অভিশংসনের মুখে ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসনের মুখে। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসনের মুখে। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়, অভিশংসন বা ইমপিচমেন্ট একটি ‘নোংরা শব্দ’। নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন তিনি। অভিশংসন চেষ্টার জন্য বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তাঁদের ‘মার্কিন স্বার্থবিরোধী’ ও ‘অদেশপ্রেমিক’ বলেও ভর্ৎসনা করেছেন। তাতে কাজ না হওয়ায় স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সঙ্গে আলাদা করে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তাঁদের উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন সব বিষয়ে একযোগে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। সে কথায় কান না দিয়ে পেলোসি অভিশংসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গত সপ্তাহে পেলোসি ঘোষণা করেন, ‘এ ছাড়া অন্য কোনো পথ আমাদের জন্য খোলা নেই। শাসনতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’

আমেরিকার ইতিহাসে এ পর্যন্ত দুজন প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হয়েছেন। ১৮৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন ও ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। তাঁরা অবশ্য ক্ষমতা থেকে অপসারিত হননি। কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট তাঁদের অপসারণের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। আরও একজন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন অভিশংসন নিশ্চিত জেনে ১৯৭৪ সালে নিজ থেকেই পদত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হবেন তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, যাঁকে অভিশংসনের কালো ছাপ বহন করতে হবে। সেই সম্ভাবনা এখন কার্যত অনিবার্য। তবে এটা প্রায় নিশ্চিত যে তিনি সিনেটের রিপাবলিকানদের সংখ্যাধিক্যের জোরে পার পেয়ে যাবেন। ক্ষমতা থেকে অপসারিত হবেন না।

ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় সোমবার প্রতিনিধি পরিষদের বিচার বিভাগীয় কমিটির সর্বশেষ উন্মুক্ত শুনানি শেষ হয়েছে। এতে সিদ্ধান্ত হয়েছে ট্রাম্পের অভিশংসনের উদ্দেশ্যে ডেমোক্রেটিক দল অবিলম্বে ‘অভিশংসন ধারা’ বা ‘আর্টিকেলস অফ ইমপিচমেন্ট’ প্রণয়নে মনোনিবেশ করবে। এদিন সন্ধ্যা থেকে রুদ্ধদ্বার কক্ষে সেই লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় কমিটির সদস্যরা স্পিকার পেলোসির সঙ্গে মিলিত হন। ধারণা করা হচ্ছে, এ সপ্তাহের মধ্যে এই ধারাগুলো প্রণীত হতে পারে। দুই দলের সদস্যদের ভোটে বিচার বিভাগীয় কমিটির অনুমোদন শেষে এই অভিশংসন ধারার ভিত্তিতে এই মাসের শেষ নাগাদ পূর্ণ প্রতিনিধি পরিষদে ভোট গ্রহণ হতে পারে।

সোমবারের উন্মুক্ত শুনানিতে বিচার বিভাগীয় কমিটির প্রধান কংগ্রেসম্যান জেরি ন্যাডলার সোজাসাপ্টা ভাষায় জানান, ট্রাম্প জাতীয় স্বার্থের বদলে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় ক্ষমতা অপব্যবহার করেছেন। তিনি ইউক্রেনের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। যাতে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর সম্ভাব্য ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর পুত্রের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করা যায়। বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তাঁর পুত্র হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে মাসে ৫০ হাজার ডলার উপার্জন করতেন। তা ছাড়া জো বাইডেন গ্যাস কোম্পানিটির কার্যকলাপ তদন্তরত একজন ইউক্রেনীয় সরকারি প্রসিকিউটর বা কৌঁসুলিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ট্রাম্পের দাবি এটি দুর্নীতি। যদিও বাইডেন বা তাঁর পুত্র বেআইনি কিছু করেছেন এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।

এই তদন্ত শুরু না হওয়া পর্যন্ত ট্রাম্পের নির্দেশে ইউক্রেনের জন্য কংগ্রেসের বরাদ্দকৃত প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য আটকে দেওয়া হয়। ২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় ট্রাম্প খোলামেলা ভাবেই বলেন সাহায্য পেতে হলে তাঁকে পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে এই তদন্ত শুরু করতে হবে। অর্থাৎ, একটার বদলে আরেকটা করতে হবে। এই আদান-প্রদান লাতিন ভাষায় ‘কুইড প্রো কুয়ো’ নামে পরিচিত। আমেরিকায় এখন সবার মুখে মুখে এই ‘কুইড প্রো কুয়ো’। একজন ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ বা সতর্ককারী গোপনে এই কথাবার্তার খবর ফাঁস করে দিলে ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য নির্ধারিত সাহায্যের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

এরপরও ট্রাম্প বলেন, তিনি মোটেই অন্যায় কিছু করেননি। জেলেনস্কির সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার একটি বিবরণ প্রকাশ করেন ট্রাম্প। ডেমোক্র্যাটরা দাবি করেছে, সে আলাপচারিতাতেই ক্ষমতা অপব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে। ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ আহ্বান করেছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পের পক্ষে হস্তক্ষেপ করেছিল এমন একটি অভিযোগ রয়েছে। এই নিয়ে বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের তদন্তে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরগুলো ২০১৬ সালে রাশিয়া ট্রাম্পের পক্ষে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে একমত।

ডেমোক্র্যাটদের দাবি, আগামী নির্বাচনে যাতে বিদেশি হস্তক্ষেপ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই ট্রাম্পের অভিশংসন ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। জেরি ন্যাডলারের কথায়, ট্রাম্প আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য একটি ‘অব্যাহত হুমকি’।

প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যালঘু রিপাবলিকান সদস্যরা অবশ্য তাদের সাধ্যমতো ট্রাম্পের পক্ষাবলম্বন করে অভিশংসনের বিরোধিতা করে চলেছে। সোমবারের শুনানিতেও সে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। তাঁরা দাবি করেছেন, ট্রাম্প নয়, অভিশংসনের উদ্যোগ নিয়ে ডেমোক্র্যাটরাই ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করছে। তাঁদের যুক্তি, ট্রাম্প এমন কিছুই করেননি যার জন্য তাঁকে ক্ষমতা থেকে বহিষ্কারের চেষ্টা করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। কেউ ট্রাম্পের নিজ মুখে নির্বাচনী হস্তক্ষেপের কোনো দাবির কথা শোনেনি। রিপাবলিকানরা এমন দাবিও করেছে, ইউক্রেন একটি দুর্নীতিবাজ সরকার, এটি পরিচিত সত্য। সে সরকারকে অর্থ বা সামরিক সাহায্য প্রদানের আগে দুর্নীতির তদন্ত দাবি করে ট্রাম্প মার্কিন স্বার্থই রক্ষা করেছেন।

আরও একটি ব্যাপারে ট্রাম্পের সঙ্গে রয়েছেন রিপাবলিকানরা। ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া নয়, ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ইউক্রেন হস্তক্ষেপ করে। এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকলেও রিপাবলিকানরা বিনা প্রতিবাদে ট্রাম্পের পক্ষাবলম্বন করছে। পরিহাসের বিষয় হলো, ট্রাম্প ছাড়া অন্য যে ব্যক্তি ইউক্রেনের হস্তক্ষেপের এই তত্ত্ব প্রচার করেছেন তিনি হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। সে কথা উল্লেখ করে ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সবকিছুই শেষ পর্যন্ত পুতিন ও মস্কোতে গিয়ে পর্যবসিত হয়।

রিপাবলিকানদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ডেমোক্র্যাটরা দুটি ধারায় ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একাধিক সূত্রে বলা হয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় স্পিকার পেলোসি বিচার বিভাগীয় কমিটির প্রধান জেরি ন্যাডলার ও অন্যান্য শীর্ষ ডেমোক্রেটিক কমিটি প্রধানদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মঙ্গলবার ওয়াশিংটন সময় সকাল নয়টায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন।