এমন মানুষকে হারিয়ে বড় অসহায় লাগে

নিউইয়র্কে সিলেট বিশ্ব সম্মেলনে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। পাশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) সি আর দত্ত
নিউইয়র্কে সিলেট বিশ্ব সম্মেলনে স্যার ফজলে হাসান আবেদ। পাশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) সি আর দত্ত

কাজের ছেলে কাজ শেষে চলে গেলেন। এমনটি চেয়েছিলেনও তিনি। জীবনটা কর্মের। নিজের জৌলুশ ছড়ানোর নয়। কাজ শেষ করলেই চলে যেতে হয়। প্রথম আলোর সম্পাদকের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমি আমার কাজটা করার চেষ্টা করেছি। জীবনের শুরুতেই নিজের কাজটি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তিনি। সেসব কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। পরিণত বয়সে এসে পেছনে ফিরে দেখেছেন নিজের গড়া সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের মুকুট তিনি কখনো নিজের বলে দাবি করেননি। নীরবেই চলে যেতে চেয়েছেন সারা বিশ্বের বেসরকারি উন্নয়নের মুকুটহীন এই রাজা। ভাবটা তাঁর এমনই ছিল। তিনি স্যার ফজলে হাসান আবেদ। চলে গেলেন নিজেকে নিয়ে নির্মোহ থাকার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই কাজের মানুষটি।

এই প্রস্থান নিয়ে কোন বাদ্য বাজানোর দরকার নেই। কর্মহীন বিলাপেরও প্রয়োজন নেই। মৃত্যু আসন্ন জেনেও কোন ধরনের কোলাহল হোক, তা তিনি চাননি। স্যার ফজলে হাসান আবেদ আমাদের চেনা আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাদের একজন ছিলেন। কোন বিলাপ আর কোলাহল ছাড়াই তাঁর স্মৃতির শ্রদ্ধায় নতজানু সারা বিশ্ব। ছড়িয়ে থাকা তাঁর অনুসারী–অনুরাগীরা আজ নীরব কান্নায় তাঁর অন্তিমযাত্রায় ব্যথাতুর হচ্ছেন।

বেশ কিছুদিন থেকে অসুস্থ। কাছের লোকজন অনেকটাই তাঁর এই অন্তিম প্রস্থান নিয়ে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কয়েক মাস আগে ফিলাডেলফিয়া থেকে ড. জিয়াউদ্দিন ফোন করলেন। কাঁপা গলায় জানালেন, আবেদ ভাইয়ের ওপর একটা লেখা প্রথম আলোতে ছাপার জন্য দিচ্ছেন। প্রথমে মনে করেছি, উত্তর আমেরিকা সংস্করণের জন্য। আমি খুশি হই। ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু সাদেক ভাইয়ের (ডা. জিয়া) গলায় উৎকণ্ঠা টের পাই। জানালেন, ঢাকায় প্রথম আলোতে লেখাটি ছাপা হলে রোগশয্যায় থেকেও লেখাটি তাঁর চোখে পড়বে। কখনো নিজেকে নিয়ে কোথাও কোন প্রশংসা হোক, এমন কাজে তাঁর সায় ছিল না। তাঁর নিজেকে নিয়ে নির্মোহ অবস্থান রীতিমতো প্রবাদ হয়ে আছে।

সাদেক ভাইয়ের কাছ থেকে লেখাটি পাই। দ্রুত ছাপানোর তাগিদ দেন। বুঝতে পারি, কোথাও সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার তাগিদ আছে। সাদেক ভাই নিজে স্যার ফজলে হাসান আবেদের কাছের লোক ছিলেন। দেশের সংস্করণে ছাপানোর জন্য সরাসরি সম্পাদক বরাবরে তাগিদ যায়। দ্রুতই ছাপা হয় স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে লেখা। ছাপা হয় ‘ফজলে হাসান আবেদ এক আলোকবর্তিকা’।

সাদেক ভাই জানিয়েছিলেন, জীবন মৃত্যুর সঙ্গে তখন লড়াই করছিলেন তিনি। প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁকে নিয়ে লেখাটি পড়ে শোনানো হয়। তখনই ভাবছিলাম, আজীবন নিজেকে নিয়ে নির্বিকার থেকে কাজ করেছেন। মানুষটিকে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসার কথাটা সামনে থেকে প্রকাশেরও সুযোগ পাইনি কোনো দিন।

সদ্য স্বাধীন দেশে দারিদ্র্য বিমোচন, গণশিক্ষা, নারী উন্নয়ন—এসব নিয়ে কথা শুনেছিলাম ফজলে হাসান আবেদের বক্তৃতায়। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ছিলেন যেহীন আহমেদ, আ ন স হাবিবুর রহমানসহ বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব। এদের দেখে, তাদের কর্মকাণ্ড অনুসরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন নিয়ে প্রথম ধারণাটি পাই। তখন আমাদের বোঝারও ক্ষমতা হয়ে ওঠেনি একজন স্বপ্নবিলাসী ফজলে হাসান আবেদকে।

বেসরকারি উন্নয়নের একজন কর্মী হিসেবে দেখেছি, তখন এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে ধারণা অনেকটা সন্দেহের। সব ধূম্রজাল মোকাবিলা করেই তাদের কাজ করতে হয়েছে। আমাদের মতো দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসব উন্নয়ন সংগঠকদের কাজের ব্যাপ্তি ঠিক পরিমাপ করার নয়।

বাংলাদেশের অজপাড়া গাঁয়ের লোকজন নলকূপের পানি পান করে। গ্রাম পর্যায়েও স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রায় শতভাগের কাছাকাছি। নারী উন্নয়ন, সমবায়সহ উন্নয়নের এসব সূচকে আশপাশের দেশ থেকে এগিয়ে থাকার জন্য এসব উন্নয়ন সংগঠকদের অবদান অপরিসীম।

‘স্যার’ সম্বোধন করা যেত না ফজলে হাসান আবেদকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থার প্রধানকে সবাই আবেদ ভাই বলেই সম্বোধন করতেন। বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় এই ‘ভাই’ সম্বোধনটা তাঁরাই চালু করেন। সামন্তবাদের উত্তরাধিকার, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ আর পরাধীনতার নিগড় পেরিয়ে আসা স্বাধীন বাংলাদেশের এ ঘটনাও অনেক বড় ছিল আমাদের কাছে।

২০১৭ সালে বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে নিউইয়র্ক এসেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। নিজের এলাকার লোকজনের সবার ‘ভাই’কে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। তিনিও এর–ওর কাঁধে ধরে কথা বলছেন বাড়ির পাশের ‘ভাইসাবে’র মতো। আমেরিকাসহ বিশ্বের বড় বড় নেতাদের সমীহের ব্যক্তি ছিলেন তিনি। উন্নয়নের যেকোনো আধুনিক পাঠে ‘ব্র্যাক’ নামটি উচ্চারিত হয়। উচ্চারিত হয় ইংল্যান্ডের রানির কাছ থেকে উপাধি পাওয়া ‘স্যার’ ফজলে হাসান আবেদ।

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার ২০ ডিসেম্বর সংখ্যার জন্য নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক সামসাদ হুসাম লিখেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে। জীবিত ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে লেখা শেষ লেখাটি ছাপা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। নিউজার্সিতে বসে ২০ ডিসেম্বর সকালে তীব্র শীতের মধ্যে পাওয়া সাদেক ভাইয়ের বার্তা। দিনব্যাপী শোকাতুর স্বজন, অনুরাগী, অনুসারীদের শোক আর শ্রদ্ধার বার্তা বিনিময়। মাটির খাঁটি সন্তান নিজের ব্যক্তি জীবনে কোন জৌলুশ চাননি ঠিকই। কিন্তু মানুষের মনে প্রভাব রেখে গেছেন অনেক জৌলুশের!

চলে গেলেন নীরবেই। তাঁকে নিয়ে আমরা কখনো কোন উচ্ছ্বাস দেখাইনি। মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে কোন বন্দনা হোক, হয়তোবা নিজেও চাইতেন না। হলেও বা কি? কাজের লোক কাজ করে চলে গেছেন। তাঁরতো কিছু যায় আসে না। যায় আসে আমাদের। এমন লোকদের হারিয়ে নিজেদের বড় অসহায় লাগে!

ইব্রাহীম চৌধুরী: আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।
[email protected]