জাতিসংঘে গর্ভপাতে সাহায্যের আহ্বান

(পর্ব ৩৮)

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তাদের নানা পৈশাচিক কর্মকাণ্ড জনসম্মুখে প্রকাশ পায়, যা বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের হাতে অসংখ্য মা-বোনের সতীত্বনাশ হয় এবং ফলশ্রুতিতে তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা হয়। অসংখ্য পরিবার এসব যুদ্ধ শিশুদের গর্ভপাত করাতে চান, অনেক পরিবার ঘটনাটিকে চোখের অন্তরালে রাখার চেষ্টা করেন যা সামাজিক জটিলতার সৃষ্টি কর। গর্ভপাতের পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা না থাকায় হাজার হাজার মা ও শিশুর জীবন মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে পড়ে। এ নিয়ে একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ জাতিসংঘে বিষয়টিকে মানবিক বিপর্যয় বিবেচনায় জরুরি কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানান। বেশ কিছু পত্রিকা এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার কয়েকটির সংবাদ সংক্ষেপে নিচে দেওয়া হলো—
ওয়াশিংটন পোস্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যান্থনি এষ্ট্রেচেনের প্রতিবেদনে শিরোনাম ছিল, ‘জাতিসংঘে বাঙালিদের গর্ভপাতে সাহায্যের আবেদন’[U.N asked to aid Bengali abortion]
একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের দুঃখময় যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রায় ২০ হাজার ধর্ষিতা মেয়ের গর্ভপাতের সাহায্য চেয়ে হারভি কারম্যান তাঁর নতুন পদ্ধতি প্রয়োগে জাতিসংঘ বরাবর অনুরোধ করেন। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
কারম্যান লস অ্যাঞ্জেলেস সান ভিনসেন্ট হাসপাতালের মনো-দৈহিক বিভাগের পরিচালক। তিনি বলেন বাংলাদেশে তার সংক্ষিপ্ত অবস্থানের সময় তিনি চিকিৎসক ও চিকিৎসা সহযোগীদের যত দূর সম্ভব কম ঝুঁকিপূর্ণভাবে গর্ভপাতের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁর পদ্ধতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ১০০০ নিরাপদ গর্ভপাত করান হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস ৫ মার্চ বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত একটি সংবাদ ছাপে যার শিরোনাম ছিল, ‘বাংলায় শিশু হত্যার ভয়’ [Killing of babies feared in Bengal]

সংক্ষেপে সংবাদটি এমন—
বাংলাদেশে হাজার হাজার অবাঞ্ছিত শিশু জন্মের অপেক্ষায়। সমাজকর্মীরা মনে করেন, এদের অনেককেই হয়তো হত্যা করা হবে। এদের বাবা হলো পাকিস্তানি সৈন্যরা আর মা হলেন বাঙালি কন্যা, যাদের গত বছর বাঙালির জাতীয় আন্দোলনের সময় ধর্ষণ করা হয়। নারীদের নিয়ে কাজ করে এমনি একটি সংস্থা জানায়, গর্ভবতী নারীর সংখ্যা আনুমানিক ২৫ হাজার হবে। তবে কমপক্ষে ৫০ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী প্রফেসর মিসেস তাহেরা সফিক বলেন, ‘শুধু এই নারীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমেই ব্যাপক মাত্রায় ভ্রূণ হত্যা সম্ভব।’
বাংলাদেশে নারীদের ব্যাপক ধর্ষণ নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রতিবেদনটি করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। তাঁরা তাদের ম্যাগাজিন সেকশনে ‘বাংলাদেশের ধর্ষণ’ [The rapes of Bangladesh] শিরোনামে কভার স্টোরি করে, যার প্রতিবেদক ছিলেন অরবি মেনন নামের একজন উপন্যাস লেখক। তিনি মাঝে মাঝে নিউইয়র্ক টাইমস–এর জন্য লিখতেন। তিনি একাধিক ধর্ষিতার সঙ্গে সরাসরি, কখনোবা ধর্ষিতার পরিবারর সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন যারা ধর্ষিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে, সেই রকম সংগঠনের সঙ্গে। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি, বাংলাদেশের এই নারীদের সহায়তায় প্রথমদিকে এগিয়ে আসেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সেইন্ট মাদার তেরেসা ও তাঁর সংগঠন। তারা নির্যাতিত এসব নারীর সহায়তায় বাংলাদেশে ৫টি কেন্দ্র গড়ে তোলেন। লেখক তার লেখার শুরুতেই বর্ণনা করেন বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কথা এবং দেশের জন্য ভালোবাসার কথা। একজন নির্যাতিতের সাক্ষাৎকার সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।
একটি শান্তিপ্রিয় গ্রামে মেয়েটির বাস। বয়স সবে ১৭। মেয়েটি ছিল সেই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী। তার ছিল ডাগর আঁখি, অতুলনীয় নিতম্ব—সংস্কৃত কবি কালিদাসের ভাষায় যা দেখতে ছিল একটি নিখুঁত তরমুজের দুটি অংশ। অনুগত কন্যার মতো সে তাঁর বাবার পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করে। সে বলল, গ্রামের অনেক যুবকই তাঁকে বিয়ে করতে চাইতো। সেই মেয়েটি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই একটি সময়ই একটু হেসেছিল।
তারিখটা ১৭ অক্টোবর। বিয়ের পর স্বামীসহ বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল মেয়েটি। দুপুরে তাদের গ্রামের মাটির রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে একটি আর্মির ট্রাক এল। গ্রামের লোকজনকে ডেকে আনল। তাদের ভাষা গ্রামবাসীরা বুঝতে পারছিল, তবে তাদের মাঝে একজন সৈন্য কিছুটা বাংলা বলতে পারছিল। সে বলল, ভয়ের কিছু নেই। আমরা দেখতে এসেছি শেখ মুজিবের কোনো লোক এখানে আছে কিনা। সৈন্যরা পানি পান করতে চাইলে মেয়েটি মুখ ঢেকে তাদের ডাবের পানি দেয়। তারা যাওয়ার সময় বাড়ির সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলেটিকে, যে সেই বছরই কলেজে ভর্তি হয়েছে তাকে উঠিয়ে নেয়, সে আর ফিরে আসেনি। রাতে জিপে করে সৈন্যরা ফিরে আসে, তারা ছিল ছয়জন। জোর করে মেয়েটির কক্ষে একজন প্রবেশ করে। বাকিরা অস্ত্র হাতে সবাইকে আটকে রাখে। মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়, তারপর একসময় মেয়েটির তীব্র চিৎকারে খান খান করে ভেঙে যায় রাতের নীরবতা। এর পর বাকি সৈন্যরা একে একে মেয়েটির কক্ষে প্রবেশ করে পাশবিক অত্যাচার চালায়। এই বর্ণনাটি দিয়েছিল মেয়েটির বাবা। আর মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল একটি আশ্রয় কেন্দ্রে, যেখানে তাঁর মতো আরও অনেক মেয়ে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অপেক্ষায় ছিল—গর্ভপাতের অপেক্ষায়, অথবা কেউ কেউ এমন অবস্থায় ছিল যে, তাদের গর্ভপাত করানো বিপজ্জনক।
স্বাধীনতার পর বিদেশি সাংবাদিকেরা বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান আর মানুষের কাছ থেকে জানতে পারেন পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার নানা কাহিনি। দেখতে পান ধ্বংসযজ্ঞের নানা নমুনা। এসব নিয়ে অনেকে প্রতিবেদন পাঠান তাদের পত্রিকায়। এমনি একটি প্রতিবেদন ছিল পূর্ব দেশের সাংবাদিক চৌধুরী মঈনউদ্দিনের বাঙালি নিধনে সম্পৃক্ততার কাহিনি। প্রতিবেদনটি ঢাকা থেকে পাঠান নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা ফক্স বাটারফিল্ড, যা ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমস–এর ২ জানুয়ারি সংখ্যায় যার শিরোনাম ছিল, ‘বাঙালি হত্যায় এক সাংবাদিকের সম্পৃক্ততা’ [A journalist is linked to murder of Bengalis]

সংক্ষেপে প্রতিবেদনটি এমন—
অন্য সহকর্মীদের মতে চৌধুরী মঈনউদ্দিন কর্মস্থলে ছিলেন নম্র, ভদ্র ও বুদ্ধিমান যুবক। তাঁর মুখে ছিল সুন্দর করে ছাঁটা দাঁড়ি। মাঝে মাঝে ডানপন্থী মুসলিম রাজনৈতিকদের টেলিফোন আসা ছাড়া তার মাঝে লক্ষ্য করার মতো কোনো ব্যতিক্রম ছিল না।
কিন্তু গত কিছুদিনের তদন্তে দেখা যায়, সেই ফোনগুলো ছিল অর্থপূর্ণ। মঈনউদ্দিনকে ধর্মান্ধ মুসলমানদের একটি গোপন সংগঠনের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা কমান্ডোদের মতো কাজ করত, যারা শত শত বিশিষ্ট বাঙালি অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবীদের হত্যা করে ঢাকার অদূরে একটি ইটখোলায় ফেলে রেখেছিল।
কালো সোয়েটার ও খাকি প্যান্ট পরিহিত আলবদর বাহিনী যুদ্ধ শেষের গত তিন রাত যাবৎ তাদের শিকার ধরে আনে, যা শেষ হয় ১৭ ডিসেম্বর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী যারা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেছেন তাদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করা। অনেক বাঙালিই মনে করেন, যুদ্ধ শেষ হতে আরও কিছু সময় লাগলে আল-বদর বাহিনী আরও সফলভাবে এই কাজটি করতে পারত। বধ্যভূমিতে প্রায় ১৫০ জনের লাশ পাওয়া যায়, যাদের হাতের আঙুল কাটা ছিল, নখ ওপড়ানো ছিল। আরও শত শত মানুষকে আশপাশের ২০টি গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে। অনেক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, আল–বদর বাহিনী সরাসরি পাকিস্তানি সেনাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর টেবিলে আল-বদর বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়ার নথি পাওয়া গেছে। ক্যাপ্টেন তাহির ছিলেন আল-বদর বাহিনীর প্রধান পরিচালক। তিনি বাঙালিদের আতঙ্কগ্রস্ত করতে বিহারিদের ব্যবহার করেছেন। এদের টেবিলে সাংবাদিক নিজামউদ্দিনের আহমেদের নাম লেখা কাগজ পাওয়া গেছে এবং পাশে বিশেষ চিহ্ন আঁকা ছিল। এই হত্যাকাণ্ডগুলো কিছু সূত্র রেখে গেছে। তারা রাতের বেলায় কারফিউ চলাকালে তাদের শিকার ধরেছে। তারা কখনো তাদের পরিচয় দেয়নি। তারা হত্যা করেছে নির্জন এলাকায়, যেখানে ব্যাপক পাহারা রাখা ছিল। ইটখোলার আশপাশে বাসিন্দারা বলেছে, তারা খাকি প্যান্ট আর কালো সোয়েটার পরা আল-বদর বাহিনীর সদস্যদের লোকজনকে চোখ বেঁধে লাইন দিয়ে আনতে দেখেছে। কিছু মানুষ যারা কোনোভাবে বেঁচে গেছে, তারা সাংবাদিকদের কাছে তাদের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। (চলবে)

লেখক: গল্পকার, কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার
ইমেইল: [email protected]