সু চি যখন হেগে

আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ উপস্থাপন করেন গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। পাশে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। ১০ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে পিস প্যালেসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে। ছবি: রয়টার্স
আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ উপস্থাপন করেন গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। পাশে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। ১০ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে পিস প্যালেসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে। ছবি: রয়টার্স

শান্তিতে নোবেলজয়ী ভিন্ন মতাবলম্বী অং সান সু চি রাজনীতিবিদ হিসেবে অনেক আগেই বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন। তখন তাঁকে ‘প্রিজনার অব কনসায়েন্স’ হিসেবে স্মরণ করা হতো, তবে এখন তাঁকে ‘জেনোসাইড কিলার’ বলা হচ্ছে।
মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী অং সান সু চি তাঁর দেশে গণহারে নৃশংসতার মুখপাত্র হিসেবে সাফাই গাচ্ছেন। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে তাঁর দেশের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগের পক্ষে সাফাই গাইতে তিনি হেগে উপস্থিত হয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছে তাঁর দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ খবর এখন সারা পৃথিবীর মানুষ জানে, সু চি সরকারের গণহত্যার শিকার হয়ে কমপক্ষে ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সামরিক জান্তার সমালোচনা করায় অং সান সু চিকে ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকতে হয়েছে। এরপরে স্বাভাবিকভাবেই সবাই মনে করেছিলেন, সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি খর্ব করতে তিনি তাঁর ক্ষমতা ও নৈতিকতার অবস্থানকে ব্যবহার করবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি দমন-পীড়নের পক্ষ নিয়েছেন। দাবি করছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর আচরণ নিয়ে যৌন সন্ত্রাসের একটি রিপোর্টেকে তিনি ‘ফেইক রেপ’ খবর বলেছেন। তিনি বরাবরই রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী বলে থাকেন।
সু চি সেনাবাহিনীর কাছে মাথা নত করেছেন, তা স্পষ্ট। যে কেউ নীতিগত এই ভিন্নমতাবলম্বীর কাছ থেকে কিছুটা বিরোধিতা প্রত্যাশা করতেই পারেন। তার পরিবর্তে দুবছর পরে আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার পক্ষে কথা বলছেন। তার দেশের সন্ত্রাসের হুমকিকে সমালোচকেরা খাটো করে দেখছেন—এমনটা দাবি করে হেগে যাত্রাকে মিয়ানমারের ‘জাতীয় স্বার্থের’ জন্য লড়াই বলেছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনে তাঁর সমর্থন এই নৃশংসতাকে জনপ্রিয়তা এনে দিতে সহায়তা করেছে।
১৯৯১ সালে ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন অং সান সু চি। এতে তিনি লিখেছিলেন, সত্য, ন্যায়বিচার ও অনুকম্পাকে গতানুগতিক বলে সরিয়ে রাখা যায় না, যখন তা শুধু নির্মম শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় হয়। গৃহবন্দী থাকাকালে অং সান সু চি লিখেছিলেন, এটা দুর্নীতিবাজদের শক্তি নয়। এটা হলো আতঙ্ক। যারা দুর্নীতি করে তাদের ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক।
সু চি এখন প্রমাণ করেছেন, এই নিয়মের বাইরে নন তিনিও। তিনি তার যুক্তির কাছে হেরে গেছেন।
গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয় অপরাধ ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে মিয়ানমার।
অবশেষে গত মাসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে মামলা করেছে গাম্বিয়া। গাম্বিয়ার নেতারা যে কথাগুলো বলেছেন, তা ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবু বাকার তামবাদু বলেছেন। আমাদের এই প্রজন্মের কাছে এটা এক লজ্জাকর, আমাদের নিজেদের চোখের সামনে যখন গণহত্যা হচ্ছে তখন আমরা কিছু করছি না। তারা আদালতে আবেদন করেন, মিয়ানমারকে এই অহেতুক হত্যাযজ্ঞ থামাতে বলুন। থামাতে বলুন এই বর্বর কাণ্ড, যা আমাদের সবার বিবেককে অব্যাহতভাবে শোকার্ত করছে। মিয়ানমারকে নিজ জনগণের ওপর গণহত্যা থামাতে বলুন।’
নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) বিচারকদের উদ্দেশে আবেগতাড়িত এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর। রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানির শুরুতেই তিনি এই আবেদন পেশ করেন। এ সময় সেখানে গণহত্যার দোসর হিসেবে হালে পরিচিতি পাওয়া মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিও উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ব আদালত (ওয়ার্ল্ড কোর্ট) হিসেবে পরিচিত আইসিজেতে তিনি তাঁর দেশের আইনজীবীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
খুবই অবাক করা বিষয়, সু চি যখন হেগে আইসিজের কার্যালয় পিস প্যালেস বা শান্তি প্রাসাদে প্রবেশ করেন, তখন স্বাভাবিক শরীরী ভঙ্গিতেই ছিলেন। তার খোঁপায় ছিল তাজা ফুল। তবে আদালতে শুনানি শুরু হলে দ্রুতই তার চেহারা বদলে যেতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে চরম বিষণ্ন দেখা যায়। আদালতে পাথরের মতো বসে ছিলেন ৭৪ বছর বয়সী সু চি।
মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের জন্য ২৮ বছর আগে এই দিনেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সু চি। অথচ ভাগ্যের পরিহাস, এদিন তাঁকে তাঁর উদ্দেশ্যে বলা ‘গণহত্যা বন্ধ কর’ কথাটা শুনতে হলো। গাম্বিয়ার আইনজীবীরা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও গণধর্ষণের ভয়াবহ বর্ণনা তুলে ধরেন তাঁর সামনেই। আদালতে আইনি লড়াইয়ের জন্য দুই দেশই খ্যাতনামা আইনজীবীদের নিয়োগ দিয়েছে।
আইসিজের ওয়েবসাইট থেকে লাইভ স্ট্রিম করা শুনানিতে এসব বিবরণ যখন পড়ে শোনানো হচ্ছিল, তখন সু চির মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা যায়নি। কখনো সোজা সামনে তাকিয়ে, কখনো মাটির দিকে তাকিয়ে তাকে বাদীপক্ষের বক্তব্য শুনতে দেখা যায়।