একটি অদ্ভুত রিকশা ভ্রমণের গল্প

তীব্র বৃষ্টিতে পথঘাট সব ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টির গতি এতটাই, যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। একটু পরপর বাজ পড়ার শব্দ হচ্ছে। এমন ভাবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যেন চিড়ে দিয়ে যাচ্ছে, আকাশের এক দিক থেকে অন্যদিক। সন্ধ্যার পরে রাতের ঢাকাকে লাগছে অন্যরকম। বৃষ্টি আর বাতাসে অন্য এক অনুভূতি। একটু একটু শীত লাগছে শিমুলের। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। সালোয়ার কামিজের কিছু অংশ ভিজে গেছে। তবুও ভালো লাগছে তার। তারেকের সঙ্গে থাকতে তার এমনিতেই খুব ভালো লাগে। বৃষ্টি হলে আর ঘরে ফিরে যেতে মন চায় না। রিকশার হুড তুলে দিয়ে অনন্তকাল ঘোরাঘুরি করতে মন চায় তার।
এই মুহূর্তে তারেক তার পাশে। শিমুলের হাত ধরে আছে। বৃষ্টিতে একটা দোকানের শেডের নিচে আশ্রয় নিয়েছে তারা। তারেকের চোখ এদিক সেদিক একটি খালি রিকশা খুঁজছে। গুলশান এক নম্বর থেকে বারিধারা পর্যন্ত যাবে তারা। উদ্দেশ্যহীন। কেবল একটা রিকশা জার্নি। গুলশান দুই হয়ে ভেতরের রাস্তা ধরে যখন বারিধারা যায় তখন বেশ খানিকটা সময় লাগে। তখন রিকশার ভেতরে দুজনের জড়াজড়ি করে বসে থাকতে অনেক ভালো লাগে। মনে হয় এটাই তাদের ঘর। এটাই তাদের সংসার। এই সংসারে বাসিন্দা কেবল তারা দুজন।
বৃষ্টিতে খালি রিকশা পাওয়া কঠিন। যেসব পাওয়া যাচ্ছে, তাদের অনেকেই বেশ গম্ভীর মুখে বলে দিচ্ছে, ‘যামু না’। তারেক তাদের কাউকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলেছে। কাজ হয়নি। এদিকে রাতের বয়স বাড়ছে। শিমুলকে বাড়ি ফিরতে হবে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যদি রিকশা না পাওয়া যায়, তাহলে এই ভ্রমণের বদলে বাড়ি ফেরার কথা ভাবতে হবে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ শিমুলের বাবা অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ। বেশি রাত করে বাড়ি ফেরার অর্থ হচ্ছে তার কঠিন দৃষ্টির মধ্যে পড়ে যাওয়া। ফল এমন হতে পারে, পড়ালেখাই বন্ধ। অসময়ে বিয়ের বন্দোবস্ত।
তারেক যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, তখন বয়সী একজন রিকশাচালককে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তারেক বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, ‘চাচা যাবেন? বারিধারা। ভাড়া বাড়িয়ে দেব।’
রিকশাচালক যেতে রাজি। তারেক আর শিমুলের মনে হতে লাগল, যেন তাদের মাঝে স্বর্গ নেমে এসেছে। দুজনে রিকশায় উঠে বসল। রিকশার সিট ভিজে আছে। তাদের শরীরও অনেকটা ভিজে আছে। সেদিকে অবশ্য তাদের কোনো খেয়ালই নেই। এখন তারা অন্য পৃথিবীতে। তাদের সংসারে। রিকশার হুডের নিচে একটি পলিথিন দিয়ে মোড়ানো সংসার।
রিকশা এগিয়ে চলেছে। তারেক ও শিমুল দুজন দুজনের দিকে তাকায়। তারেক হাসে। শিমুল লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। এর অর্থ এখন অনেক কিছুই হবে। এমন সবকিছু ঘটবে, যার সবকিছুই শিমুলের শরীরে ঝড় তোলে, হৃদয়ে দোলা লাগায়। ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয় মন। তারেক ডান হাতটি পেছন দিক থেকে নিয়ে শিমুলের কোমর জড়িয়ে ধরে। শিউরে ওঠে মেয়েটা। এতবার এই কোমরে হাত পড়েছে তারেকের, তবুও শিহরণ কমে না। একই রকম ভালো লাগা। কেন এমন হয়, নিজের কাছে জানতে চায় শিমুল। কিন্তু উত্তর খোঁজে না। দরকার নেই। ভালো লাগাই বড় কথা।
বাম হাতে রিকশার পর্দা ধরে রাখে তারেক। সাহায্য করে শিমুলও। রিকশা এই মুহূর্তে জ্যামে পড়েছে। রিকশার ঘণ্টার টুং টাং শব্দ চারপাশে। এই থেমে থাকায় কোনো আপত্তি নেই তাদের। কেননা রাতের ঢাকায় রিকশার হুডের নিচে তারা। তার ওপর পর্দা দিয়ে ঢাকা। কেউ তাদের চিনবে না। কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে না তাদের ভালোবাসায়। কিছুক্ষণের মধ্যে রিকশা যদিও চলতে শুরু করল। তারেক নিজের নাক আর ঠোঁট শিমুলের কাঁধ আর ঘাড়ের কাছে নিয়ে ঘষতে শুরু করল। গরম বাতাস লাগছে শিমুলের গায়ে। মেয়েটা কেঁপে উঠল কয়েকবার। মনে মনে বলল, ‘অনেক সুখ’। কানে চুমু খায় তারেক। কোমর থেকে হাতটা সরিয়ে গাল টিপে দেয়। এরপর মাথাটা ঘুরিয়ে নিজের ঠোঁটের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এর অর্থ কী শিমুল ভালোই জানে। কিন্তু বাধা দেয় না। দেবেই বা কেন। এখানেই যে তার শান্তি। একটু পর তারেক শিমুলের গালে চুম্বন এঁকে দিল। তাকাল তার চোখের দিকে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। মৃদু হাসির রেখা খেলে গেল শিমুলের মুখে। চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু অন্ধকারে জ্বলজ্বলে দুই জোড়া চোখের আভা ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিতে এল না তাদের। তারেক ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়। এগিয়ে আসে শিমুল। আলতো স্পর্শে চেপে ধরে রাখে অনেকক্ষণ। এরপর একটু একটু করে ঝড় ওঠে নিজেদের ভেতরে। সেই চুম্বন গভীর হয়। বাইরের ঝড়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সেই ঝড়। একে অপরের ঠোঁট খেয়ে নিতে চায়। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে তোলে তারা। আহা কী সুখ। কী সুখ। সেই সঙ্গে শিমুলের বুকের স্পর্শ তারেকের হাতে। এই পথের যেন কোনো শেষ নেই। হঠাৎ রিকশা এসে থামল গুলশান দুই নম্বরের সিগন্যালে। একটা ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমড়া বিক্রি করছে। শিমুল বলল, ‘আমড়া খাব’।
তারেক বলল, ‘দাঁড়াও ছেলেটিকে ডাকি’। বলে পর্দা সরিয়ে মুখটা বের করে ছেলেটিকে কাছে ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু বৃষ্টির গতি আর চারপাশের শব্দে সে যেন কিছুই শুনতে পেল না। সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। চলতে শুরু করেছে রিকশা। এগিয়ে যাচ্ছে। আফসোসের সুরে শিমুল বলল, ‘ইশ্‌ আমড়া খাওয়া হলো না। খুব ইচ্ছে করছিল ঝাল লবণ মরিচ দিয়ে আমড়া খাই’।
দুষ্টুমির ছলে তারেক বলল, ‘ভালোই হয়েছে ছেলেটা ডাক শোনেনি। নইলে তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখটাও ঝালে পুড়ে যেত’। এই বলেই উচ্চ স্বরে হেসে উঠল তারেক। লজ্জায় তারেকের গায়ে চিমটি কাটল শিমুল। এরপর আবারও তারা ডুবে গেল পৃথিবীর স্বর্গে। যতটা পারল একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। রিকশাওয়ালা মনে হলো কিছু একটা টের পেয়েছে। এখন একটু পরপর পেছনে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করে। মনে মনে হয়তো ভাবে, ‘কী হইতাছে ভেতরে। পোলা মাইয়া দুইটাই বদের হাড্ডি’। তবে সেই ভাবনা শুনতে পায় না তারেক আর শিমুল। কিন্তু রিকশাওয়ালার তাকানোয় অনেকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল তারা। সতর্ক হয়ে সবকিছু করতে হচ্ছে। আর সতর্ক প্রেম তাদের ভালো লাগে না।
রিকশা এগিয়ে চলেছে। শিমুল আর তারেক বসে থাকে সময়ের অপেক্ষায়। আবারও মিলিত হবে তারা। তবে তারেকের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে শিমুলের কোমর। বৃষ্টির গতি অনেকটাই কমে এসেছে। কেমন যেন ভ্যাপসা গরম চারপাশে। এই এক সমস্যা। বৃষ্টি কমে গেলে কখনো এমন হয়। এই ঠান্ডা বাতাস ছেড়ে বৃষ্টি এল। নেই বৃষ্টি তো অস্বস্তিকর গরম। তখন রিকশার পর্দা উঠিয়ে চলা কঠিন। এরপরও নিজেদের জগৎকে তারা দুজন অন্য কাউকে দেখাতে চায় না। ফলে পর্দায় উঁচিয়ে তুলে ধরে রাখে। কিছু দূর যাওয়ার পরে আবার দুজন দুজনকে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে থাকে। আশপাশে কী হচ্ছে, খেয়ালই নেই তাদের। চলছে তো চলছেই। হঠাৎ করে প্রচণ্ড বাজ পড়ার শব্দ হলো। সেই সঙ্গে রিকশাচালক যেন অনেকটা ধমকে ওঠে। ‘এই যে আপনারা কী করতাছেন এই সব। আমার রিকশা থাইকা নামেন’। ধমকের শব্দে হঠাৎ দুজন চমকে ওঠে। হাত থেকে পর্দা পড়ে যায়। রিকশা থেমে আছে। সামনে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে রিকশাচালক। রাতের নিয়ন আলোয় তার রাগান্বিত চোখ তারা ঠিকই দেখতে পেল। বৃদ্ধ চালক যেন রাগে ফুঁসছে। শিমুল এমনিতেই খুব বেশি কথা বলে না। কিন্তু এবার সে বলে উঠল, ‘কেন চাচা কী হয়েছে। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি’।

দুই.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তারেকের। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা। কোথায় শিমুল! কোথায় সেই রিকশা! আর কোথায় সেই রাগান্বিত রিকশাচালক। বৃষ্টি নেই। আকাশে বাজ পড়ছে না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না আকাশে। চারপাশ অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে সে শুয়ে আছে একটি খাটে। মনে পড়ে গেল, এটা তার নিজের ঘর। এখানে সে একা। শিমুল তার জীবন থেকে চলে গেছে। কয়েক দিন আগে বাবার কথা রাখতে গিয়ে রেদোয়ান নামে অন্য একটি ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে। তার জীবনে যে মেয়ের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই, প্রতি রাতে কেন তাকেই স্বপ্নে দেখতে হবে! নিজের ওপর রাগ ও ক্ষোভ লাগছে। কিছুতেই নিজের ভেতরের অস্থিরতা দূর করতে পারছে না তারেক। উঠে ঘরের বাতি জ্বালাল সে। জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেল ঢক ঢক করে। এরপর টেবিলের ওপর রাখা কাগজ টেনে খস খস করে লিখতে শুরু করল, ‘প্রিয় শিমুল, তোমাকে মনে মনে আমি রংধনু বলে ডাকতাম। জানো তো রংধনুতে সাতটি রং থাকে। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই। তবে সবগুলো রং মিলে রঙিন হয়। সাদা কোনো রং না। কিন্তু সব রঙেই সাদা থাকে। তুমি যখন আমার জীবনে ছিলে না, তখন আমার জীবনটা ছিল একেবারে সাদামাটা। তুমি যখন এলে, তখন হয়ে উঠল রঙিন। আমার জীবনে রংধনু হয়ে এসেছিলে তুমি। তুমি নেই। আবারও বিবর্ণ জীবন। এই জীবন টেনে নেওয়া কতটা কঠিন হবে, বুঝতে পারছি না। মানুষের শোকের আয়ু কত সময়ের, জানি না। কিন্তু তোমাকে হারানোর শোক কী আমি সইতে পারব? উত্তর জানা নেই। তবে তুমি ভালো থেকো’। এটুকু লিখে থামল তারেক। কেন লিখছে, বুঝতে পারছে না সে। কেননা এই চিঠি কোনো দিন পৌঁছাবে না শিমুলের কাছে!