জানালায়

ঘুম ভেঙে যায় প্রায়ই মাঝরাতে। খোলা জানালায় চোখ রাখতেই মনে হয় ওই দূরের চাঁদ যেন আমারই মতো একা প্রহরায় থাকে। এমন একটা সময় না পারি গান শুনতে, না পারি কারও সাথে ফোনে কথা বলতে। তবে বেশি বিরক্তি এলে জানালার কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসি। মাঝেমধ্যে গাড়ি যায়। কোনো গাড়িতে আবার মৃদু গানের শব্দ পাওয়া যায়।
আজ আমার ঘুম ভাঙেনি। তবে খুব সকালে জোরে চেঁচামেচির শব্দে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলাম। হঠাৎ কান্নার শব্দ পেয়ে জানালার কাছে যেতে দেখি একটি মেয়ে কেঁদেই যাচ্ছে, আর ছেলেটি বিদ্রূপ করে যাচ্ছে। হঠাৎ ছেলেটা গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আমি কিছু ভাবার আগেই মেয়েটিও ট্যাক্সিতে চলে গেল। মেয়েটির জন্য মায়া হলো। কিন্তু কিছুই ভাবতে বা করতে পারিনি।
আমার ব্যস্ত জীবন কেটে যাচ্ছে কোনো রকমে। আজ আমার ছুটির দিন। ঘরের সব কাজ শেষ করে বের হয়েছি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। খুব কাছের বন্ধু মাইশা, দারুণ গান করে। খোলা আকাশের নিচে আমরা কিছু বন্ধু হাসি-আনন্দ নিয়ে কাটালাম। সবাই এক হলে সময়টা যে দ্রুত চলে যায়, ভাবাই যায় না। সন্ধ্যা রাতে সালাদ, আর কিছু ফল নিয়ে আসি ঘরে। ক্লান্তি দূর করতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চেয়ারে বসে গান শুনছি। রাস্তার সাইড লাইটগুলোর আলো ধীরে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। চোখ মেলে জানালায় দেখি পাখির ঘরে ফেরার পালা, আর ঘন আঁধার যেন জেঁকে বসছে পুরো আকাশে।
আমার নাম দিশা। বন্ধুরা ভালো কিছু করলে আমাকে দশে দশ বলত। আর খারাপ করলে বলত ভারী দুর্দশা। কাউকে উপদেশ দিতে দেখলে বলত আলোর দিশারি। যা হোক, জানালার কাছে বসার একটি গোপন কারণ হচ্ছে, ভালোবেসেছিলাম দীপ্তকে। সেই কিশোরবেলার প্রেম। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় প্রেমটা ছিল খুব গাঢ়। প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো, কিংবা ইশারায় কথা হতো। তখন ছিল গরমের দিন। রাতে জানালা খোলা থাকত। আমি মশারির ভেতর থেকে ইশারায় কথা বলছি তার সঙ্গে। এমন সময় মেজ বোন এলেন। এমন বকা দিতে শুরু করলেন যে, সে প্রেমের সেখানেই সমাপ্তি। এখন আমার জীবনে একটা চেরা দাগ আছে। আর তা হলো আমি সিঙ্গেল মা। সুখী কাকে বলে জানি না। তবে আমার মেয়েকে মনে হয় ও খুব ভালো আছে।
যদিও একটি বিদেশি ছেলেকে বিয়ে করেছে। মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসে ওরা। কত কী যে আনে আমার জন্য। আমিও ভালোবাসা দিয়ে ওকে বেঁধে রাখি সব সময়। তামান্নাকে আমি টেমি বলেই ডাকি। একটু বিদেশি নামের প্রতি ওর ঝোঁক। দুপুরে টেমি কল দিয়ে বলল ক্রিসমাসের কিছু উপহার কিনবে। এ জন্য আমাকে মলে দেখা করতে বলল। আমিও ছুটি নিয়ে চলে এলাম। ওর সঙ্গে শপিং করে দুজনে বাড়ি ফেরার সময় ও বলল, ‘চলো মা আমার বাসায়। তুমি তো নিজে থেকে কখনো আসই না। এত কিছু আমি একা নিয়ে যেতে পারব না।’
কী আর করা। দুজন হাতভর্তি জিনিস নিয়ে এলাম ওর অ্যাপার্টমেন্টে। লক খুলে ও আগে ঢুকল। ঢুকেই চিৎকার শুরু করল। আমি ঠিক বুঝলাম না কী হয়েছে। ওর জামাই পিটার বের হয়ে ঝগড়া শুরু করল। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমি আসি এখন।’ টেমি কিছুই বলেনি। পরদিন ও ফোন করে স্যরি বলছিল বারবার এমন পরিবেশে আমাকে নেওয়ার জন্য ও নিজেকে ব্লেইম করছিল। সন্ধ্যায় বাসায় আসতে বললাম। ও রিফিউজ করল। কী করব? বড় হয়েছে, যা ভালো বোঝে, তাই করে। তিন/চার দিন পর একাই এসে হাজির। রাতে খাবার শেষে নিজে থেকে বলল, ‘মা আমার ভুল হয়েছে তোমাকে ওই দিন একা চলে যেতে দিয়ে। আমি কী আর করতে পারি বল?’
ও বলে চলে, ‘পিটারের আগের গার্লফ্রেন্ড জেকি। ওর সাথে আবার নতুন করে সম্পর্ক শুরু হয়েছে। আমি বাসায় না থাকলে ওরা দুজন বাসাটাকে বেছে নেয়। বল মা, কীভাবে আমি সহ্য করব।’ মনে মনে ভাবছিলাম, যদি বলি তুমি সরে যাও; হয়তো কষ্ট পাবে। এই ভাঙন মেনে নিতে পারবে না। আবার ভাবছি আমি কি পিটারের সাথে কথা বলব? না কিছুই না। টেমি বলল, ও ডিভোর্স নেবে। এই অশান্তির হাত থেকে মুক্তি চায়। আমি বললাম, একটু সময় দাও দুজন দুজনকে। তোমাদের কোথায় সমস্যা, তা নিজেরাই বের কর। আর আমি তো সেদিন ওকে একাই ঘরে দেখেছি। টেমি বলল, ‘মা ওই মেয়ে স্মোক করে। ওর সিগারেট লিভিং রুমে দেখেছি। তাই রাগ হয়েছিলাম।’
অশান্তিতে মনটা ভরে গেল। ওই দিনের পর থেকে টেমি আমাকে আর নতুন করে কিছু বলে না। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘তোমাকে বলাটা ভুল হয়েছে।’ প্রতিদিন আমি ওর জন্য অশান্তি নিয়ে বালিশে মাথা রাখি। দু চোখ ভিজে ওঠে। কেন আজ আমার মেয়েটা এত কষ্ট নিয়ে আছে। হাসতে গেলেও বুকের ভেতর কেমন যেন খচ করে ওঠে। টেমি সব সময় আমার কাছে ওকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু আমি তো ওর জন্য শান্তি পাচ্ছি না।
আজ ওকে কল করে বললাম, ‘মা আজ তোমার জন্য রান্না করেছি। তোমরা দুজনই এসো বিকেলে।’ সম্মতি পেয়ে আরও কিছু করলাম। কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে চেষ্টা করলাম ভালো আছে তো? হাসিমুখে দুজনে এল। খাবার খেতে খেতে পিটার বলতে শুরু করল, ‘কাজে খুব প্রেশার যাচ্ছে। তাই ও মাঝেমধ্যে সিগারেট খায়। টেমি না বুঝেই ভুল বোঝে। প্লিজ তুমি টেমিকে বুঝিও। আমি সত্যি টেমিকে ভালোবাসি।’ টেমি হেসে হেসে খাচ্ছিল। আমার খুব ভালো লাগল ওদের দেখে।
ওরা লিভিং রুমে। এমন সময় পিটারের ফোন আসায় ও আমাদের বাই বলে চলে গেল। মা আর মেয়ে দুজনেই মুখোমুখি চা নিয়ে বসলাম। ও নিজে থেকে বলতে থাকল, ‘মা হয়তো আমি বেশি সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছি। ও আমার খুব খেয়াল রাখে। মা আমি তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি—পিটারের প্রমোশন হতে যাচ্ছে। আমরা ফিলাডেলফিয়াতে মুভ হয়ে যাব দু-এক মাসের মধ্যে।’ শুনে খুশি হলাম; মেয়েটা যেন সত্যি ভালো থাকে।
টেমি কল করে বলল, ‘মা এয়ারপোর্টে এসো।’ ফুল নিয়ে গেলাম। পিটার আমার হাত ধরে বলল, ‘আমি তোমার মেয়েকে ভালোবাসি। তুমি ভালো থেকো; কোনো চিন্তা করো না।’ আকাশে উড়ে গেল ওদের প্লেনটা। চলে এলাম বাসায়। এখন টেমি খুব কম কল করে; তাই কথাও হয় কম। কথা বলে মনে হয় ভালো আছে।
হঠাৎ গাড়ির হার্ড ব্রেকে ঘুম ভাঙল। ভয়ে জানালার কাছে এসে দেখি একটা গাড়ি পুরো দুমড়েমুচড়ে গেছে। আরেকটা গাড়ির দরজা ভেঙে আরেক দিকে পড়ে আছে। ভয়ে ভয়ে দেখছিলাম। পুলিশ, দমকল থেকে শুরু করে সবাই চেষ্টা করল দুই গাড়ির সবাইকে বাঁচাতে। আমার চোখ থেকে পানি ঝরতেই থাকল। মনটা ভীষণ খারাপ থাকায় আর কাজে যাইনি। সকালে টেমিকে ফোন করি। ওর গলাটা শুনতেই পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। ও বলল, ‘মা তুমি বাড়িটি বিক্রি করে দাও। রাত বিরাতে তোমার এভাবে ঘুমের সমস্যায় কোনো বড় অসুখ বাঁধিয়ে বসবে।’
ভালো লাগল ওর এই কেয়ারিং দেখে। আজ আমি ইচ্ছে করেই জেগে আছি। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছি। প্রতিদিনের চেয়ে রাতটা যেন কাহিল হয়ে আছে। রাত এখনো গভীর হতে কত বাকি? শান্ত রাস্তাটায় গাড়ির কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। এমন সময় আমার বাড়ির কাছে একটা গাড়ি এসে থামল। কাউকে দেখতে পেলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পর গেট খোলার মতো শব্দ এল। দেখি টেমি এসেছে। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘কী হয়েছে? তুমি হঠাৎ না বলেই? পিটার তুমি তো কিছু বলো?’
টেমি আমাকে বসিয়ে বলল, ‘মা তুমি এমনভাবে কাঁদছিলে যে, না এসে পারলাম না। ফ্লাইট ডিলে হওয়ায় একটু দেরি হয়ে গেল।’ পিটার টেমিকে পানি এনে দিল। খুব ভালো লাগল ওর কেয়ারিং দেখে। পিটার আমাকে জানাল, ‘ওরা আবার এখানে ফিরে আসছে। তবে এর একটি বিশেষ কারণ আছে।’ আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। টেমি চিৎকার করে বলল, ‘মা আমি প্রেগন্যান্ট। তোমার সাথে এই খুশি ভাগ করতেই আমাদের ফিরে আসা।’
আজ রাতটা টেমি আমার সাথেই থাকল। মা মেয়ে দুজনায় দেখলাম জানালায় কী সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ। কখন যে আমি ঘুমিয়ে গেছি জানি না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেও টেমির মুখের ওপর পড়া চাঁদের আলো দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। আর জানালায় যাওয়া হলো না।