দিন ঘুরে আসে

গলির মোড়ে অনেক লোকের হট্টগোল। ভিড় আর শব্দ শুনে পারভেজের বউ ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে গলির সামনে যায়। লাশটির কাছে গিয়ে দেখে, তারই শাশুড়ি মা মরে পড়ে আছে মাটিতে। দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কত কথা মনে পড়ে গেল। ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, অনেক টাকা রোজগার করবে। মা একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে পারভেজ। বিদেশে গেছে, আজ বড় ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে দেশে আসছে। আর কোন দুঃখ থাকবে না দুঃখী মায়ের।
পারভেজের বাবা মারা গেছে সেই পাঁচ বছর বয়সে। অনেক অভাবের সংসারে আধ পেটে খেয়ে ছেলেকে মানুষ করার জন্য মা কষ্ট করেছে হাসিমুখে। এরপর মামা বাড়ির সাহায্য আর একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ছেলেকে ডাক্তার বানিয়েছে। কোন কষ্টই যেন মাকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। পারভেজ লেখা পড়ায় ভালো ছিল, সেই সঙ্গে স্কলারশিপ পেতে কোন অসুবিধা হয়নি।
আজ বাড়ি ফিরছে তার সেই ছেলে, কত কী যে রান্না করছে ছেলের জন্য। এ জগতে ছেলে ছাড়া এই বুড়ির আর কেই বা আছে? যথারীতি বিমানবন্দরে এসে প্লেন ল্যান্ড করেছে। মায়ের যেন খুশিতে শুধুই চোখের জ্বল। বাবা, তোমার এই দিনটির অপেক্ষায় আমি বেঁচে আছি। পারভেজ মাকে দেখেই এসে জড়িয়ে ধরল। মা তো তার ছেলেকে দেখতে পায় না চোখ দিয়ে। তাই দুই হাত দিয়ে চোখে–মুখে দেখছে আর বলছে, কত বড় হয়ে গেছ। আমার বাবা কত বড় ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরছে। ছেলে তখনও বুঝতে পারেনি মা তার অন্ধ হয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে পারভেজ মাকে বলছে, ‘মা, দেখো কত কিছু তোমার জন্য এনেছি।’
‘বাবা ওসব দিয়া আমি কি করমু, আমার সাত রাজার ধন আজ ফিরে আসছে আমার আর কিছু লাগবে না।’
মামাও আজ আমাদের বাড়িতে এসেছে। মামা বলতে শুরু করল, তোমাকে বিদেশে পাঠাতে তোমার মা একটা কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় তার চোখ হারিয়েছে। এরপর থেকে সে আর চোখে দেখে না।
‘এমন একটি বড় ঘটনা ঘটেছে, আমাকে কেন মা জানতেই দেয়নি।’
মামা বলল, তোমার মায়ের নিষেধ ছিল। বলত, তুমি জানলে পড়ালেখায় মনোযোগ দেবে না।
‘আহারে আমার মা কত কষ্ট করেছ আমাকে মানুষ করার জন্য। মামা তোমরা সবাই মিলে ডাক্তার দেখালে না কেন।’
মামা বলল, বাবারে তোমার মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়েছি। কিন্তু ডাক্তার বলেছে, তোমার মায়ের চোখের কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে। কর্নিয়া অপারেশন করলে ভালো হবে। কিন্তু এটা অনেক ব্যয়বহুল। তাই তোমার মা রাজি হয়নি। বলল, তোমার পড়াশোনার জন্য টাকা দরকার। আর তোমার মা সব টাকা জমা করত শুধু তোমার পড়ালেখার খরচের জন্য।
শুনে ছেলে হুহু করে কেঁদে উঠল। বলল, মা তুমি এত ত্যাগ আমার জন্য করছ অথচ আমাকে জানতে দাওনি। আর আমরা সন্তান হয়ে তোমার জন্য কি করি? কালই আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
মা আর লোভ সামলাতে পারল না এই চোখ দিয়ে ছেলেকে দেখবে বলে। বলল, আচ্ছা বাবা নিয়ে যাইও। মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছে ঠিকই। এত দিনে অনেক দেরি হওয়ায় আর এই চোখের চিকিৎসা হবে না।
পারভেজ বলল, মা তুমি আমার জন্য এত ত্যাগ করেছ কেন? এখন আমি কি করলে তুমি খুশি হবে?
সব শুনে মা বলল, বাবা আমার একটা স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে, আর একটা স্বপ্ন তুমি পূর্ণ করবে?
ছেলে শুনে বলল, সেটা কোনটা মা। তুমি আমাকে আদেশ করো। মা বলল, তুমি বিয়ে করো।
ছেলে বলল, না মা, বিয়ে এত তাড়াতাড়ি করতে চাই না। মা বলল, আমাকে খুশি করতে চাইলে তোমাকে করতে হবে।
ছেলে রাজি হয়ে বিয়ে করল। কয়েক মাস ভালোই কেটে গেল। একদিন ছেলের বউ শাশুড়িকে বলল, আচ্ছা আপনি যে আমাদের সংসারে থাকেন, সারা দিন আপনার কোন দায়িত্ব নেই।
শাশুড়ি বলল, মা আমাকে কি করতে হবে বলো।
ছেলের বউ বলল, আজ থেকে রান্নাঘরটা আপনি সামলাবেন। বলেই বলল, ওহ আপনি তো আবার কানা। চোখে দেখেন না। এমন বোঝাকে কত দিন টানতে হবে কে জানে? আপনাকেই তো আমার সাহায্য করতে হয়।
পারভেজের মায়ের দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নিচে পড়ল। দেখে বলল, কান্নার কী আছে, কানাকে তো কানা বলেছি, সত্যি বলেছি। এখানে শোক করার কিছু নেই।
পারভেজ ঘরে এসেই প্রথমে মায়ের খবর নেয়। এটাও যেন বউয়ের সহ্য হলো না। প্ল্যান করল, ছেলে ঘরে আসার আগে মাকে এমন কিছু করবে, যাতে ছেলের মায়া–মমতা কেটে যায়।
এরই মধ্যে পারভেজের বউয়ের বাচ্চা হবে। খুবই উৎকণ্ঠা। বরাবরই পারভেজ ঘর থেকে বের হলেই শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলত, রান্না করতে না পারলেও বাড়ির অন্য কাজগুলো করতে পারেন। চোখ থাকতেই মানুষ অন্ধ হয়, কাজের ফাঁকি দেয়। আর আপনি তো সত্যিকারের কানা। কানা এদিকে এসে আমাকে একটু সেবা করতে পারেন না, আমার এই অবস্থায়। সন্তান হওয়ার সময় ভালো–মন্দ সেবা করতে হয়, এটাও জানেন না। আসছেন তো গাঁও গ্রাম থেকে।
শাশুড়ি একদিন বউয়ের কাছে গিয়ে বলল, মা, আমি কি করলে তুমি খুশি হবে?
বউ বলল, ওহ এটাও বলে দিতে হবে বুঝি। আপনি কানা, কালা তো নয়। তাহলে শুনুন, আপনি এই বাড়িতে থাকলে আপনার ছেলে আমার থেকে আপনাকে বেশি খেয়াল রাখে। এটা আমার কাছে অসহ্য লাগে।
শুনে পারভেজের মা কোনো উত্তর দিল না।
পরের দিন ছেলে কাজে চলে গেল। মা তার ছোট জীবনকে সঙ্গে করে ঘর থেকে চলে গেল। কোথায় গেল, কাউকে কিছু বলেনি। কেউ জানতে পারেনি। ছেলে ঘরে এসে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বউ বলল, ‘কী বলব বল, আজ তোমার মা এমন সব কথা আমাকে বলল, তুমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারবে না।’ তোমার মা বলেছে, ‘আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই না। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি এখন আমার দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাব। আমার সব দায়িত্ব শেষ। ছেলেকে বিয়ে দিলাম, আনন্দ করব কোথায়? তার মধ্যে আবার সন্তান হচ্ছে। এত কাজ আমি করতে পারব না। এখানে আমার কষ্ট হয়, তাই পারভেজকে বল আমি চলে গেলাম। ওঁকে বলে গেলে আমাকে যেতে দেবে না। কিন্তু কোথায় যাব বলব না।’
পারভেজ এসব কী শুনছে। তার দুঃখী মা কোথায় যেতে পারে। মামাকে কল করেছে। মামাও জানে না। কারণ মামীর ভয়ে নিজের বোনের খবরটাও নিতে পারে না মামা। সম্পর্ক এমন নিম্নগামী কেন? যেন সব একদিন শেষ হয়ে যায়। এরই মধ্যে পারভেজের সন্তান হলো। কিন্তু জন্মগতভাবে শিশুটি অন্ধ হলো। এমন কেন হলো, পারভেজের মতো দুঃখী আজ কেউ না।
এরপর পারভেজের বউ মাফ চাওয়ার জন্য অনেক খুঁজেছে শাশুড়িকে। কত কথা সে শাশুড়িকে বলেছে। কত বার কানা বলে তিরস্কার করেছে। এ যেন ক্ষুরে ক্ষুরে খায়। আজ তার ছেলে জন্মগত কানা। এভাবেই যেন নিজের পাপের সাজা নিজেই পেয়ে গেছে।
‘মা তোমার চরণ ধরে ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা আজ আমার নেই। আজ আমারই বাড়ির সামনে তুমি লাশ হয়ে পড়ে আছ। তুমি বাড়িতে আসতে পারনি, তাই তুমি অভিমান করে বাড়ির বাইরে শুয়ে আছ। পারলে আমায় ক্ষমা করো মাগো, কান্নায় পায়ের ওপর লুটে পড়ল ছেলের বউ। এই জগৎ সংসার যা কিছু করা হয় তাই ঘুরে ফিরে আসে। মা ক্ষমার যোগ্য আমি না, তবু তুমি আমায় ক্ষমা করো।