে চীন, রাশিয়া, ভারতের মত দেশ এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, যার ফলে বাংলাদেশকে বাবার ব্যর্থ হতে হচ্ছে। অথচ দেখা যায় ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলে দাবি করা হয়, চীন আমাদের নতুন বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে যোগ দিয়েছে। অথচ এই চীন ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার চরম বিরোধিতা করেছিল। আর রাশিয়া আমাদের দুর্দিনের বন্ধু। ১৯৭১ সালে আমাদের বিশাল সহযৌগিতা করেছিল এই দেশ। অথচ আজ মিয়ানমারের ব্যাপারে আমাদের কোন সাহায্য না করে বিরোধিতা করছে।
এই তিন দেশ মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসকদের সমর্থন করছে। ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষে কোন ভূমিকা পালন করছে না। এই রোহিঙ্গারা দিনে দিনে সংখ্যায় বেড়ে, তা বাংলাদেশের জন্য বিশাল বোঝায় পরিণত হবে। দেশের বিশাল এলাকা আজ ধ্বংস প্রায়। গাছপালা, বনভূমি, ফসলি জমি পরিবেশ রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে তারা সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিলেমিশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে, চুরি–ডাকাতি, অসামাজিক কাজকর্ম এমনভাবে চলছে, যা দিনে দিনে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কিছু এনজিও, জঙ্গি সংগঠন, জামায়াত–শিবির ত্রাণের নামে এসব রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে থেকে যাওয়ার জন্য উসকানি দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট হুমকি। এরা আমাদের দেশের জন্য বিরাট দায়ে পরিণত হয়েছে। আমরা বিশ্ব বিবেকের কাছে সুস্থ প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার সমাধান চায়। নইলে শিগগিরই আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বিশাল সামুদ্রিক এলাকা রোহিঙ্গাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে এবং স্থানীয় এলাকাবাসীর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
লেখক: সহসভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ