সুরমার দ্বিতীয় জীবন

আমার নাম সুরমা। আজ আমি আমার জীবনের দ্বিতীয় পর্বের গল্পটি বলতে বসেছি। ভূমিকা বা প্রথম জীবনের গল্পটা এখানে না হয় নাই বলি। আর আমার জীবনের শেষ পর্ব বা উপসংহারটি কেমন হবে এবং তা আমি নিজে কোথাও লিখে যেতে পারব কিনা এখনো তা জানি না।
একজন মানুষকে তার ‘জীবন’ নিয়ে রচনা লিখতে বললে, তা কী কেবল ভূমিকা ও উপসংহারে শেষ করা চলে? না চলে না। গুরুত্বানুযায়ী নানা অধ্যায় বা খণ্ডে ভাগ করে, তবেই লিখতে হবে তার জীবনী।। অথবা তাকে নিয়ে গল্প বলতে গেলেও তার জীবনের কোনো এক অধ্যায়কে হাইলাইট করে শুধু সেই অধ্যায়ের গল্প বলতে হয়। পুরো একটি জীবনের অখণ্ড গল্প কী এক বৈঠকে বলে শেষ করা যায়?

পুরোনো ঢাকার যে বাড়িতে বর্তমানে আমি বাস করছি, তার মালিকানায় কাগজে-কলমে কোথাও আমার নাম লেখা নেই। তবুও এই বাড়ির আমিই কর্তা। আমাকে বাদ দিয়ে এই বাড়ির কোনো কাজ হয় না। যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যদিও আজই এই বাড়িতে আমাদের শেষ রাত। আগামীকাল ভোরে আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমরা, মানে আমি আর আমার স্বামী সিরাজ আহমেদ। এই সিদ্ধান্তটিও আমার ইচ্ছেতেই নেওয়া হয়েছে। আমাদের দুটি ছেলেমেয়ে। সেজান আহমেদ ও মুনিয়া আহমেদ। সেজান তার স্ত্রী তিথি ও মেয়ে তিতলিকে নিয়ে তাদের বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে থাকে। মুনিয়া থাকে নিউইয়র্কে তার স্বামী শিহাবের সাথে। বাড়ির মতোই এই পুত্রকন্যাদের বায়োলজিকাল মা না হলেও আমিই এখন ওদের মা। আমি ওদের বাবার বিবাহিতা দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার সুবাদে তার স্থাবর-অস্থাবর সবকিছুতে আমার একটি অলিখিত অধিকার জন্মেছে।

এই অতি প্রাচীন বাড়িটি বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য হওয়ায় আমরা এটি ডেভেলপারের কাছে দিয়েছি। তারা বাড়িটি ভেঙে এখানে বহুতল বাড়ি নির্মাণ করবে। তখন আমরা একেকজন দুটো করে ফ্ল্যাটের মালিক হব। বাড়ির মালিকানায় তখন কাগজে-কলমে আমার নাম বসবে। সে কারণে এই বহুতল বাড়ি নির্মাণের ব্যাপারটি আমার জন্য সুখের। আরও একটি ব্যাপার আমার জন্য অনেক স্বস্তিকর হবে, তা হলো সারাক্ষণ অন্য ভুবনের এক জোড়া চোখের পাহারা থেকে মুক্তি। আরেকজনের সংসারের পাহারাদার সেজে থাকা থেকে মুক্তি। সেই মুক্তির আনন্দ আজ আমাকে নির্ভার করে দিয়েছে। আর মাত্র একটি রাত। তারপরই আসবে আমার মুক্তির প্রথম দিন। শুরু হবে আমার জীবনের তৃতীয় বা শেষ অধ্যায়।

এই বাড়িতে আসার আগে আমার অন্য আরেক জীবন ছিল। সেই জীবনটি ঘিরে রয়েছে অনেক কষ্ট, বঞ্চনা ও পাগলামির ইতিহাস। সেই জীবনেরও পাঠ চুকিয়ে আমি একটি ভাসমান জীবন যাপন করছিলাম। আজ বাবার বাড়ি তো, দুদিন পর ভাইয়ের বাড়ি, তারপর খালার বাড়ি। ভাসমান শেওলার মতোই ভেসে চলেছিলাম। এমনই সময়ে মনিজার কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। মনিজা আমার দূর সম্পর্কের খালাতো বোন। আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। তার শেষের দিনগুলোতে তাকে দেখাশোনার জন্যই আমি পুরোনো ঢাকার গ্যান্ডারিয়ার এই বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেছিলাম।

এই বাড়ি প্রায় এক শ বছরের পুরোনো। বিশাল বাড়ি। ছোটবেলায় আমরাও এই বাড়ির কাছেই আরেকটি বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। আমাদের ভাড়া বাড়িটি ছিল দমবন্ধ করা দু কামরার ঘর। আমার বাবা ছিলেন গরিব মানুষ। ধনী খালার এই বড় বাড়িতেই আমার অনেকটা সময় কেটে যেত। তাই ছোটবেলা থেকেই এই বাড়ির প্রতিটি ঘর, বারান্দা চিলেকোঠা ছিল আমার নখদর্পণে। এই বাড়ির চরিত্র, গন্ধ সব আমার মুখস্থ, পূর্বপরিচিত। তারপর বাবার কাজের বদলির কারণে আমরা অন্যত্র চলে যাই। সেই থেকেই মনিজার সঙ্গে আমার দীর্ঘ বিচ্ছেদ হয়। আমরা বড় হই; বিয়ে করি। তারপর আমাদের দেখা হয়েছে কালেভদ্রে।

এরও বহু বছর পর মনিজার চিঠিটি এল। তার জীবন সংকটাপন্ন। কালব্যাধি ক্যানসার বাসা বেঁধেছে তার দেহে। আমার ভাসমান জীবনের কথা জানতে পেরেই সে আমার দিকে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমারও থাকা-খাওয়া, মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই হবে। বিনিময়ে মৃত্যুপথযাত্রী বোন ও বন্ধুকে একটু সেবা ও দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে। এ আর এমন কী? আমার মন কেঁদে উঠল মনিজার কষ্টে। আমিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম। এসে উঠলাম মনিজার সংসারে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের মৃত্যুর পর মনিজাই হয়েছিল এই বাড়ির একমাত্র মালিক। তাই জন্ম থেকে তার জীবন কেটেছে এই বাড়িতেই।

অনেক দিন পর বাড়িটিতে ঢুকে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল আমার। এই বাড়িতেই ব্লাড ক্যানসারে ভুগে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে মনিজা। বিয়ের পর কিছুদিন সে স্বামীর সঙ্গে এখানে-সেখানে ভাড়া থাকলেও পরে একসময় তারা এ বাড়িতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। তার বাবা-মায়ের বয়স বাড়ার পর তাদের দেখাশোনার মতো তেমন কেউ ছিল না। সেজান ও মুনিয়ার জন্মও এই বাড়িতেই। এই বাড়িটি তাই শুধু মনিজার সংসারজীবন, মা হওয়ার স্মৃতিবিজড়িতই নয়; বাড়ির প্রতিটি ঘর আসবাবপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার স্মৃতিময় শৈশবও।

আমি যখন এ বাড়িতে এলাম, মনিজার ঘরটি তখন ছোটখাটো একটি নার্সিংহোমের রূপ পেয়েছিল। ফিনাইল দিয়ে ঘরের মেঝে, বাথরুম পরিষ্কার করা হতো। বিছানার পাশের একটা সেলফে সাজানো থাকত তার ওষুধপত্র, ইনহেলার। বিছানায় সাদা ধবধবে চাদর, সাদা বালিশের কভার, মনিজার গায়ে দেওয়া থাকত একটি সাদা কম্ফোটার। তাকে দেখাশোনার জন্য নার্স আসত দুবেলা। মনিজা আমাকে ডেকে এনেছিল তার শেষদিনগুলোতে শুধু তাকে সঙ্গ দেওয়া, পাশে বসে দুটো সুখদুঃখের কথা বলার জন্য। তা ছাড়া তার এত বড় বাড়িটির একটু দেখাশোনা করা, হাল ধরার জন্য।

আমার জন্য নিজস্ব একটি ঘর বরাদ্দ থাকলেও আমি মনিজার শোবার ঘরেই আরেকটি সিঙ্গেল খাট পেতে নিজের শোবার ব্যবস্থা করেছিলাম। কারণ, তার স্বামী সিরাজ আহমেদ অসুস্থ স্ত্রীর কষ্ট, ব্যথার আহাজারি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। মনিজার নিদ্রাহীনতা ও হতাশা সিরাজ সাহেবকেও অসুস্থ করে তুলেছিল। তাই ডাক্তারের পরামর্শে সিরাজ সাহেব অন্য একটি ঘরে নিজের শোবার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। মনিজার সেই শোবার ঘরে ঢুকলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন অদ্ভুত একটা গন্ধ তৈরি হয়েছিল ঘরটিতে। মৃত্যুর গন্ধ! আমার মাথা ঝিমঝিম করত সেই গন্ধে।

তবুও অসুস্থ বোনকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য আমি তার সাথেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করে নিলাম। অসুস্থতার বাড়াবাড়ির সময়টাতে সেজানও খুব ঘনঘন আসত তার মাকে দেখতে। কিছুদিন পর মনিজার মেয়ে মুনিয়াও ওয়ানওয়ে টিকিট কেটে চলে এসেছিল মায়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকার জন্য। সবাই জানত, ধেয়ে আসছে মনিজার মৃত্যুদূত। শুধু মৃত্যুর সঙ্গে মনিজার চোখাচোখি আর আলিঙ্গনের অপেক্ষা।

সেই হিমশীতল মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে মনিজার ডুকরে ওঠা চাপা কান্না, করুণ বিলাপ ও আর্তনাদের করুণ সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি। কান্নার সেই সুর আমার রাতের ঘুমকে বিপর্যস্ত করে তুলত। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত তার মধ্যরাতের ঘুমহীন বিলাপে। না, তবুও আমি সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে আমার খেলার সাথিকে একা ফেলে চলে যাইনি। কৃতজ্ঞতায় আর আবেগে মনিজা অনেক কথাই বলত; অনেক প্রতিশ্রুতি দিত। আমি সেগুলোকে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর খাপছাড়া প্রলাপ হিসেবেই ধরে নিতাম।

মনিজার চলে যাওয়ার পর্বটি ছিল খুব গোছানো। সবাই প্রস্তুত ছিল। তাই অত্যন্ত শান্ত সমাহিতভাবে সে চলে গেল। কিছু দীর্ঘশ্বাস আর চাপা কান্না ছাড়া ঘরে কোনো আর্তনাদ হলো না। সে চলে যাওয়ার পর আমি তার শোবার ঘরটিকে নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছিলাম। ঘর থেকে দীর্ঘ রোগভোগের চেহারা একদমই বদলে দিয়েছি। ঘর সাজিয়েছি একেবারে সেই আগের মতো করে। মনিজার নিজের হাতে কাজ করা বিছানার চাদর বিছিয়ে বিছানা তৈরি করেছি। বেডসাইড টেবিলের ফুলদানিতে রেখেছি সাদা সতেজ রজনীগন্ধার ডাঁটা। পাশেই ফটো স্ট্যান্ডে মনিজার তরুণী বয়সের একটি বাঁধানো ছবি। ছবিতে সে গালে টোল ফেলে হাসছে। তার লম্বা বেণি বুকের একপাশ ঘেঁষে কোমর পর্যন্ত এসে পড়েছে। সেজান আর মুনিয়ার ছোটবেলার ছবি, সিরাজ আহমেদ ও মনিজার বিয়ের ছবি বাঁধানো ছবি স্ট্যান্ড শোভা পাচ্ছে কাঠের ওয়ার্ডরোবের ওপর। তার পাশেই রাখা মনিজার কয়েকটি প্রিয় গল্পের বই। এসব কিছু যেন তাদের আগের জীবনকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ঠিক এভাবেই হয়তো একসময় এই ঘরটি সাজানো থাকত। মনিজা চঞ্চল পায়ে ঘরময় হাঁটাচলা করত। এ ঘর ও ঘর করত। সেজান আর মুনিয়ার সঙ্গে হয়তো ‘হাইড অ্যান্ড সিক’ খেলত। সিরাজ সাহেব, সেজান ও মুনিয়ার যাতে মনে হয়, মনিজা হয়তো রান্নাঘরে, ছাদে বা বাড়ির অন্য কোনো ঘরে আছে, এক্ষুনি এসে তাদের দেখেই জড়িয়ে ধরবে—ঘর সাজানোর সময় এসবই আমি মাথায় রেখেছিলাম। মৃত্যুর পর মনিজাকে তার বাড়ি ও প্রিয়জনের মন থেকে বিতাড়িত করার কোনো অভিসন্ধিই আমার ছিল না।

এই বাড়িতে একটি ‘খেলাঘর’ আছে। খেলাঘরটি মনিজার বাবার তৈরি করা। এ ঘরে আমিও একসময় মনিজার খেলার সঙ্গী ছিলাম। এরা দুই ভাইবোনও এই খেলাঘরে খেলেই বড় হয়েছে। মনিজার ইচ্ছায় ঘরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আমি সযত্নে গুছিয়ে রাখতাম। ঘরের এক কোণে একটি ডিভান পাতা, তাতে চার-পাঁচটি সুদৃশ্য কুশন রাখা। একটি লেখালেখির টেবিল, তার সামনে দুটো কাঠের চেয়ার পাতা। দুটো বেতের মোড়ার সামনে একটি নিচু হাইটের কাঠের গুঁড়ির টেবিল। মনিজার এই ছোটবেলার খেলাঘরে তার নিজের হাতের তৈরি পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, কড়িকাঠের তৈরি গুঁটি সবই আজও তেমনি আছে। মায়ের খেলাঘরটি মেয়ে মুনিয়াও সযত্নে গুছিয়ে রাখত। সেখান থেকে কিছুই খোয়া যেতে পারেনি। কারণ, এই খেলাঘরটি যেমন তার মায়ের ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত, তেমনি তার নিজেরও। সেখানে আরও যোগ হয়েছে মুনিয়ার শখের জিনিসপত্রগুলো। তার প্রিয় গল্পের বই, ছবি আঁকার স্কেচ বুক, রং, তুলি, তবলা, হারমোনিয়াম, গিটার, পুরোনো বাতিল হয়ে যাওয়া রেডিও, টেলিফোন সেট, ছবির অ্যালবাম...আরও কত কী! মুনিয়া বিয়ের পর নিউইয়র্কে চলে গেলে ঘরটি বেশির ভাগ সময়ই তালাবদ্ধ থাকত। মনিজা মাঝেমধ্যেই কাজের বুয়াকে দিয়ে ঘরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে রাখত।

সে মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগেও বেশ ক’বার এই ঘরে এসে বসেছিল। এখানে বসে নানা অতীত স্মৃতি নিয়ে গল্প করেছে। মনিজা তার ছোটবেলার, বাবা-মার গল্প বলত। মানিজার অনুরোধে মুনিয়া তাকে পুরোনো দিনের প্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনাত। শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও সর্বত্রই মনিজার স্মৃতিকে অবিকলভাবে ধরে রাখা হয়েছিল এই বাড়িতে।

লক্ষ্য করলাম, মায়ের মৃত্যুর পর এরা দু ভাইবোন একত্রে ছাদে গিয়ে বসত। তাদের মধ্য ফিসফাস কথা হতো। আমি সেখানে অনাহূত ভেবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমার মনে হচ্ছিল, আমার বিদায়ের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। সেজান আর আগের মত ঘনঘন আসতে পারছিল না। একটি কঠিন মৃত্যুর পর, ব্যাপারটা অপ্রিয় সত্য হলেও সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। জীবন কখনো থেমে থাকে না। জীবিতদের চলতে হয় জীবনের নিয়মেই। তাই ধীরে ধীরে সবাই যার যার কাজে ফিরে যায়। মুনিয়ারও নিউইয়র্কে ফেরার তাড়া শুরু হলো। বুঝতে পারলাম, মুখচোরা সিরাজ সাহেব কখনো শালীনতার সীমা না ছাড়ালেও সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমার ওপর আশ্রয় করেই যেন বাঁচতে চাইছিলেন। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। এত বড় প্রলোভন উপেক্ষা করার শক্তি আমার কই?

না, আমাকে চলে যেতে হয়নি। মনিজা তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। মৃত্যুর আগে সে তার কন্যাকে কিছু দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। তার একটি হলো আমার বিয়ে। নিঃসঙ্গ স্বামী যাতে অসুস্থ হয়ে ভেঙে না পড়ে, তার এত বড় বিশাল বাড়িটি যাতে হালভাঙা নৌকার মতো ডুবে না যায়, আমাকে যাতে স্রোতের শেওলার মতো ভেসে বেড়াতে না হয়, তার একমাত্র সমাধান ছিল আমার সঙ্গে সিরাজ সাহেবের বিয়ে। বিচক্ষণ মনিজা তার সব ব্যবস্থাই করে গিয়েছিল। তাই মুনিয়া নিউইয়র্ক চলে যাওয়ার আগে ক’জন আত্মীয়-স্বজনকে একত্র করে মায়ের আদেশ পালন করে গেছে। অনেক আত্মীয় মুচকি হেসেছে, অনেকে আজেবাজে মন্তব্য করেছে। কিন্তু দু ভাইবোন কঠোর অবস্থান নিয়ে ঝড় সামলেছে।

না চাইতেই মনিজার ফেলে যাওয়া সমস্ত সুখ শান্তি আমার হাতে এসে ধরা দিয়েছে। স্বামীর আদর, ভালোবাসা, সন্তানের মমতা, বাড়ি, গাড়ি, অর্থ সব পেলাম অযাচিতভাবেই। জীবন কানায় কানায় ভরে উঠল। কিন্তু কী একটা অদৃশ্য শক্তি যেন অহর্নিশ আমায় খোঁচাতে লাগল। স্যাটেলাইট ক্যামেরার মতো এক জোড়া চোখ যেন আমায় অদৃশ্য থেকে সারাক্ষণ অনুসরণ করতে শুরু করল। আমি অচিরেই হাঁপিয়ে উঠলাম। আমার সব আনন্দ, সমস্ত সুখ যেন হতাশায় বিলীন হতে শুরু করল।

আমি সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। রাতের বিছানায় আমার আর স্বামীর মাঝখানে যেন শীতল স্রোত বয়ে যেতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সেই চোখ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো। আমি চোখের সঙ্গে সঙ্গে মানুষটির আবছা একটি অবয়বও দেখতে শুরু করলাম। সে নিশুতি রাতে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ায়। তার সাজানো শোবার ঘরে, খেলাঘরে আমি তার উপস্থিতি টের পেতাম। খুব আপন, খুব ভালোবাসার এই মানুষটিকে ভয় পাচ্ছি ভেবে আমার এক ধরনের অনুতাপও হচ্ছিল। কিন্তু কী করব? জীবিত ও মৃতের মধ্যে জীবন যেন বিশাল দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ব্যবধান ঘোচাতে হলে জীবন বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় নেই। হিমশীতল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেই কেবল আমি তার কাছে পৌঁছাতে পারি।

আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমার সাজানো জীবন আবারও বিপর্যস্ত হয়ে উঠল। আমাকে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হলো। ডাক্তার আমাকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিলেন। বললেন, আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, আমাকে এই আবাস ছাড়তে হবে। এই মায়াজাল ছিঁড়তেই হবে। ঘরপোড়া গরুর মতো আমিও সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেলাম। আমাকে পালাতে হবে সেই এক জোড়া চোখের সীমানা থেকে। অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরা রাহুর হাত থেকে আমাকে মুক্ত হতেই হবে!

অবশেষে আমি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হলাম, এই জীর্ন পুরোনো বাড়িটি এখন ভাঙার সময় হয়েছে। এখানে বসবাস আর নিরাপদ নয়।

আজই শেষ রাত। আমাদের কাপড়চোপড় সব প্যাক করা হয়ে গেছে। সিরাজ বলছিল, বাড়ির অনেকগুলো আসবাবপত্রই খুব দামি। বেশির ভাগই বার্মাটিক সেগুন কাঠের। ইচ্ছে করলে আমাদের ভাড়া করা ছোট ফ্ল্যাটবাড়ির জন্য আমি দু-একটি আসবাব এখান থেকে নিয়ে যেতে পারি। অথবা সবকিছু নিলামে তুলে বিক্রি করে দিতে পারি। কিন্তু আমার মিনতিভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সে আর পুরোনো আসবাব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেনি। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘প্লিজ, আমাকে শুধু শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও, নতুন সংসারটি হবে শুধু আমার নিজের হাতে গড়া। যেখানে অন্য কারও ছায়া থাকবে না। আমি ছায়া থেকে মুক্তি চাই!’

আজ বিকেল থেকেই আকাশজুড়ে মেঘ করেছিল। রাতে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া ও প্রচণ্ড বিজলির চমকে সমস্ত বাড়িঘর যেন থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ভয় হলো, পুরো বাড়িটিই মনে হয় মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। কোথাও ভয়ানক শব্দ করে জোরে বাজ পড়ল। আমি ভয়ে সিরাজের গলা জড়িয়ে ধরলাম। সে আমাকে তার বুকে আশ্রয় দিয়ে অভয় দিল, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমি ঝড়বৃষ্টির ঠান্ডা আমেজে, স্বামীর বুকের উষ্ণ উত্তাপে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ করেই যেন ঘুমের মধ্যেই আমার শ্বাসরোধ হয়ে এল। মনে হলো কেউ আমাকে গলা টিপে মারার চেষ্টা করছে। আমি হাত-পা ছুড়ে গোঙাতে শুরু করলাম। ‘বাঁচাও…আমাকে বাঁচাও!’ কিন্তু আমি অনুভব করলাম, কেউ একজন যেন একটি সাদা কম্ফোটার দিয়ে আমার দেহ মুড়ে দিতে চেষ্টা করছে। আর আমি প্রাণপণে সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করেই দেখলাম সেই অন্তর্ভেদী চোখজোড়া আমার দিকে যেন নির্মম ও ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বাতাসে তার অশরীরী আবছা অবয়ব আন্দোলিত হচ্ছে। আমি অসহায় কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠলাম। আমার শরীর অবশ ও নিথর হয়ে এল। আমি কেবল বোবা চোখে তাকিয়ে রইলাম বাকরহিত হয়ে।

হঠাৎ বিজলির আলো ঝলসে উঠতেই দেখলাম সিরাজ উঠে বসেছে। আমার সারা শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, ‘সুরমা কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? ভয় পেয়েছ? তুমি মনে হয় কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলে।’

‘দুঃস্বপ্ন!’ মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্নই হবে। দুঃস্বপ্নই দেখছিলাম। চারিদিকে তাকিয়ে আমি সবকিছু বোঝার চেষ্টা করলাম। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। সিরাজ মমতামাখা স্বরে বলল, ‘হুম, অনেক সময় স্বপ্নে বোবায় ধরলেও মানুষ এমন গোঁ গোঁ শব্দ করে।’ আমার সারা শরীর তখন শীতে, তীব্র ঠান্ডায় কাঁটা দিয়ে উঠেছে। সিরাজ এবার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটি সাদা কম্ফরটার আমার বুক অবধি টেনে দিয়ে বলল, ‘আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। সকাল হতে আর দেরি নেই। ঝড়ের বেগও কমে এসেছে।’

আমি অবাক হয়ে নির্জীব কণ্ঠে বললাম, ‘তুমি এই কম্ফোটার কোথায় পেলে?’ ‘বড় সুটকেসটি থেকে বের করেছি। মাঝরাতে দেখলাম, তুমি শীতে কাঁপছ। হাতের কাছে গায়ে দেওয়ার কিছুই রাখনি। তাই লাগেজ খুলে কম্ফোটারটি বের করলাম।’ বেঁচে থাকার প্রবল এক আনন্দে, ভালোবাসার গভীর আবেশে সেই এক জোড়া ক্রুদ্ধ চোখকে অবহেলা করেই আমি আমার স্বামীর গলা জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।