ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে খিলাফত আন্দোলন

সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ
>

আমাদের বয়সী যাঁদের ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগের জন্ম, তাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলমানদের অনেক ভূমিকা ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতো। ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে, ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা আর চোখে না পড়ার ফলে বয়স্কদের কাছেও সেসব স্মৃতিও আর বেঁচে নেই। ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরও যে অনেক মূল্যবান অবদান আছে, সে সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই ধারাবাহিক লেখা

তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ (১৮৭৬-১৯০৯) পশ্চিমা জগতের আক্রমণ ও তাদের হাতে পরাস্ত ও বিধ্বস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং নিজের দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্রবাদী বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে একটি বিশ্ব-ইসলামী ঐক্যজোট প্যান-ইসলামিক প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দল বাড়ানোর জন্য তিনি ভারতীয় মুসলমানদের কাছে জালালুদ্দিন আফগানি নামে একজন দূত পাঠান। সে সময় খলিফা হিসেবে অটোমান সুলতান ছিলেন পুরো বিশ্বের সুন্নি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা। অবশ্য এই কর্তৃত্ব কখনো সত্যিকার অর্থে প্রয়োগ করা হয়নি। যাই হোক, অটোমান সম্রাটের পরিস্থিতি জানার পর তাঁর আবেদনে ভারতীয় মুসলমানদের মনে সহানুভূতি জেগে ওঠে।
বহু মুসলিম ধর্মীয় নেতা খলিফার এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করে। মুসলিম নেতা মৌলানা মেহমুদ হাসান অটোমান সম্রাটের সহায়তায় ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এরপর সুলতানের বিরুদ্ধে এক গণঅভ্যুত্থানের ফলে খলিফার আসল ‘পাওয়ার’ তুর্কি যুবশক্তির হাতে চলে যায়।

রাজ্য ভাগাভাগি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে তুরস্ক মিত্রশক্তির (আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া) বদলে অক্ষ শক্তির (জার্মানি, জাপান ইত্যাদি) দলে যোগ দিয়েছিল এবং এই জোট যুদ্ধে গোহারা হেরেছিল। ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তির ফলে তুরস্কের রাজনৈতিক প্রাধান্য ও সেই সঙ্গে রাজ্যের পরিসীমা অনেকাংশে সীমিত হয়। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা অটোমান সুলতানের ‘খলিফা’ পদবির মর্যাদা রক্ষা করবে। কিন্তু পরে তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখতে অস্বীকার করে। বরং ‘সেভরেস’ চুক্তির বলে তারা তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও মিশর ছিনিয়ে নেয়।

এদিকে তুরস্কের অভ্যন্তরেই একটি প্রগতিশীল, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ বিপ্লবীদের পরিচালিত তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ‘সেভরেস’ চুক্তি বাতিল করা হয় এবং ১৯২৩ সালে ‘লাওসেন চুক্তি’ নামে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আতাতুর্কের পুনর্গঠন পরিকল্পনায় ১৯২৪ সালে ‘খলিফা’ পদটি বিলুপ্ত করা হয় এবং তাঁর ক্ষমতা তুরস্কের ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’-র কাছে ন্যস্ত করা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় খিলাফত আন্দোলন
খিলাফত আন্দোলন নিয়ে সারা মুসলিম বিশ্বে দারুণ হইচই উঠলেও একমাত্র ভারতেই এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় ও রাজনৈতিক নেতারা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। তুরস্কের খলিফার প্রতি সমর্থন আদায় এবং সেই হেতু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মাওলানা মুহাম্মদ আলী জোহর নামে একজন প্রখ্যাত অক্সফোর্ড শিক্ষিত মুসলিম সাংবাদিককে চার বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেক দেশ তুরস্কের অধীনস্থ ছিল। মুসলিম জগতের নেতা হিসেবে তুরস্কের সুলতানকে ‘খলিফা’ বলার জন্য তাঁর শাসনব্যবস্থাকে ‘খিলাফত’ বলা হতো। যুদ্ধে তুর্কিদের গ্রুপ হেরে গেলে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা খিলাফতের অস্তিত্বের ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং এটি রক্ষার জন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোর কাছে আবেদন-নিবেদন করেন। কিন্তু ইউরোপীয় নেতারা খিলাফত রক্ষা করতে সম্মত হননি। বরং তারা উল্টো ব্রিটিশ বাহিনীতে কিছু তুর্কি ঢুকিয়ে তাদের সহায়তায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ব্যবস্থা করে। তাই ভারতের খিলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও অনুসারীদের কাছে খিলাফত কেবল একটি ধর্মীয় আন্দোলন নয়, বরং তুরস্কের সংগ্রামী মুসলমানদের সঙ্গে একাত্মতা প্রদর্শনই এর প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।

এই আন্দোলনে যোগ দেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও তার ভাই মাওলানা শওকত আলী। যোগদানকারী অন্যান্য মুসলিম নেতার মধ্যে পীর গোলাম মুজাদ্দিদ সারহাদি, শেখ শওকত আলী সিদ্দিকী, ড. মুক্তার আহমেদ আনসারী, রইস-উল-মুহাজিরিন ব্যারিস্টার জান মুহাম্মদ জুনেজো, হাসরত মোহানী, সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও ড. হাকিম আজমল খান প্রমুখ। এঁরা সবাই মিলে ‘অল ইন্ডিয়া খিলাফত কমিটি’ গঠন করেন। ভারতের লখনৌতে জমিদার শওকত আলী সিদ্দিকীর ‘হাঠ-এ-শওকত’ কম্পাউন্ডে এই সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় হয়। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ও খিলাফত রক্ষার ব্যাপারে নেতাদের সবাই নিজ নিজ প্রভাব ও শক্তি ব্যবহার করা শুরু করেন। ১৯২০ সালে তাঁরা খিলাফতের একটি মুখপত্র প্রকাশ করেন। এতে খিলাফত রক্ষার জন্য ব্রিটিশদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং ভারতীয় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের কাছে জবাবদিহি চাওয়া হয়। বাংলার খিলাফত কমিটির মধ্যে ছিলেন মোহম্মদ আকরাম খান, মনিরুজ্জামান ইসলামবাদি, মুজিবুর রহমান খান ও চিত্তরঞ্জন দাশ।

১৯২০ সালে খিলাফত নেতৃবৃন্দ ও ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং জাতীয়তাবাদী/স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে একটি জোট তৈরি হয়। কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী ও খিলাফতের নেতারা মিলে খিলাফত ও স্বরাজ আন্দোলনের জন্য একসঙ্গে কাজ ও সংগ্রাম করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। ব্রিটিশদের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়াতে নিবিষ্ঠ ছিলেন এই খিলাফতি নেতারা। অসহযোগ আন্দোলনের একটি বড় অংশ হয়ে দাঁড়ায় এই বিষয়টিও। এদের কাজ ছিল দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে আইন অমান্যকারী একটি গণআন্দোলন। খিলাফতবাদীদের গান্ধী ও কংগ্রেসের অহিংসা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ এই সমর্থন স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এর মধ্য দিয়ে খিলাফত নেতারা বিশেষ করে ড. আনসারি, মৌলানা আজাদ ও হাকিম আজমল খান ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীর খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এই নেতারা ও অন্যরা মিলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীন শিক্ষা ও সামাজিক নবজীবন প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৯২০ সালে ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে একটি ‘প্রিমিয়ার সেন্ট্রাল’ ইউনিভার্সিটি।

এই ব্যবস্থার ফলে অসহযোগ অভিযান এই প্রথমবার সফল হয়। এদের কর্মসূচি শুরু হয় আইন পরিষদ, সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিদেশি দ্রব্য বর্জনের মাধ্যমে। সরকারি কাজকর্ম, সরকারি তকমা বা উপাধি ও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ বর্জনও ছিল এই কর্মসূচির অংশ। এভাবে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক বিক্ষোভ, হরতাল ও নাগরিক অবাধ্যতা (সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স) ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দু–মুসলিমদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের এই প্রতিজ্ঞা ও কার্যক্রম ছিল শান্তিপূর্ণ। এই আন্দোলনে গান্ধী ও আলী ভাইদের সঙ্গে অন্যান্যরা ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হন। মাওলানা মঞ্জুর আহমেদ ও মাওলানা লুৎফুল্লা খান দানকাউরির নেতৃত্বে পাঞ্জাবের আরেক গ্রুপ ‘তেহরিক-এ খিলাফত’ গড়ে তুলে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিল সারা ভারতে, বিশেষ করে পাঞ্জাবের সিরসা, লাহোর ও হরিয়ানা এলাকায়।

খিলাফত আন্দোলনের পতন
আদর্শ নিয়ে মতভেদের ফলে খিলাফতিরা তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে খিলাফত আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। একদল খিলাফতের সঙ্গে লেগে থাকলেও তাদের এক পক্ষ চলে যায় কংগ্রেসে ও বাকি অন্য পক্ষ মুসলিম লীগে যোগ দেয়। শেষ ধাক্কাটা এসেছিল খোদ তুরস্ক থেকেই। সে সময় কামাল আতাতুর্কের বাহিনী স্বাধীন তুরস্ককে একটি উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে জেগে ওঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ শুরু করে। আতাতুর্ক তুরস্ক থেকে খলিফার পদের অবসান ঘটান এবং ভারতীয়দের কাছ থেকে কোন সাহায্য লাগবে না—এমন কথা ঘোষণা করেন।

রাজনৈতিক দিক থেকেও খিলাফত আন্দোলন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সৈয়দ আতাউল্লা শাহ বুখারি ও চৌধুরী আফজাল হকের সহায়তায় ‘মজলিস-এ-আহরার-এ-ইসলাম’ নামে একটি দল গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ড. আনসারী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান মহাত্মা গান্ধী ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়ে যান। আলী ব্রাদার্স- মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী মুসলিম লীগে যোগ দেন। এই দুই ভাই মুসলিম লীগের আন্দোলনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করার ব্যাপারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন, যার পরিণতিতে গঠিত হয়েছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। অবশ্য খলিফা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী হবে—তা নিয়ে ১৯৩১ সালে জেরুজালেমে একটি দুর্বল সভা হয়েছিল, যার কোন ভবিষ্যৎ নির্দেশনা ছিল না।

শেষ কথা
ভারতের খিলাফত আন্দোলন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ আছে। বিপরীত পক্ষের সমালোচকদের মতে, এটি একটি মুসলিম-সর্বস্ব, মৌলবাদীদের কর্মসূচি—যেটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচি থেকে বহুলাংশে আলাদা। এই সমালোচকেরা আরও বলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে খিলাফতের আঁতাত আসলে পরস্পর সুবিধাভোগীদের একটি সন্ধি—অ্যা ম্যারেজ অব কনভেনিয়েন্স। খিলাফতের সমর্থক পক্ষের মতে, খিলাফত আন্দোলন ছিল আগুনের প্রথম একটি স্ফুলিঙ্গ, যেটি অসহযোগ আন্দোলনের দিকে চালিত হয়েছে এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উন্নতির চরম পরাকাষ্ঠা তৈরি করতে সাহায্য করেছে।

আবার পাকিস্তানপন্থী ও মুসলিম লীগারদের মতে, একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য খিলাফত আন্দোলনের ভূমিকা বিশাল। তাই আলী ভাতৃদ্বয়কে যেমন পাকিস্তানের স্থাপতি হিসেবে দেখা হয়, তেমনি ড. আনসারী, মৌলানা আজাদ ও হাকিম আজমল খানকে ভারতে ‘ন্যাশনাল হিরো’ হিসেবে সম্মান করা হয়।