আত্মসমর্পণের দলিল

(পর্ব ৩৭)

নয়াদিল্লি থেকে ১৬ ডিসেম্বর রয়টার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল [The surrender document] পরিবেশন করে, যা ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে।
আত্মসমর্পণের দলিল
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ভারতীয় ও বাংলাদেশের যৌথ পূর্বাঞ্চলীয় অফিসার কমান্ডিং জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে।
সব পাকিস্তানি স্থল, বিমান ও নৌ সেনা, সব আধাসামরিক বাহিনী এবং সাধারণ সেনাবাহিনী এর অন্তর্ভুক্ত হবেন।
এসব বাহিনীর সব সদস্য যে যেখানেই থাকুন না কেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কমান্ডে থাকা নিকটস্থ বাহিনীর কাছে তাদের অস্ত্র সমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবেন।
এই দলিল সাক্ষর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার আদেশের আওতায় আসবে। এই আদেশ অমান্যকারীদের আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গকারী হিসেবে গণ্য করা হবে এবং যুদ্ধের নিয়ম অমান্যকারী হিসেবে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
আত্মসমর্পণের দলিলের কোন অর্থ অথবা ব্যাখ্যার অস্পষ্টতা হলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা শপথের সঙ্গে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, যে সব কর্মী আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশনে অনুসারের সৈনিকের উপযুক্ত প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা হবে।
যুদ্ধবিরতি ও আত্মসমর্পণ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় পার্লামেন্টে বিবৃতি দেন। আমেরিকান সংবাদ সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল পরিবেশিত সংবাদটি নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ১৭ ডিসেম্বর পত্রিকায় ছাপে যার শিরোনাম ছিল, ‘যুদ্ধবিরতি ও আত্মসমর্পণ নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি’ [Statements by Mrs. Gandhi on truce and surrender]
বিবৃতিগুলো যেভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা সংক্ষেপে—

যুদ্ধবিরতির বিবৃতি
আমি বারবার ঘোষণা করেছি, যেকোনো রাষ্ট্র দখলের উচ্চাভিলাষ ভারতের নেই। এখন পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করেছে এবং বাংলাদেশ এখন মুক্ত। আমাদের দৃষ্টিতে বর্তমান দ্বন্দ্ব বজায় রাখা অর্থহীন। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য অহেতুক রক্তপাত ও জীবনহানি বন্ধ করা। সুতরাং আমরা ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৮টা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের সর্বত্র যুদ্ধবিরতি পালনের ঘোষণা দিচ্ছি। আমাদের আশা, পাকিস্তান সরকার অনতিবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে আজ রাতে জাতিসংঘে একটি বিবৃতি দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আত্মসমর্পণের ঘোষণা
আমার মনে হয়, এই ঘোষণার জন্য আমাদের সংসদ বেশ কিছুদিন যাবৎ অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা আজ মুক্ত, দেশের মুক্ত রাজধানী। ঢাকায় বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারের পক্ষে লে. জে. এ এ কে নিয়াজী, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর প্রধান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা এই আত্মসমর্পণের দলিল গ্রহণ করেছেন।
এই সংসদ এবং পুরো জাতি এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আনন্দিত।
এই বিজয়ে আমরা বাংলাদেশের মানুষকে অভিনন্দন জানাই। আমরা আত্মত্যাগের জন্য অভিনন্দন জানাই সাহসী যুবকদের এবং মুক্তিবাহিনীর বালকদের। আমরা আমাদের নিজস্ব স্থল, নৌ, বিমানবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীকে তাদের চূড়ান্ত উৎকর্ষ প্রদর্শনের জন্য অভিবাদন জানাই। আমরা আশা করি, এই নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার সঠিক স্থান নেবেন এবং তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশ শান্তি, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। সময় এসেছে এখন তারা একসঙ্গে সোনার বাংলা গড়তে এগিয়ে যাবে।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা সিডনি সেনবার্গ যিনি ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এবং জুনে সাংবাদিকদের জন্য ঢাকা উন্মুক্ত করা হলে তিনি ঢাকায় এলে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাক সেনারা তাঁকে আবার বহিষ্কার করে। ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তিনি এবং অন্য সাতজন পশ্চিমা সাংবাদিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তিনি ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে যে পথে ঢাকায় আসছিলেন, সেই পথে মাঝে মাঝেই ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ বাঁধে, কারণ অনেক পাকিস্তানি সেনা তখনও যুদ্ধবিরতি এবং আত্মসমর্পণের বিষয়টি জানতে পারেনি। তিনি ঢাকা থেকে তখনকার অবস্থা বর্ণনা করে যে প্রতিবেদন পাঠান, তার শিরোনাম ছিল, ‘দুজন মানুষ একটি টেবিলে, ঢাকার দিকে অগ্রযাত্রা: সংঘর্ষ ও বিজয়’ [2 Men at a table; March to Dacca: last Clash and victory]

প্রতিবেদনটি সংক্ষেপে এমন—
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বিস্তীর্ণ ঘাস বিছানো মাঠ যাকে রেসকোর্স বলা হয়, সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৩ দিন পর আজ আত্মসমর্পণ করে। এটি সেই রেসকোর্স, যেখানে শেখ মুজিব ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যে ভাষণে তিনি সামরিক আইনের অবসান এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। আজ কোনো বক্তৃতা নেই, শুধু ঘাসের ওপর রাখা ছোট একটি টেবিলে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ এক নিয়াজী ৭০ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক কাগজে সাক্ষর করেন।
সূর্য ডোবার কিছু আগে ১০টি ভারতীয় হেলিকপ্টার বিমান বন্দরে অবতরণ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে আসা এসব হেলিকপ্টারে ছিলেন জেনারেল অরোরা, অন্যান্য ভারতীয় কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকবৃন্দ। জেনারেল নিয়াজী বিমানের টারমার্কে অপেক্ষা করছিলেন, সেখান থেকে তাঁরা গাড়িতে রেসকোর্সের দিকে রওনা হন। আত্মসমর্পণের দলিল সাক্ষরের পর জেনারেল নিয়াজী একটি সাধারণ গাড়িতে ও অরোরা স্টাফ গাড়িতে স্থান ত্যাগ করেন।
চারদিকে তখনো ক্ষুদ্র অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ভারতীয় সৈনিকদের দল অন্ধকারেই কলকাতা ফিরে আসেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ এলাকায় এসে জড় হতে থাকে, যেখানে তারা বাঙালিদের আক্রোশ থেকে রক্ষা পেতে পারে। (চলবে)


লেখক: গল্পকার, কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার
ইমেইল: [email protected]