শেখর ভট্টাচার্যের গুচ্ছ কবিতা

পথ ও পথিকের কাব্য

বোধিবৃক্ষতলে সমাধিতে বসেছিল এক স্থিতধী কবি
বলেছিল পথ আছে, আছে পথ, এঁকেছিল সহজিয়া ছবি।
পথিকেরা পথ খুঁজে, ফুল-পাখি আর পাহাড়ের মাঝে,
অরণ্য নিধন করে সকাল, সন্ধ্যা আর সাজে।
পথিকেরা পায় না যে পথ,
নাকি পথেরা পায় না খুঁজে পথিক
সিদ্ধ্ব পুরুষ, খোঁজে না তো রথ,
একান্তে খোঁজেন তিনি সঠিক বেঠিক।
বিষপাত্র হাতে নিয়ে পেয়ে যায় পথের ঠিকানা,
সহস্র বছরে কেউ পায় না পথের নিশানা।
কেউ বলে, পথ বলে কোনো কিছু নেই,
সবকিছু মায়াবিদ্যা, কল্পনার কালো কোনো জাদু,
পথের ঠিকানা খোঁজে নেশাখোর মাতাল সাধক
অমোঘ সত্য জানে বুভুক্ষু হাজার মানুষেই।
পথ ও পথিক আজ ক্লান্ত পাখির মতো ঝাপটায় ডানা
ক্লান্তি, অবসাদে ভুলে যায় সকলেই পথের ঠিকানা।

জোছনার দুধ সাদা ঢেউ

মাথায় সোনার কাঠি তাঁর, পায়ের ওপারে রুপোর কাঠি,
চুলের শিথানে আহা—রঙ্গণ ফুলের মতো হার।
পালঙ্কে অপরূপ লতা, পাতা, আকাশ আর মাটি
এক থালা চাঁদ যেন শুয়ে আছে, আহা কী যে অপরূপ বাহার।
ঘুম ভাঙালে পাপ হবে জানো? তারপরও এত ব্যাকুলতা,
স্বপ্ন নিয়ে শুয়ে আছে যে, ঘুম ভাঙানোর ছিল না যে কথা।
জোছনার দুধ সাদা ঢেউ, বয়ে চলে এ ধার ও ধার
প্রার্থনায় নতজানু হই, সমুখে যে চাঁদের পাহাড়।

গণদেবতা

প্রান্তিক, দরিদ্র, অতিদরিদ্র, হতদরিদ্র, অতিসাধারণ,
কত কত ভাবে সম্বোধন।
গরিব বলাটা সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন।
অনেকে আবার বলেন, এরা সব হুবহু আমাদের মতো,
আমাদের মতো করে নিরন্তর প্রচেষ্টায় রত,
উন্নয়নের অংশীজন, এগোনোই ধ্যান, জ্ঞান, ব্রত।
মাথায় কাঁঠাল ভেঙে, সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে যারা কেবলই ওপরে উঠে যান,
ঊর্ধ্বলোকে দেব ভাব নিয়ে, বাউল সেজে তাঁরা বাঁচান সম্মান।
তাঁদের দেয়া নামে বড়ই তাৎপর্যময়
উদাত্ত গলায় বলেন, ওরা হলো গণদেবতা।
গণদেবতার পূজায় লাগে ডলার, পাউন্ড, ফ্রাঙ্কো কিংবা কম্বল,
প্রকল্প প্রস্তাবে তাই সুর ওঠে, আহা মানবতা, শুধু মানবতাই সম্বল।
পূজার নিকেশ নেবে, মুলুকজুড়ে এ সাধ্য কারও হয়?
গণদেবতাদের মনে, পাথরের মতো ভর করে ভয়।
ভয়ের পাথর ভেঙে, আলোময় ভোর হবে কবে?
ভোর হবে হবে ভোর, কাটবে কাটবে ঘোর।
দেবতা মানুষ হলে, রাঙা ভোর দেখা যাবে নিশ্চয়।

চরৈবেতি, চরৈবেতি

এক শ কিংবা হাজার মিটার রেসের প্রতিযোগী যখন তুমি, আমি এবং আমরা,
কোচের ‘রুলস অব এথিকস’ হলো পেছনে তাকাতে নেই,
কে পড়ে গেল হোঁচট খেয়ে, অজ্ঞান হলো কে প্রখর রোদের উত্তাপে,
হুইসেল বাজার আগেই পা বাড়িয়ে অযোগ্য হলো কারা,
এসব ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
একটাই মন্ত্র চরৈবেতি, চরৈবেতি, এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও
হাত, পা ছোড়ো পাগলা হাতি কিংবা উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো,
সামনে, পাশে কিংবা পেছনের ঘাসগুলো, গাছগুলো, দুমড়ে, মুচড়ে
হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে দৃষ্টি সীমার বাইরে, ঝরা পাতার মতো
উড়িয়ে দাও।
এগিয়ে যাও, প্রয়োজনে কায়েদে আজমের মতো অতি চালাকি করে,
উল্টো পথে হলেও, পৌঁছে যেতে হবে পরম ব্রহ্ম, মঞ্জিলে মকসুদে কিংবা কাঙ্ক্ষিত
মাইল স্টোনের ওপারে।
পারবে কি?
যদি না পার, তাহলে ঝরা পাতার মতো মিশে যাও
বাজারের কোণের কোনো এক ডাস্টবিনে, উর্বর সার হয়ে মিশে যাও মাটির অতলে,
গভীর পাতালে, যেখান থেকে আর পৌঁছে যাওয়ার তাড়া দেবে না কেউ।