হন্তারক

বাড়ির কাছাকাছি এসে ডানে মোড় নিতেই রিকশা থেমে গেল। রঞ্জু জিজ্ঞেস করল, কী হলো ভাই?
রিকশাওয়ালা ‘চেইন পড়ে গেছে ভাইজান’ বলেই চেইন ঠিক করতে লাগল।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা কালো জিপ এসে রিকশার সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার দরজা খুলতেই গাড়ি থেকে নামল মন্টু ও রতন। ওরা দুজনেই এগিয়ে এল রঞ্জুর দিকে। রঞ্জুর সঙ্গে দুজনেই হাত মেলাল।
মন্টু জিজ্ঞেস করল, কবে এসেছিস? উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বলতে শুরু করল, শুনি মাঝে মাঝে তুই আসিস। কখন আসিস কখন চলে যাস জানতেই পারি না। তা কেমন আছিস তুই? আরও একটা প্রশ্ন করে রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল মন্টু।
রঞ্জু বলল, এসেছি কয়েক দিন হলো, কাল চলে যাব।
রিকশাভর্তি বাজার আর রঞ্জুর অতি সাধারণ পোশাক নিরীক্ষা করে রতন বলল, তা পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের এ অবস্থা কেন? গাড়ি কই? নাকি গাড়ি-বাড়ি কিছুই করিসনি?
রঞ্জু হেসে বলল, হয়ে ওঠেনি, এত টাকা কই।
মন্টু বলল, টাকা হাওয়ায় উড়ে দোস্ত। শুধু ধরার কৌশলটা রপ্ত করতে হয়। শুনলাম অবসর নেওয়ার পর ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে উচ্চ পদে জয়েন করেছিস। কপাল কুচকে রঞ্জুর দিকে একটু ঝুঁকে সে বলল, বয়স কত হলো? তুই তো এখনো সেই সুবোধ বালক রয়ে গেছিস। বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে, লেখাপড়া, চাকরি, বাজার। আজও দেখছি বাজার করেছিস। চাবির রিং আঙুলে ঢুকিয়ে ঘোরাতে লাগল মন্টু।
রঞ্জু জিজ্ঞেস করল, তুই কেমন আছিস? রাজনীতি করছিস, নেতা হয়েছিস, কেমন লাগছে?
—এই যাচ্ছে ব্যস্ততায়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল মন্টু। তারপর বলল, আছিস তো বাসায়। আমরা আসছি আজ সন্ধ্যায় তোর ওখানে। কথা আছে। বলেই রিকশাচালকের দিকে তাকিয়ে বলল, কী গফুর মিঞা, কী খবর? কত করে বললাম পার্টিতে জয়েন কর। দেশ সেবা কর। শুনলা না তো আমার কথা। চালাও রিকশা, চালাও। গফুরের পিঠে ছোট্ট একটা চাটি মেরে গাড়ি নিয়ে শো করে চলে গেল ওরা।
রঞ্জু একটু চিন্তায় পরে গেল ওদের আসার ব্যাপারে। কিছুদিন থেকে মন্টু খুব বিরক্ত করছে রঞ্জুর ছোট চাচাকে। এই পৌর এলাকার মধ্যেই রঞ্জুদের একটা জমি আছে মন্টুদের জমির সঙ্গে লাগোয়া। মন্টু সে জমিটি কিনতে চায়। রঞ্জুর চাচা বলে দিয়েছেন, এ জমি এখনো শরিকদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়নি। রঞ্জুর ভাই বোন রয়েছে। ওরা বিক্রি করতে রাজি হবে না। তারপরও মন্টু একেকবার একেক রকম কথা নিয়ে আসে। দাম বাড়ায়। কখনো বলে ছোট্ট একটা ক্লিনিক করবে, কখনো বলে স্কুল করবে। এসব কথা অনেক আগেই শুনেছে রঞ্জু কিন্তু তেমন পাত্তা দেয়নি। এ ব্যাপারে রঞ্জুর ছোট চাচাকে রঞ্জুদের বোঝানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মন্টু। সে এখন শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। গত বছর পৌর সভার কাউন্সিলর হয়েছে সে।
রঞ্জু সংবিৎ ফিরে পেল রিকশাচালকের কথায়।
—জানেন ভাইজান, দুই চোর এক সঙ্গে হয়েছে। ওদের তো বাড়ি করতে পয়সা লাগেনি। রতনেরা দখল করেছে হিন্দুদের বাড়ি আর মন্টু দখল করেছে বিহারিদের বাড়ি। ড্রাইভারের ছেলে এখন গাড়ি হাঁকায়। খুব ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলে রিকশা চালাতে শুরু করল সে।
কথা ও পোশাকে বেশ ভদ্র এই বয়স্ক রিকশা চালককে খুব চেনা চেনা লাগছে রঞ্জুর, এমন কী নামটাও। কিন্তু সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে। রঞ্জু রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। তখন নিজেই এসে বলল, ভাইজান আমার রিকশায় আসেন বলেই সে যত্ন করে ব্যাগ তুলে নিল রিকশায়।
রঞ্জু জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়?
গফুর অবাক হয়ে বলল, আমাকে চেনেননি ভাইজান! আমি সবুরের ভাই। আপনার বন্ধু সবুর। আমি কাদের দপ্তরির ছেলে। বাবা আপনার বাবার স্কুলের দপ্তরি ছিল।
এক সময় তারা এত কাছের লোক ছিল। অথচ রঞ্জু আজ চিনতেই পারল না। দপ্তরি কাদের চাচা ও সবুরের কথা মনে পড়ায় সে রীতিমতো লজ্জায় পড়ে গেল। কার রিকশায় উঠেছে সে। সবুর বেঁচে থাকলে, আজ এই গফুরের জীবন হয়তো অন্য রকম হয়ে যেত। সব ভাই-বোনেরা ঢাকায় স্থায়ী বসবাস করায় রংপুরে আর আসাই হয় না। প্রায় ২০-২৫ বছর তাদের কোনো খোঁজ-খবর না নেওয়ার এক অপরাধ বোধ রঞ্জুকে দংশন করতে লাগল।
গফুর সবুরের চেয়ে অনেক ছোট, প্রায় ১৪ বছরের। কিন্তু তাকে বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছে। খুব মেধাবী ছাত্র ছিল সবুর। রঞ্জু, মন্টু, রতন, সবুর এক সঙ্গে পড়ত। একই পাঠশালায়, ক্লাস সিক্সে উঠে সবুর আর রঞ্জু ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হলো জেলা স্কুলে। মন্টু আর রতন ভর্তি হলো আদর্শ স্কুলে। সবুর যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন জন্ম হয় এই গফুরের।
রঞ্জু, মন্টু ও রতনদের বাড়ি একই পড়ায়। সবুরদের বাড়ি একটু দূরে ভিন্ন পাড়ায়। রঞ্জু ও মন্টুদের পূর্ব পুরুষদের ভিটে মাটি হচ্ছে এই শহরের একই পাড়ায়। রতনেরা অনেক পরে এসেছে, রতন এসে ভর্তি হয়েছিল ক্লাস থ্রিতে। তখন এই শহর, এলাকা ও এই পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ৫০ বছর আগে ফেলে আসা দিনে ফিরে গেল রঞ্জু। মনে পড়ে গেল আত্মীয় নয় স্বজন নয় তবুও আপন এ রকম কত মানুষের কথা। অনেক কিছু ভেঙে নতুন করে গড়া হয়েছে। কিন্তু রঞ্জু যেন এখনো নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারে কোনটা কার বাড়ি ছিল। কোন জায়গায় কখন কে বসে থাকত। মনে পড়ে গেল রঞ্জুর ওদের পাশের বাড়িটি ছিল হরিপদ উকিলের বাড়ি। দুই মেয়ে ছিল তাঁর। পলি আর দুলি। ওরা তখন কলেজে পড়ত। দোকান বা স্কুলে যাওয়ার সময় রঞ্জু প্রায় দেখত দুলিদি বা পলিদি এক প্যাঁচে শাড়ি পরে কখনো বাইরের বারান্দা ঝাড়ু দিচ্ছে, কখনো ছাদে কাপড় শুকোতে দিচ্ছে।
মাসিমাকে দেখত কপালে বড় লাল টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর আর সাদা-লাল চওড়া পাড়ের শাড়ি পরে পুজোর জন্য ফুল তুলতে। এই হরিপদ উকিলের বাড়ির পাশেই ছিল শামসুল ডাক্তার আর জগদীশ স্যারের বাড়ি। রঞ্জুদের বাড়ির পূর্ব দিকে ছিল বিরাট খেলার মাঠ। মাঠের উল্টো দিকে ছিল ম্যাজিস্ট্রেটদের একই রকম দুটি বাড়ি। বাড়ি দুটির ডান দিকে ডিএসপি, এসডিও এবং এডিসির বাড়ি। বাম দিকে খান ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মজিদ খানের বাড়ি। ১৯৪৭ সালে তাঁরা বিহার থেকে এসেছিলেন। মেটাল ও ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন ধরনের বড় ব্যবসা ছিল তাঁদের। সে সময় অনেক অবাঙালি এখানে ব্যবসা শুরু করেছিল। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের অনেকেই এঁদের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। মন্টুর বাবা ছিলেন খান ইন্ডাস্ট্রিজের ড্রাইভার।
শহরের চারদিকে ছিল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর পেশাজীবী মানুষ। মোটামুটি সবাই সবাইকে চিনতেন। মান্য করতেন।
কী যে মজা হতো পালা-পার্বনের দিনে। পুজোর সময় যেমন মজা হতো ঈদের সময়েও তেমন মজা হতো। পুজোর সময় পলিদিরা লুচি নিরামিষ, সন্দেশ, নাড়ু বানিয়ে সবাইকে খাওয়াত। ঈদের সময়ও পায়েস-সেমাই রান্না করে আশপাশের মাসিমা-পিসিমাদের বাসায় দিয়ে আসা হতো। তরকারি দেওয়া-নেওয়া ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার।
রঞ্জুর ছেলেবেলার সে সমাজটি ছিল অসাম্প্রদায়িক এক নির্ভেজাল সমাজ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বীজ লুকিয়ে ছিল মুষ্ঠিমেয়দের মধ্যে। তাই কখন যে হিন্দুদের ওপর আঘাত আসল তা কেউ জানতেও পারল না। হঠাৎ একদিন দেখা গেল বাড়ির দরজা-জানালা সব খোলা, কোথাও কেউ নেই। পলিদিরা কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। শুধু পলিদিরা নয়, একে একে সব হিন্দু পরিবার চলে গেল। তাদের ফেলে যাওয়া আসবাব, বাড়ি-ঘর ভোগ করতে লাগল গ্রাম ও শহরতলি থেকে আসা মানুষেরা। এভাবেই রতনেরা এসেছিল পলিদিদের বাসায়। রতনের বাবা ছিল আরসিও। রতন ছিল রঞ্জুর বয়সী। একই ক্লাসে পড়ত। খুব তাড়াতাড়ি রতনের সঙ্গে রঞ্জুর ভাব হয়ে গেল। ভাব হয়ে গেল মন্টু ও সবুরের সঙ্গেও।
দপ্তরি কাদের মিঞার ছেলে ও ভালো ছাত্র বলেই অন্যদের চেয়ে রঞ্জুর বাবার কাছে একটু বেশি সহানুভূতি পেত সবুর। তিনি বেশ আর্থিক সাহায্য সহযোগিতাও করতেন, যতটুকু পারতেন। রঞ্জু মেট্রিকে স্ট্যান্ড ও সবুর ফাস্ট ডিভিশনে পাস করল। মন্টু ও রতন করল ফেল। রঞ্জু ও সবুর ভর্তি হলো কলেজে। মন্টু আর রতন ওদের দলের সংখ্যা বাড়াতে লাগল। আরও কিছু ফেল করা ছাত্র যোগ দিল ওদের সঙ্গে। স্টেশন রোডের পুলের ওপর, হোটেল, রেস্তোরাঁয়, রাস্তার মোড়ে শুরু হলো ওদের আড্ডা। কলেজে যাওয়া-আসার পথে রঞ্জুর সঙ্গে দেখা হতো ওদের। রঞ্জু সাইকেল থামিয়ে কথা বলে বাড়ি ফিরত।
একদিন রঞ্জুর বাবা খুব অসুস্থ। বাজার করতে হবে। খুব তাড়া ছিল রঞ্জুর। পুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মন্টুদের দল। রঞ্জু সাইকেল না থামিয়ে পুল পাড় হতেই মন্টু চিত্কার করে ডাকল, এই রঞ্জু দাঁড়াও। রঞ্জু সাইকেল থামাল।
মন্টু এসে সাইকেল ধরে ব্যঙ্গ করে বলল, খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র হয়েছিস না! আমাদের চিনতেই পারিস না।
রঞ্জু বোঝাল, বাবার শরীর ভালো না। আমাকে বাজারে যেতে হবে। আজ একটু তাড়া আছে।
সবাই এক সঙ্গে ভেংচি কেটে বলে উঠল বাবার শরীর ভালো না, আমাকে বাজারে যেতে হবে। বলেই হো হো করে হেসে উঠল। মন্টু রঞ্জুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, যা ব্যাটা।
অবাক হয়ে গিয়েছিল রঞ্জু। ওদের সামনে আসতে এত লজ্জা হয়েছিল ওর যে অন্য পথ ধরে সময় নিয়ে কলেজে যাওয়া-আসা করত। ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার লজ্জায় কত দিন যে ওই পুলের ওপর দিয়ে চলা ফেরা করেনি রঞ্জু!
২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য ছোট মামার ঘরে সবাই এক সঙ্গে বসেছিল। ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছিল রঞ্জু। এ নিয়েও কত হাসি-তামাশা করেছে মন্টু আর রতন।
কাদের চাচা অসুস্থ হওয়ায় সবুর আর পড়তে পারল না। একটা কেরানির চাকরিতে ঢুকে পড়ল। রঞ্জু আইএসসি পাস করে ঢাকায় পড়তে গেল। যোগাযোগ কমে গেল সবুরের সঙ্গে।
এদিকে মন্টুরা তখন পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। পোস্টার লেখে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কারণে মারামারি করে।
রঞ্জু যখন চাকরিতে যোগ দিয়েছে তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রঞ্জু, মঞ্জু, সাজু ওরা তিন ভাই ও সবুর এক সঙ্গে চলে গেল মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে রঞ্জু ও মঞ্জু দুই ভাই ফিরল। ফিরল না ছোট ভাই সাজু আর সবুর।
১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের সঙ্গে সন্ধ্যা নাগাদ রঞ্জু ফিরল বাড়িতে। সারা শহরে আনন্দ উল্লাসের জোয়ার বইছে তখন। শহরে ঢল নেমেছে জনতার। মুক্তির স্বাদ নিশ্বাস ভরে গ্রহণ করছে বাংলার মানুষ।
পরদিন সকালেই খবর পাওয়া গেল বেশ কিছু রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে চারটি লাশ-ওখানে দুটি লাশ এ ধরনের বিক্ষিপ্ত খবর আসতে লাগল।
খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল রঞ্জু যখন দেখল আশপাশের অবাঙালিদের বাড়ি ফাঁকা। কেউ নেই। রঞ্জুর মা বলেছেন, এই কদিন আগেও সবাই ছিল। বিস্ময়ের আর সীমা থাকল না রঞ্জুর যখন দেখল খান ইন্ডাস্ট্রিজের অট্টালিকার মতো বিরাট বাড়ি মন্টুর দখলে। নির্ভীক, দ্বিধাহীন ও লজ্জাহীন কণ্ঠে সে উচ্চারণ করছে ‘এটা আমাদের বাড়ি’। প্রতিবেশী অবাঙালিদের পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান-পাট আত্মসাৎ শুরু হলো। কর্মচারীরা হয়ে গেল মালিক। এখন এদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিক, জনগণের নেতা, এম পি, মেম্বার, চেয়ারম্যান। কেউ কেউ বিজনেস ম্যাগনেট।
রঞ্জু তার জীবনের দীর্ঘ অতীত ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ি পৌঁছে গেছে বুঝতেই পারেনি। গফুর বলল, নামেন ভাইজান।
রঞ্জু রিকশা থেকে নেমে গফুরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এল। সব ঘটনা শুনল। সবুর যে মুদির দোকান করে দিয়েছিল কাদের চাচাকে গফুর তা চালাতে পারেনি। চাচার চিকিৎসার জন্যই বহু টাকা খরচ হয়ে যায়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ভাই হিসেবে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা তেমন পায়নি। গফুর তখন এত ছোট ছিল যে কিছুই গুছিয়ে নিতে পারেনি। চাচা মারা যাওয়ার পর দোকান বিক্রি করে এই রিকশা কিনেছিল সে। সবুরের শোকে চাচি অনেক আগেই মারা গেছে। গফুরের আর সংসার করা হয়নি। একা মানুষ সে কোনো রকম চলে যায়।
রঞ্জু বলল, তোমার তো বয়স হয়েছে আর কত দিন রিকশা চালাবে? আবার যদি দোকান দিতে চাও আমি কিছু সাহায্য করব।
গফুর শুধু বলল, আমি নিজেই চেষ্টা করছি আবার একটা দোকান করার। যদি সাহায্য লাগে বলব।
গফুরকে বিদায় দিতে বাইরের গেট পর্যন্ত এল রঞ্জু। গফুরের রিকশা টানার দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সবুরের হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠল রঞ্জুর চোখের সামনে। ঠিক মন্টু আর রতনের মতোই যেন ব্যঙ্গ করে সবুর প্রশ্ন করছে, কেমন আছ রঞ্জু বন্ধু আমার? বেদনায় জর্জরিত হলো রঞ্জু। নিজেকে একজন স্বার্থান্বেষী মানুষ বলে চিহ্নিত করে ধিক্কার দিল নিজেকেই।
সন্ধ্যা হতে না হতেই চলে এল মন্টু ও রতন। জমির ব্যাপারে মন্টু এবার এমন একটা মানবিক বিষয় নিয়ে এসেছে যা সহজে না করা যায় না। দেশের দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে। মন্টুর জমিতে হচ্ছে না। মানবিক কারণেই রঞ্জুদের জমি ছাড় দিতে হবে। এ রকম একটা অনুরোধ করল মন্টু।
রঞ্জু বলল, কোনো পল্লি অঞ্চলে কর। আমি যতটুকু পারি সাহায্য করব।
মন্টু বলল, আমার টার্গেট জোন হচ্ছে শহর। এই বলেই একটা প্রজেক্ট পরিকল্পনা বের করে দেখাল রঞ্জুকে।
রঞ্জু বলল, চাচা আছেন, আরও ভাই-বোনেরা আছে। আমি এদের সঙ্গে আলাপ করে তোকে পরে জানাব।
এমন সময় দুটো মোটরসাইকেল ও একটা গাড়ি এসে থামল রঞ্জুদের গেটের সামনে। কে যেন চিত্কার করে ডাকছে মন্টু ভাই তাড়াতাড়ি আসেন। সমীর চৌধুরীকে গুলি করা হয়েছে। আমাদের টুটুল ধরা পড়েছে।
রঞ্জু হতবাক। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সমীর চৌধুরীকে গুলি করা হয়েছে কেন? জানালা দিয়ে তাকিয়ে রঞ্জু দেখল, তাদের গেটের সামনে ছোট্ট একটা জটলা। ২৫-২৬ বছর বয়সের ১০/১২ জন যুবক খুবই উত্তেজিত। এদের মধ্যে একটি ছেলে খুব চিত্কার করছে। কয়েক জন যুবক শক্ত করে তাঁকে ধরে রেখেছে। আটকাতে পারছে না।
একটা গুলির শব্দ হলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেল যুবকের কণ্ঠস্বর। কোত্থেকে গুলি করা হলো বোঝা গেল না। মুহূর্তের মধ্যেই সবাই উধাও। রঞ্জুর চোখের সামনে তড়িৎ গতিতে ঘটে গেল এই ঘটনা। রঞ্জু বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তবে একটা কিছু করতেই হবে। করা দরকার। কিন্তু কী করবে। ভাবতে ভাবতে ঘামতে শুরু করল রঞ্জু। অবশ হয়ে এল তার শরীর। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আধো-আলো আধো-ছায়ার মতো ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। মনে হলো আলো-আঁধারিতে বিরাট একটা মাঠ আর তার চোখ বাঁধা। মন্টু আর রতন হাসছে আর সুর করে বলছে কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাস তাকে ছো। রঞ্জু দুই হাত ছড়িয়ে ছুঁতে চেষ্টা করছে মন্টু আর রতনকে। কিন্তু কিছুতেই ছুঁতে পারছে না। পুরো মাঠজুড়ে দুই হাত ছড়িয়ে সে শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে।