ঘুরে এলাম, দেখে এলাম

জনসন সিটি, টেনেসি
জনসন সিটি, টেনেসি

এবারের শীতকালীন ভ্রমণ ও অবকাশ যাপনের তালিকায় ছিল নর্থ ক্যারোলাইনার পাহাড়ি ছোট শহর বুন। মন জুড়ানো অ্যাপ্যালাশিয়ান পর্বতমালা হলো পাহাড়ের দীর্ঘ সারি, যা উত্তরে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যালাবামা পর্যন্ত বিস্তৃত। পর্বতমালার আশপাশের অঞ্চলটিতে বিভিন্ন শহর ও ছোট ছোট জনপদ গড়ে উঠেছে। আমেরিকার প্রথম দিকের ঔপনিবেশিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এটি।
সেই ইতিহাসসমৃদ্ধ অ্যাপ্যালাশিয়ান পর্বতমালার অন্যতম মূল আকর্ষণ বুন। আমেরিকায় এই পর্বতমালার ট্রেইলটি ২১১৪ মাইল দীর্ঘ। আর অ্যাপ্যালাশিয়ান ট্রেইল উত্তর ক্যারোলিনায় প্রায় ৮৮ মাইল বিস্তৃত। এবার এখানে শীতকালীন পারিবারিক ছুটি কাটাতে এসেছি। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এই পার্বত্য অঞ্চলে অসংখ্য হোটেল রয়েছে। নীল পাহাড়ের পাদদেশে থাকা উপত্যকা ও গুহা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। রয়েছে গলফ কোর্স ও স্কিইংয়ের ব্যবস্থাও। অ্যাশভিল ও বুন নর্থ ক্যারোলাইনার সবচেয়ে সুন্দর পাহাড়ি শহর। নিউইয়র্ক থেকে আমরা বুনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম ২৫ ডিসেম্বর সকাল ৬টায়।
অ্যাপ্যালাশিয়ান পর্বতমালা ব্লু রিজ পার্কওয়ে অতি মনোরম। বিচ মাউন্টেন ও সুগার মাউন্টেনের রেঞ্জ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ কেন্দ্র। শীতকালে অ্যাপ্যালাশিয়ান পর্বতমালা স্নো বোর্ডিং ও স্কিইংয়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
গ্র্যান্ডফাদার মাউন্টেন
এখন শীতকাল। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে নিউইয়র্কের তাপমাত্রা ছিল শূন্যের ছয় ডিগ্রি নিচে। যেখানে বেড়াতে এসেছি, সেখানে ৫৭ ডিগ্রি। সকালের নাশতা হোটেলেই সেরে নিয়ে বের হয়েছি। সূর্যগ্রহণের দিন আজ। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে হিরার দ্যুতির মতো। খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় গাড়িসহ ওঠা যায় গ্র্যান্ড ফাদার মাউন্টেনে। সে যে কী খাঁড়া পাহাড়! পুরো পাহাড় ঘুরে ঘুরে গাড়ি ওপরে ওঠে। জানালা দিয়ে গিরিখাদের মতো দেখা যায়। কী ভয়ংকর সে সৌন্দর্য! আমার এমনিতে উচ্চতাভীতি রয়েছে। এমনকি আমি দার্জিলিংও যাইনি কখনো এই ভয়ে। শিলং গিয়েছিলাম সারা রাস্তা আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে। সেই রাস্তাও সরু। পাহাড়ের খাঁজ কেটে তৈরি। সবুজ গালিচা বিছানো পাহাড়ের গলাগলি দেখেও ভয়ে কখনো চোখ বন্ধ করতে হয়েছে। যাক এক সময় গাড়ি ওপরে উঠল। গাড়ির পার্কি স্পট প্রায় পূর্ণ। আবহাওয়া চমৎকার। আমরা গাড়ি পার্ক করে ছবি তুলতে তুলতে ওপরে উঠছি। সবশেষে পৌঁছালাম ঝুলন্ত দোলনা ব্রিজের কাছে।
আমি যথেষ্ট সাহস নিয়ে ব্রিজের মাঝামাঝি এসে ভয় পেয়ে গেলাম। আমার সামনে টিনএজ এক বালক। সে মনের আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে দোল খেতে খেতে চলেছে। ওকে আমি তো থামাতে পারি না। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক মাইল ওপরে এই দোলনা সেতু; শহরের বাইরে। ডানে বায়ে পাহাড়ের সুনীল ঢেউ। এ কী স্বর্গ নাকি সত্য!

লাভস স্টোরের সামনে
লাভস স্টোরের সামনে

এই ব্রিজটি ১৯৫২ সালে নির্মিত। এই ঝুলন্ত সেতুতে প্রবেশের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মাথাপিছু ২২ ডলার করে গুনতে হয়। শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এ হার ১৫ ডলার। তবে প্রবেশমূল্য যাই হোক, এখানে এসে এই সেতুতে না চড়লে অপূর্ণতা থেকে যাবে। এই অভিজ্ঞতা আপনার ‘গ্র্যান্ডফাদার মাউন্টেন’ ভ্রমণকে সম্পূর্ণ করবে। আমেরিকার সর্বোচ্চ সাসপেনশন যুক্ত ফুটব্রিজ ‘মাইল হাই সুইং ব্রিজটি’ গ্র্যান্ডফাদার পর্বতের লিনভিল পিক থেকে দেখা যায়। এখানে দর্শকদের প্রবেশ সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ রাস্তা, যা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। চূড়ায় ওঠার জন্য এমনকি এলিভেটরের ব্যবস্থাও রয়েছে। তাই হুইলচেয়ার ও বেবি স্ট্রলারও সহজে ওঠানো যায়। আর আমার মতো সিঁড়ি বেয়ে যারা হাঁপিয়ে ওঠেন, তাঁরাও সহজে লিফটে উঠে যেতে পারবেন। নিচে কফি শপ রয়েছে, চাইলে একটু সতেজ হতে যে কেউ কফির কাপে চুমুক দিতে পারে। রয়েছে বিশ্রামের জন্য বেঞ্চের ব্যবস্থা। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে আমিও সেখানে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।
১৯৫২ সালে ব্রিজটি উদ্বোধনের সময় নর্থ ক্যারোলাইনার সাবেক পর্যটন পরিচালক এর নাম দিয়েছিলেন ‘মাইল হাই সুইং ব্রিজ’। ‘সুইং’ শব্দটি এর সাসপেন্স বুঝতে সাহায্য করে। আমার সামনের লাফিয়ে চলা কিশোর আমাকে এই সাসপেন্স হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ের চিকন পাথুরে পথ ধরে আরক ধাপ ওপরে অনেকেই যাচ্ছিল। তবে বাকিটুকু আমি আর যাওয়ার সাহস করিনি।

ব্রিজটির ডিজাইন করেছেন নর্থ ক্যারোলাইনার গ্রিনসবরোর চার্লস হার্টম্যান জুনিয়র। ব্রিজটি গ্রিনসবরোতে তৈরি ও তারপর মাউন্টেনের শীর্ষে পুনরায় বসানো হয়। ১৫ হাজার ডলার ব্যয় করে এই সেতুটি তৈরিতে তিন সপ্তাহ লেগেছিল। নর্থ ক্যারোলিনা গভর্নর উইলিয়াম বি ১৯৯৯ সালে এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পুনরায় নকশা করেন অ্যাশভিল, নর্থ ক্যারোলাইনার শাটন, কেনারেলি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ইঞ্জিনিয়ারিং। পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত করেন অ্যাশভিল নর্থ ক্যারোলাইনার টেলর অ্যান্ড মারফি কনস্ট্রাকশন সংস্থা। তবে আমি বলব, যাদের হার্ট দুর্বল, উচ্চতাভীতি আছে, তাদের ঝুঁকি না নেওয়াই উচিত।
নিউইয়র্ক থেকে যাওয়া আসার পথে লম্বা সময় লাগে। মাঝে দু-তিনবার আমরা রিফ্রেশ এরিয়ায় থেমেছি। আর তখনই নতুন এক অভিজ্ঞতা হলো, যা একদম নতুন। প্রতিবার বের হলেই নতুন কিছু দেখা হয়। আমরা গ্যাস নেওয়া ও রিফ্রেশ হওয়ার জন্য থামলাম গ্যাস স্টেশনে। ‘লাভস’ নাম দোকানটির। এতে এমন কোনো জিনিস নেই, নেই। গাড়ির পার্টস থেকে মবিল, স্নো শাবল, কফি, কুকিজ, ডোনাট, চকলেট—সব। আমরা ডোনাট ও কফি নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ শুনি মাইকে ঘোষণা—‘শাওয়ারের জন্য লাইনে থাকা ছয় নম্বরকে শাওয়ার রুম তিনে যেতে বলা হচ্ছে।’ তখনই বিষয়টি খেয়াল করলাম।
বড় বড় ট্রাক্টর টেইলার, কনটেইনার ভ্যানগুলো এখানে স্টপেজ নেয়। এ ধরনের ট্রাক্টরগুলো অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে মালামাল পরিবহন করে। টানা তিন থেকে পাঁচ দিন ড্রাইভ করে। তাই শাওয়ার নেওয়ার জন্য এই রিফ্রেশ সেন্টারে দাঁড়ায় ড্রাইভাররা, যারা দক্ষিণ থেকে উত্তরে বা পশ্চিমে অথবা উত্তর থেকে দক্ষিণে যায় বা যাচ্ছে। দোকানটির শুধু শাওয়ার অ্যান্ড লন্ড্রি সেকশনই অনেক বড়। সিরিয়াল পাওয়া একজনকে দেখলাম খুশি মনে সিটি বাজিয়ে বাথরুমের দিকে হেলে দুলে এগিয়ে যেতে। আমাদের গাড়ি দোকানটির সঙ্গের গ্যাস স্টেশন থেকে গ্যাস নিচ্ছে। এই ফাঁকে আমি কয়েকটি ক্লিক নিয়ে নিলাম।
পথে পথে নতুন দেখার কত কী যে আছে। এদিকে প্রচুর গরু, ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়ার খামার। এখন শীতকাল। তবে তাপমাত্রা ৫৭-৬১ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। বৃষ্টি বা তুষারপাতের সম্ভাবনা শূন্য। তাই চারণভূমিতে বেশ নাদুসনুদুস গবাদিপশু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের জন্য কোনো কোনো খামারে দেখলাম ঘাস সুতার রিলের মতো পেঁচিয়ে পলিথিন মুড়ে রাখা হয়েছে। বুঝলাম এগুলো আপত্কালীন সময় অর্থাৎ বরফ পড়লে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। পাহাড়ি নদী দেখলাম খলবলিয়ে নামছে। পাহাড়ের চূড়ায় বাড়ি। খাঁজে খাঁজে বাড়ি। ব্লুরিজ মাউন্টেন রেঞ্জ ধরে আমরা টেনেসির জনসন সিটিতে গেলাম। লরেল ক্রিক জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে ভয়ানক সরু রাস্তা ধরে উঁচু এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সূর্যাস্ত দেখে ফিরলাম। আমেরিকার স্বল্প ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় বুন দশ নম্বর। এ শহরের একটি স্টেক হাউস লং হর্ন স্টেক হাউসে আমরা রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।
হোটেলে ব্রেকফাস্ট খেয়ে পরদিন বেলা বারোটায় আবার আমরা রওনা হলাম বাড়ির পথে। ওয়েজ ও গুগল ম্যাপের মধ্যে ওয়েজ সবার পছন্দ। কারণ, পুলিশের অবস্থান, কোনো দুর্ঘটনা, ট্রাফিক আছে কিনা জানা যায়। ওয়েজ এবার আমাদের কান্ট্রি সাইড রোড দিয়ে নিয়ে চলল ভার্জিনিয়া পর্যন্ত। বড় বড় গরুর ফার্ম, বড় উঁচু উঁচু পাহাড়ের ওপর বাড়ি। কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো নিচে। ঘুরে ঘুরে চলেছি। সাথে চলে এক পাহাড়ি নদী। নদীর নাম নিউ রিভার। ওয়াটাওগা রিভার। যদিও পানি তেমন নেই। তবে নিশ্চয়ই মাছ আছে। কারণ, জায়গায় জায়গায় দেখলাম লোকজন মাছ ধরায় ব্যস্ত। রাত বারোটায় বাসায় মানে নিউইয়র্ক ফিরে এলাম।