শান্তি পুরষ্কার পেয়ে অশান্তির 'গুরু'

বারাক ওবামা ও শিমন পেরেজ
বারাক ওবামা ও শিমন পেরেজ

বেশ আগে, ছেলের সঙ্গে গল্পের সময় অনবধানতাবশত একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলাম। ‘মিছকা শয়তান’।

সিলেটী শব্দ। এর ভালো বাংলা কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধা আমার মধ্যেও। ইব্রাহিম চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলাম। উত্তর এল ‘শঠতা’। সঠিক অর্থ ‘শঠতা’ কিনা জানি না, তবে এটুকু জানি, কেন, কী কারণে এটা ব্যবহার করা হয়।
বাইরে ভালো মানুষ, ভেতরে বজ্জাতের হাড্ডি—এ ধরনের চরিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠে। ভদ্র বেশ, কেউ ঠাওর করতে পারে না তার ভেতরটা দুষ্টুমিতে ভরা। আমার ছেলে জানতে চাইল না, এর মানে কী? তবে অনুমান করলাম, সে বুঝে নিয়েছে, খারাপ কিছু বোঝাতে চেয়েছি আমি।

আমরা আলাপ করছিলাম আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে। ট্রাম্প কী করে প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন, সে অঙ্ক সে এখনো মিলাতে পারেনি।

তবে বেফাঁস মন্তব্য করেছিলাম ওবামাকে নিয়ে। ওবামাকে যারা পছন্দ করেন, গর্বও বোধ করেন, তারা আমার এ মন্তব্যে খুশি হওয়ার কথা নয়।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও যায়—ওবামাকে নিয়ে সে দিন যা বলেছিলাম, সব মনে রেখেছে ছেলে।

নভেম্বরে থ্যাংকসগিভিং পার্টির আড্ডা এক বাসায়। বৈঠকখানায় বিভিন্ন বয়সী আত্মীয়দের মধ্যে ট্রাম্প ও আমেরিকান রাজনীতি নিয়ে জম্পেশ আলোচনা চলছিল। আমি ছিলাম না। রুমে ঢুকতেই ছেলের এক প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
বলল, আচ্ছা তুমি বলেছিলে ওবামা ‘মিছকা...’। ঠিক কিনা?
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ বলেছিলাম।
ছেলে হাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলেছিলাম না?
সবাই হা করে তাকিয়ে আমার দিকে। কেউ প্রস্তুত নন এমন কথা শোনার।
বললাম, কেন বলেছি সে কারণ তো অনেক লম্বা। বুশ করেছেন দুটি যুদ্ধ, আর ওবামা তিনটি।
যুদ্ধবাজ কাকে বলবেন?

এ নিয়ে সেদিন আর কথা হয়নি। টার্কি আর রকমারি মজাদার খাবারে সবাই আনন্দের মুহূর্ত কাটাই।

গত সপ্তাহে গণমাধ্যম সরগরম থাকে হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে অং সান সু চির হাজিরা নিয়ে নানা খবর আর মন্তব্যে। আমিও ফিরে পাই পুরোনো রসদ নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার। প্রসঙ্গ আসে ওবামারও। আসে নোবেলেরও।
এর আগে একটি ছবির কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

এই সপ্তাহে এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমার পাশে বসা দুজন ডাক্তার স্মার্টফোনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী দেখছিলেন। আমি ব্যস্ত ছিলাম আমার ফোনে। একজন আমাকে ডাকলেন, ফোনটা আমার সামনে ধরে বললেন, দেখুন তো চিনেন কিনা। দেখলাম একটি ছবি, ঐতিহাসিক। এক ফ্রেমে হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইয়াসির আরাফাত, মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও সাদ্দাম হোসেন। অনুমান করছি, ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে ছবিটি তোলা। ছবির বিশেষত্বের কথা মনে করিয়ে দিলেন ডাক্তার সাহেব। তাঁরা পাঁচজনই পরলোকগত এবং পাঁচটি মৃত্যুই অস্বাভাবিক। দুজন খুন, দুজন ফাঁসি এবং একজন রহস্যজনক বিষক্রিয়ায়। ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়।
এই লেখা যখন লিখছি (১৮ ডিসেম্বর, ’১৯), তখন ব্রেকিং নিউজ এল স্ক্রিনে।

হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসিত হয়েছেন। সম্পূর্ণ পার্টি লাইনে ভোট। ডেমোক্র্যাটরা হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে ট্রাম্প ক্ষমতা হারাচ্ছেন না। সিনেটে তা পাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রিপাবলিকানরা সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

ক্ষমতা না হারালেও একটা কলঙ্ক অঙ্কিত হলো তাঁর জীবনে বা প্রেসিডেন্সিতে। আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে মাত্র দুজন প্রেসিডেন্ট হাউসে অভিশংসিত হয়েছিলেন, পরে সিনেটে গিয়ে রক্ষা পান। তাঁরা হলেন অ্যান্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই পদত্যাগ করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন।

বিল ক্লিনটন খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মনে পড়ে, মনিকা লিউনস্কি ও অভিশংসন প্রক্রিয়ার সময় সিবিএসে ডেভিড লেটারম্যানের ‘ডেইলি শো’ দেখছিলাম। ডেভিড লেটারম্যান বলছিলেন, কেলেঙ্কারির পর যেখানে জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কথা, সেখানে ক্লিনটনের আরও বেড়েছে। সে মুহূর্তে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ৬৭ ভাগ। অবিস্মরণীয়!
আবারও ফিরে আসি নোবেল প্রসঙ্গে।

পুরস্কার অর্জনের পর শান্তি দূতদের কেউ কেউ অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে নোবেলের দ্যুতিকে যে নিভিয়ে দিচ্ছেন, দাতারা নিশ্চয়ই তা জানেন। এ নিয়ে বহু কথা হয়েছে, লেখা হয়েছে বিস্তর।

লেখা হয়েছে অং সান সু চিকে নিয়েও। নতুন আর কী বলার আছে? মিয়ানমারের যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের কাছে কথা বলে বলে যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করলেন, সেই জান্তার পক্ষেই সাফাই গাইতে গিয়েছিলেন হেগে। ওখানে যাওয়ার আগে অসলোতে গিয়ে পদকটি ফেরত দেওয়াই হতো সংগত।

শুধু কী সু চি? ইসরায়েলের শিমন পেরেজ কী করলেন? নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের পর ছিলেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। তার সময়ে কী কোন ফিলিস্তিনি খুন হননি? নির্বিচারে মারা যায়নি নারী-শিশু? জেল-জুলুম-নির্যাতন হয়নি? হয়নি বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ? ইতিহাসে লেখা আছে তার উত্তর।

বারাক ওবামাকে নিয়ে গর্ব আছে প্রচুর আমেরিকাবাসীর। তাঁর মেধা, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, বাগ্মিতা, রাষ্ট্রনায়কোচিত আভিজাত্য—সবই আছে। আছে জনপ্রিয়তাও। বাঙালি কমিউনিটিতেও তাঁর বিপুল সমাদর।

এমন এক সময় ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যখন বুশের যুদ্ধ-বিগ্রহ আর আর্থিক অভাব-অনটনে হতাশায় নিমজ্জিত ছিল মানুষ। শুধু আমেরিকাতেই নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ খুঁজছিল কিছু আশা, কিছু আলো। ওবামা সেই আশার কথা শোনালেন, মশাল জ্বালালেন সেই আলোর। মানুষ তাঁর পেছনে সমবেত হলো। দুনিয়া জুড়ে শান্তি ও স্বস্তির বাতাস বইতে থাকল। এই বুঝি ধরায় নেমে আসবে শান্তির সুবাতাস। শুরু হলো আরব বসন্ত।
এই রূপ এক আবহাওয়ায় তাঁর কপালে জুটল নোবেল শান্তি পুরস্কার।
তারপর। তারপর কি হলো?

বুশের দুটি যুদ্ধের বিপরীতে ওবামার ঘোষিত-অঘোষিত তিনটি যুদ্ধ, যার রেশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ব।

বুশের শুরু করা আফগান যুদ্ধের অবসান এখনো হয়নি। এটি আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ। শতসহস্র কোটি ডলার খরচ করেও কোন কুল-কিনারা মিলছে না। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, আফগান যুদ্ধের সব খবর মার্কিন জনগণকে জানানো হচ্ছে না। কারও কারও ধারণা, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করলে দেশটি আবার তালেবানের দখলে চলে যাবে। মারণাস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে ইরাক দখল, সাদ্দামের ফাঁসি, আইএসের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। ইরাকের বিভীষিকার রাত এখনো পোহায়নি। এ সবই বুশের অবদান!
আর ওবামা?

নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর শান্তিতে (?) যে সব অবদান রাখলেন তার তালিকা দীর্ঘ। অবশ্য তাঁর সঙ্গী ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। লিবিয়া অভিযান ও গাদ্দাফিকে হত্যা তাঁর বড় অবদান। তেল সমৃদ্ধ একটি সুন্দর দেশ এখন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ আর কতকাল চলবে কেউ জানে না। ওবামা ও হিলারির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে সিরিয়া ও ইয়েমেনের যুদ্ধযাত্রা, যার ইতি টানছে না কেউ। এ দুদেশের মানবতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। সিরিয়ার শরণার্থীদের প্লাবনে ইউরোপে তোলপাড়। প্রাচীন সভ্যতার ধারক সিরিয়া আজ বিধ্বস্ত। চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট অঞ্চলজুড়ে আইএসের যে উত্থান হয়েছিল, তার জন্য দায়ী করা হয় ওবামা-হিলারির ব্যর্থ নেতৃত্বকে।

আরব বসন্তের ফসল কেউ ঘরে তুলতে পারেনি। মোবারক–উত্তর মিসরের নির্বাচিত সরকারের উৎখাতে কার ইন্ধন ছিল? বাহরাইন ও সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের গণজাগরণ নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। এ দৃশ্য কে উপভোগ করেছে আনন্দের সঙ্গে?
তালিকা দীর্ঘ করব না।

অবশ্য পরে ওবামা স্বীকার করেছেন, লিবিয়া যুদ্ধ ছিল তাঁর ভুল। এখন বলে কী লাভ? যা ক্ষতি তাতো হয়েই গেছে। গরু মেরে জুতা দানের আর কী দরকার! দুটি কাজ তাঁর ভালো ছিল, যা ট্রাম্প বয়ে নিতে রাজি হননি। এক. ইরানের পারমাণবিক চুক্তি ও দুই. বিশ্ব জলবায়ু চুক্তি। দুটি থেকেই আমেরিকাকে বের করে এনেছেন ট্রাম্প।

সম্প্রতি ট্রাম্প আক্ষেপ করে বলেছেন, আমি এত এত ভালো কাজ করলাম, নোবেল পেলাম না। অথচ ওবামা এক বছরের মাথায়ই তা পেয়ে গেলেন! নোবেল পাওয়ার পর তিনিও কী বিধ্বংসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন? কে জানে?
ইতিমধ্যে রাজার মতোই দেশ চালাতে শুরু করেছেন ট্রাম্প। কলমের এক খোঁচায় একবার জেরুজালেম, আরেকবার গোলান হাইটস ইসরায়েলকে দিয়ে দিচ্ছেন। রাজার মতোই মাঝে-মধ্যে হুকুম-আহকাম জারি করছেন। অথচ আমেরিকার সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট রাজা নন। অবশ্য ট্রাম্পের একটি দিক ভালো লাগে, তাঁর মধ্যে লুকোচুরি নেই, রাখঢাকও নেই। যা বলার বা যা করার সোজাসাপ্টা বলেন এবং করেনও।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।