জয়তু স্বপ্ন

হাডসন নদী। যে নদী রাশি রাশি জল ধারণ করে আছে নিজের করে। প্রতি ফোঁটা জলকে নিজের কোলে–পিঠে নিয়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে। বোবা প্রকাশে শুধু কী চিহ্ন বয়ে চলছে। দুই শতকে নিজেকে মেলে দিয়ে দুনিয়ার সব প্রান্তের নানা জাতির ভাগ্য বদলের সূচনায় নিজেকে জড়াল। আজ অবধি তা চলছে। আজও কাউকে বলেনি, হে পথিক, তুমি এবার থেমে যাও। আমি আর কাউকে ধারণ করতে পারছি না। এখনো হাডসনের তীরে আসে কবি, গায়ক কিংবা চিত্রকর। তেমনি এক কথার চিত্রকর এসে জায়গা নিল সবার অগোচরে।

শুরুতে জীবনকে সে যতটুকু জানত, তার চেয়ে ঢের বেশি জানিয়ে দিল, শিখিয়ে দিল হাডসনের মায়াবী দুই তীর। শুরুতে সুখের আবহে ভেসে ভাবল স্বর্গ বুঝি! না তা নয়। জীবনসংগ্রামের মূল পিকচার কিংবা তৈলচিত্রের পুরো নমুনা এই হাডসনের পাড়ে বড্ড শক্ত। বড়ই নির্মম। দুচোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া কালের দৈত্য। পরিবারের নিরাপত্তা, দুমুঠো আহারের আয়োজন এত সহজ কাব্য নয়। শক্ত ব্যাকরণে ঠাসা। তবুও কেউ থামে না, এগিয়ে যায়। স্বপ্ন দেখে অন্যজনকে দেখায়। সময় গড়িয়ে যায়। সবকিছুতে থিতু আসে।

সন্তানেরা বুঝতে শেখে, কী করলে ভদ্র ও সমাজের একজন হয়ে থাকা যাবে। নিজেদের মতো পথ বেছে নেয়। এবার তাদের নিজের করে চলা। তবে একটি বিষয় এরই মধ্যে জেনে নিয়েছে সন্তানকুল। জীবন অর্কেস্ট্রাতে সব যন্ত্র সমান সুরে বাজে না। নিজে উদ্যোগী হয়ে বাজাতে হয়। জীবনের অঘোষিত শেষ অংশের ভাবনা প্রকৃতির দেওয়া অফুরন্ত সুখ আর রহমতে ভাসা শখ মতো যেমন খাবারের সংস্থান হয়, তেমনি আছে নিরবচ্ছিন্ন খরচাপাতি জোগানের উৎস। পরিবারে নতুন সদস্য সব আনন্দের হাজারো ভল্টের রঙিন ঝাড়বাতি। সারা ঘরময় ছুটে বেড়ান আর পরিবারের সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। কুদরতি আনন্দের মহাসাগরে থাকার অবিরাম চেষ্টা সর্বদাই চলমান। ব্যক্তিগত জীবনের পুরো অংশই শতভাগ সন্তুষ্টির পাঠ্য বই, অনুসরণ করে চলা। উল্টাপাল্টা গল্প শোনা যায়। তবে এর কোনো ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বাস্তব জীবনে নেই বলেই এ আনন্দ। কিংবা পূর্ণ পরিতৃপ্তি।

পারিবারিক ধর্মীয় চর্চার সব সুফল একতরফা পাওয়া গেল। প্রাত্যহিক অনুশীলনের পর চলত আরও বাড়তি ইবাদত। ধীরস্থির চিন্তা–ভাবনায় অনেক আগাম সতর্কবাণী যখন শুনলাম তখন অনেক দেরি। এরপর হিমালয় সম বিশ্বাস ছিল। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি, এত বিশ্বাস? যদি এদিক–সেদিক কিছু একটা হয়ে যায় কী হবে। উত্তর এল, তোমার প্রতি নিশ্বাস যার নিয়ন্ত্রণে তার হুকুম ছাড়া কিছুই চলবে না। চাহনিতে অজানা শাসনের ছাপ। ঢং করে ডাকি পিরানি। আলামত দু-একটা পাওয়া যায়নি। তাই বা বলি কী করে। মনে মনে বলি, চল আর আছিই বা কয়দিন। চলুক বাকিটা সময় এভাবেই। যে রূপে পেরিয়েছি গত ৩৩ বছর। বয়স ব্যবধানের একজন বন্ধুসম প্রিয়জন আছেন। সংবাদ সৃষ্টির ফর্মুলাতে যার হাত অনবদ্য। তার মাঝে খবর তৈরির সহজলভ্য জোগান থাকে। চুম্বক স্বভাবে আকর্ষিত উদ্ভিদ রাশির সমূহ প্রভাব নিয়ে সর্বত্র বিচরণ জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বা মানবতা লুণ্ঠনের অপরাধের শাস্তির দাবিতে অগ্র সৈনিকদের কাছে মডেল পুরুষ ছিলেন তিনি। লেখার মসলা সংগ্রহ করতে হয় নিবেদিত মাঠ কর্মীদের সুচিন্তিত মতামত থেকে। লেখনীর আবেগীয় তরঙ্গ মালায় যে ঢেউ উঠে, সেই ঢেউয়ের মাথায় ভেসে আসা বিজয় পতাকাবাহী এর আপসহীন অকুতোভয় সাংস্কৃতিক ও সমাজ কর্মী হয়ে যান খবরের শিরোনাম। স্যালুট হে সাহসী সৈনিক। আপনার এই সংগ্রাম গাঁথা যেন জনগণের জীবনে রয়ে যায় চিরঞ্জীব। হয় যেন আগামী দিনের তরুণ–তরুণীদের স্বপ্নশিখা।
স্মৃতির মিনারে আজও অনেকের চোখে ভাসে সাদা পাড়ের লাল ফুলেল জমিনের শাড়ি পরিহিতা সেই শিল্পীকে। শিল্পীর চতুরমাত্রিক প্রতিভার স্বরূপ দর্শনে অভিভূত। একঘেঁয়ে জীবন মরুভূমিতে যেন স্বচ্ছ স্ফটিকসম শীতল জলের কভু শেষ না হয়ে যাওয়া রঙিন ফোয়ারা। সবুজ গালিচায় বেড়ে ওঠা স্নিগ্ধ ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকা মনোরম মরু উদ্যান। এই অনুভূতিতে শুধুই আছে শ্বেত শুভ্রসম শ্রদ্ধা আর অগাধ ভালো লাগার কোটি কোটি নৈবেদ্য। চাওয়া–পাওয়ার সব হিসাবে কেউ হয়তো তৃপ্ত নয়। কিছু চাওয়ার উচ্চতা হয়তো হিমালয় পর্বতসম। তাই বলে কি হিমালয়ের কাছে প্রার্থনার অর্ঘ প্রদান করা যাবে? কোনো কোনো মিথ লেখক এখনো বলে থাকেন, আটলান্টিস নামক মহাদেশ ও সভ্যতা দুটোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

সেই বাস্তবতা মেনে কিছু কাল্পনিক কবি–লেখক সত্য না মেনে লিখে চলছেন অমর কাব্য উপন্যাস। নয়তো মধুর সংগীত। তাদেরই একজন হয়ে আমিও বলে যাই, জয়তু স্বপ্ন। জয়তু কাল্পনিক ভালো লাগার অবাস্তব ভালোবাসা। গল্প কাহিনির ভাবান্তর। যাতে কোনো চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।