যুদ্ধ এড়ানো গেছে, এখন দরকার শান্তি পরিকল্পনা

এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সংগতি ইরানের নেই। ছবি: রয়টার্স
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সংগতি ইরানের নেই। ছবি: রয়টার্স

বুধবার এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইঙ্গিত করেছেন, ইরানের সঙ্গে নতুন পারমাণবিক চুক্তি করতে তিনি আগ্রহী। তিনি বলেন, ইরাকে দুটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কোনো মার্কিন নাগরিক হতাহত হয়নি, ফলে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা তিনি নেবেন না। ইরান কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে, সবার জন্যই তা সুখবর। ভাষণের শেষে ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণের প্রতি বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা চাই ইরানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। যারা শান্তি চায় তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে আমরা প্রস্তুত।’

কদিন আগে যে প্রেসিডেন্ট কোনো আপাত–কারণ ছাড়াই ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে বিদেশের মাটিতে ড্রোন আক্রমণে হত্যা করেন, তাঁর কাছ থেকে এ কথা যত অবাস্তব মনে হোক না কেন, পৃথিবীর মানুষের জন্য তা স্বস্তি বয়ে এনেছে। খবরটি সবচেয়ে ভালো ইরানের জন্য। মুখে যত কথাই বলুক, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সংগতি ইরানের নেই। অব্যাহত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ২০১৯ সালে ইরানের অর্থনীতি ৯ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়েছে। দুই বছর আগে যেখানে ইরান প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করত, সেখানে গত বছরের শেষে এই রপ্তানি মাত্র আড়াই লাখ ব্যারেলে নেমে আসে। ইরানের মুদ্রা পড়ে গেছে, মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী। সবচেয়ে কঠিন অবস্থা খাদ্যমূল্যের ক্ষেত্রে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মাংসের দাম ১১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে।

যুদ্ধ না চাইলেও রাজনৈতিক প্রয়োজনে পাল্টা ব্যবস্থা ইরানকে নিতে হয়েছে। তারপরও যে ‘প্রতিশোধ’ তারা নিয়েছে, তার ফলে কিছু শূন্য ভবন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। বিপর্যয় এড়াতে ইরান এতটা যত্নবান ছিল, তারা হামলার আগেভাগেই ইরাকের সরকারকে জানিয়ে দেয় কখন, কোথায় হামলা হবে। ইরাক সে খবর যথারীতি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলে তারা নিজের লোকজন, যন্ত্রপাতি নিরাপদে সরিয়ে ফেলে।

ইরান যে পরিস্থিতির অবনতি চায় না, সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপর এক টুইটে সে কথা জানিয়ে লেখেন, আত্মরক্ষার জন্য ইরান সমপরিমাণ পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মাধ্যমেই তার পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ সমাপ্ত হলো।

ট্রাম্প নিজেও সম্ভবত নতুন কোনো যুদ্ধ চান না। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ও আফগানিস্তানে ‘অনন্তকাল ধরে’ চলা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মার্কিন সেনা কর্তৃপক্ষ ও রিপাবলিকান কট্টর যুদ্ধবাজদের আপত্তি সত্ত্বেও সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। ইরাক থেকেও নিজের সৈন্যদের তিনি ফিরিয়ে আনতে চান। সোলাইমানি হত্যার পর ইরাকে যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দেশটি আর মার্কিন সৈন্যদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়। নিজ দলের যুদ্ধবাজদের কথা না শুনে ট্রাম্প যদি নিজের পরামর্শ নিজেই শোনেন, তাহলে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মার্কিন সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারেন।

আপাতত অবশ্য তার কোনো সম্ভাবনা নেই। সৈন্য প্রত্যাহারের বদলে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে আরও সাড়ে তিন হাজার সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এ কথাও জানেন, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহৃত হলে সবচেয়ে বেশি লাভ ইরানের। ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননের ওপর তার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে সে পথে তিনি এগোবেন না। কিন্তু ইরানের সঙ্গে যদি একটি শান্তিচুক্তি অর্জন সম্ভব হয়, যে চুক্তির প্রস্তাব তিনি প্রকারান্তরে বুধবারের ভাষণে দিয়েছেন, তাহলে অবস্থা বদলাতে পারে।

ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, তিনি নিজের শর্তে ইরানের সঙ্গে নতুন একটি পারমাণবিক চুক্তি চান। ওবামা আমলে যে চুক্তি হয়েছিল, ট্রাম্প কলমের এক খোঁচায় তা বাতিল করেছিলেন। ‘এটি একটি অত্যন্ত বাজে চুক্তি,’ বুধবারের ভাষণে ট্রাম্প সে কথা বারকয়েক মনে করিয়ে দেন। চুক্তিটি বাজে নয়, এ কথা অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মানেন। ট্রাম্পের আপত্তির কারণ এটি ওবামা আমলে সম্পাদিত হয়েছে। এখন যদি তাঁর নেতৃত্বে একটি নতুন চুক্তি সম্ভব হয়, তাতে তিনি খুশিই হবেন। ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি মুখোমুখি আলোচনায় বসতে রাজি। গত বছরের এপ্রিলে হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘অর্থপূর্ণ একটি চুক্তি যদি করা সম্ভব হয়, তাহলে আমি অবশ্যই ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসতে প্রস্তুত।’

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই যদি নতুন কোনো প্রতিশোধমূলক সামরিক ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে একটি নতুন চুক্তির কথা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমান সংকট ট্রাম্পের জন্য তেমন চুক্তির একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সোলাইমানিকে হত্যার ফলে বড় রকমের হুমকি তিনি দূর করেছেন, এমন দাবি তিনি ইতিমধ্যেই করেছেন। এটি ওসামা বিন লাদেনের চেয়েও বড় সাফল্য, এমন কথাও বলা হয়েছে। তাঁর হুমকিতে ভয় পেয়ে ইরান কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি, ট্রাম্পের জন্য সেটি আরেক সাফল্য। ইরানের সঙ্গে নতুন পারমাণবিক চুক্তি করা গেলে ওবামাকে আরেক হাত দেখে নেওয়া যায়, সেটিও তাঁর শ্লাঘার জন্য পুষ্টিদায়ক হবে।

ইরান নিজেও মনে করে, তার গলার ওপর ফাঁস হয়ে বসে থাকা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে ট্রাম্পের সঙ্গে নতুন চুক্তি করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। ইরানের প্রধান লক্ষ্য, যেভাবে হোক, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার অথবা আংশিক লাঘব। ট্রাম্প যদি ইরানের সঙ্গে শান্তির ব্যাপারে আন্তরিক হন, তাহলে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে ইরানের তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে পারেন।

এমন একটি সম্ভাবনা যে অবাস্তব নয়, সে কথা সমর্থন করেছেন ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টনের চিফ অব স্টাফ ফ্রেড ফেলিৎস। তিনি বলেছেন, নতুন চুক্তির পক্ষে এটি অবশ্যই একটি চমৎকার সুযোগ।

টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যানিয়েল ড্রেজনার ইরানকে আরও একটি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আয়াতুল্লাহ খামেনির উদ্দেশে বলেছেন, ‘আর যা–ই করুন, ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হন, এমন কোনো বাগাড়ম্বরপূর্ণ টুইট করবেন না। এই লোককে খেপিয়ে তুলতে একটি টুইটই যথেষ্ট।’