স্বপ্নে দেখা স্বপ্ন

সুমন বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারল, আজ রাতটা এই অজপাড়া গাঁয়ের কুঠিবাড়িতেই কাটাতে হবে। পরিকল্পনা ছিল, রাতে কুষ্টিয়া শহরে থাকার। কিন্তু যে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা আর সম্ভব না। বৃষ্টির মাঝে সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারেও বেশ বোঝা গেল কুঠিবাড়ির বিশালত্ব। বেশ বড় একটা এলাকা নিয়ে বিশাল ভবনের ধ্বংসাবশেষ। দেখলেই বোঝা যায়, কোনো এক সময় নীলকর সাহেবদের কি ধরনের দাপট ছিল এ এলাকায়।

সুমন যে সংস্থা পরিদর্শনে এসেছে তার পরিচালক আলম সাহেব। এই ধ্বংসাবশেষের মাঝেই গড়ে তুলেছেন একটি বেসরকারি সংস্থা। যৌবনে বামপন্থী রাজনীতি করতেন। এখন এনজিও করেন। এ তথ্য সুমন ঢাকা অফিস থেকেই জেনে এসেছে।

—আপনাদের সংস্থার নাম তো নিজপথ, মানে নিরাশ্রয় জনতার পাশে থাকি। তাহলে আপনারা কি শুধু নিরাশ্রয় মানুষদের নিয়েই কাজ করেন?
—না, ঠিক তা নয়। আমরা ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করি। তার মাঝে নিরাশ্রয় মানুষও আছে। কাল সবকিছুই দেখতে পারবেন।
—আচ্ছা, আপনি তো এক সময় বাম রাজনীতি করতেন। আর এখন এনজিও করছেন। দুটিকে কীভাবে দেখেন আপনি?
—আগে বড় পরিসরে স্বপ্ন দেখতাম। এখন স্বপ্নগুলোকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছি। আগে সারা বিশ্ব পরিবর্তন করে ফেলতে চাইতাম। এখন একজন দুজন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। মোটা দাগে আমি এভাবে দেখি।
কথাগুলো শুনে সুমন যখন ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক দিচ্ছিলেন তখন আলম সাহেব তাঁর পিয়নকে ডেকে সুমনের ব্যাগপত্র গেস্টরুমে নিয়ে যেতে বললেন।
—আপনি রাতে একা থাকতে ভয় পাবেন না তো? ওর নাম সাত্তার। আপনি ভয় পেলে সে রাতে অফিসে থাকবে।
—না, ভয়ের কিছু নেই। তবে শুনেছি, এক সময় এদিকে নাকি সর্বহারাদের বেশ দাপট ছিল। তাদের এখন কি অবস্থা?
—ওরা এখনো কেউ কেউ সক্রিয় আছে। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার এরিয়াতে কেউ পা দেবে না। আপনার ভূত প্রেতের ভয় নেই তো?
—ভূতে আমার বিশ্বাস নেই। তবে ভূতের গল্প পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আমার ব্যাগে আজও একটা ভূতের গল্পের বই আছে। এই বৃষ্টির দিনে পুরোনো নীলকুঠিতে শুয়ে রাতে একা একা ভূতের গল্প পড়তে ভালোই লাগবে বলে মনে হচ্ছে।
—তা হলে আপনি গেস্টরুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন আর ভূতের গল্প পড়তে থাকুন। কাল সকালে দেখা হবে।

সাত্তার মিয়ার সঙ্গে যেতে যেত সুমন পুরোনো নীলকুঠির বিশালত্বকে আরও একবার ঠাওর করার চেষ্টা করল। একটা চওড়া দেয়াল বা মেঝে মাটি সমান করে ভেঙে রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অফিস ঘর থেকে এই রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর আরেকটা ভবনের ধ্বংসাবশেষ। তার মাঝে একটা ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে দুই রুমের গেস্টহাউস। তারই একটা রুমে সুমনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশের রুমটি ব্যবহৃত না হওয়ায় সেখানে নোংরা, মাকড়সা আর চামচিকার রাজত্ব। গেস্টহাউসের নিচের একতলার অংশটি জানালা দরজাহীন লতাগুল্মে পরিপূর্ণ। এক পাশে অদূরে স্রোতহীন গড়াই নদী কচুরিপানায় ভর্তি। জনহীন এই নির্জন গ্রামীণ পরিবেশে রাত কাটাতে হবে ভেবে সুমন মনে মনে বেশ রোমান্স অনুভব করে। বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে দেখে বিছানার ওপর মোবাইল ফোন বাজছে। বউয়ের ফোন। সেই একই অভিযোগ আর কান্নাকাটি।

—আমি রাতে একা থাকতে পারব না। তুমি চাকরি পাল্টাও। বাইরে বাইরে ঘুরতে হয় এমন চাকরি করার দরকার নেই।
—আমি তো কালই বাসাই ফিরে আসছি। একটা তো মাত্র রাত। এ ছাড়া কাজের মেয়ে তো আছে। ওকে রাতে বেডরুমে থাকতে বল।

সুমন অরুণাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। তাতে অরুণার কান্না আর কথা দুটিই বাড়তে থাকে। এর মাঝে মোবাইলের চার্জ শেষ। এমন সময় সাত্তার মিয়া রাতের খাবার আর একটা হারিকেন নিয়ে হাজির।
—স্যার, এই আপনার রাতের খাবার আর হারিকেন। যে বৃষ্টি আর বাতাস শুরু হয়েছে তাতে যেকোনো সময় কারেন্ট চলে যাবে। আমার ছেলেটার খুব জ্বর। না হলে আমি রাতে থেকে যেতাম। এ তল্লাটে তো আর কোনো মানুষ জন নেই। আপনার একা থাকতে কি খুব অসুবিধা হবে?
—না, না, অসুবিধা হবে কেন। আমি তো এখন খাওয়া শেষ হলেই ঘুমিয়ে যাব। তুমি বাড়ি গিয়ে ছেলের যত্ন কর।

সাত্তার মিয়া চলে যাওয়ার পর মোবাইলে চার্জ দিতে গিয়ে বুঝতে পারল ঘরে মোবাইল চার্জ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। খাওয়া শেষ করে ব্যাগ থেকে বইটা হাতে নিয়ে কয়েক পাতা পড়া শেষ করতেই কারেন্ট চলে গেল। হারিকেনের আলোটা একটু বাড়াতে গিয়ে বুঝতে পারল তেল শেষ। সুমনের ফিল্ড ট্রিপের চাকরি তাই ব্যাগে মোমবাতি রাখে। ব্যাগ থেকে একটা মোমবাতি বের করে মেঝের ওপর মোমবাতিটি জ্বালিয়ে দেয়। হারিকেনটা কিছুক্ষণ পরই নিভে গেল। সুমন বইটা বালিশের পাশে রেখে একটু চোখ বুজতেই কেমন যেন একটা হাসির শব্দ কানে এল। সুমন কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল কিসের শব্দ। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে মনে হলো কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আবার হাসির শব্দ। হাসির শব্দটা মেয়ে কণ্ঠের। মনে হয় কয়েকজন মেয়ে এক সঙ্গে হাসছে। কিন্তু ফিসফিস শব্দের মাঝে মনে হয় একজনের পুরুষের কণ্ঠ। সুমন বিছানায় উঠে বসে। দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কোনো শব্দ নেই। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কিসের শব্দ হতে পারে। হয়তো বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে কোনো কিছুর ওপরে তাতেই এমন শব্দ হচ্ছে। হতে পারে পুরোনো কুঠির ফাঁক ফোকরে বাতাস ঢুকে এমন শব্দ হচ্ছে। সুমন বিছানায় এসে বসে। বেশ কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন যেন একটা ঝিনিক ঝিনিক শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ একজন নূপুর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। না, ঠিক একজন নয়, মনে হয় কয়েকজন। এবার সুমন একটু ভয় পায়। ভাবে, হ্যালুসিনেশনের মতো কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তার নেই। সে অরুণার মতো অতটা দুর্বল চিত্তের মানুষ নয়। কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার সেই ফিস ফিস আর মেয়েলি কণ্ঠে হাসির শব্দ। মোমবাতিটা প্রায় শেষের দিকে। আর কোনো মোমবাতি নেই। সুমন কিছুটা অসহায়ের মতো বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে। মনে হচ্ছে মোমবাতি নিভে যাওয়ার আগে যেমন একটু দপ করে জ্বলে ওঠে তেমন ঘরময় একটা আলো। সুমন দেখে মোমবাতিটা তখনো জ্বলছে, সঙ্গে একজন ঘর আলো করে নাচছে। কোনো ভূতের মতো ভয়ংকর চেহারা নয়। পরির মতো। একজন নয় চারজন মিলে আলোটাকে কেন্দ্র করে নাচছে। কেমন একটা গন্ধ আসছে সুমনের নাকে। ফুলের গন্ধ। কেমন যেন মাতাল করা গন্ধ। কি ফুলের গন্ধ সুমন ঠিক মনে করতে পারে না। মোমবাতিটা নিভে গেলে চারজন পরি খাটের চার কোনা ধরে উড়াল দিল। ওরা সুমনকে নিয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। মনে হলো পূর্ণিমার রাত। চারদিকে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পুরোনো নীলকুঠিতে আলো পড়ে কেমন যেন জলরংয়ে আঁকা ছবির মতো মনে হয়। নদীর মাঝে কচুরিপানার বেগুনি ফুলগুলো আলোর মতো জ্বল জ্বল করছে। ছোট ছোট ঘর বাড়ি তার পাশে বিশাল একটা বটগাছ। সুমন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পারছে।

সকালে সাত্তার মিয়ার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। কারেন্ট সেই রাতে গেছে এখনো আসেনি। কারেন্ট আসলে মোবাইল চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আজ সকালে রোদ উঠেছে। রাতে দেখা স্বপ্নের কথা ভেবে বেশ মজা পায়। বাস্তবে যদি এমন হতো তাহলে কেমন হতো ভাবতেই সুমনের হাসি পায়। কিন্তু রাতের হাসির শব্দ আর ফিসফিস করে কথা বলার বিষয়টা তো বাস্তব ছিল। এই রহস্যটা আজ অবশ্যই উদ্‌ঘাটন করতে হবে।

বিছানায় একটু গড়াগড়ি দেওয়ার পর রেডি হয়ে অফিসে এসে দেখে আলম সাহেব ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন। নাশতা খেতে খেতে সুমন রাতের রহস্যজনক হাসির শব্দ আর পরির সঙ্গে ভ্রমণের বর্ণনা দেয় আলম সাহেবকে।

—তাহলে তো কাল রাতে আপনার সঙ্গে না থেকে ভুলই করেছি। আপনার সঙ্গে আমারও ‘পরি-ভ্রমণ’ হয়ে যেত।
বেশ জুতসই একটা শব্দ আবিষ্কারের আনন্দে আলম সাহেব একটু শব্দ করে হাসলেন। আলম সাহেবের হাসির শব্দটা শুনে সুমন বেশ অবাক হয়। এই শব্দটা তার খুব চেনা মনে হয়। ঠিক এই শব্দটা সে গতকাল রাতেও শুনেছে। সঙ্গে ছিল কয়েকটা মেয়েলি কণ্ঠের হাসি।
—কিন্তু ওই হাসির রহস্যটা কি বলতে পারেন? একটা পর্যায়ে আমি কিন্তু বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ যেন নূপুর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে।
—ওটা কোনো রহস্য নয়। ওই যে কাল জিজ্ঞাসা করছিলেন আমরা কী ধরনের নিরাশ্রয় জনতাকে নিয়ে কাজ করি। এরা হচ্ছে সেই নিরাশ্রয় জনতা। চারজন স্বামী পরিত্যক্তা নারী। আমাদের গেস্টরুমের পাশেই একটা ঘরে থাকে। বাটিকের কাজ আর কিছু হাতের কাজ করে। এগুলো

আমরা দেশের বাইরে পাঠাই। কর্ম এলাকা ঘুরে এসে ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আর ওদের কাজগুলোও তখন দেখবেন। রাতে হয়তো আপনি ওদের হাসির শব্দই শুনেছেন। আর সিঁড়িতে যে নূপুরের শব্দ সেটা হয়তো আপনার মনের ভয় থেকে শুনেছেন।
আলম সাহেবের কথায় সুমন কিছুটা আশ্বস্ত হয় বটে, কিন্তু আলম সাহেবের হাসির শব্দটা নতুন রহস্যের জট বাঁধে সুমনের মনে। তবে কি রাতে আলম সাহেব ওই নারীদের সঙ্গে ছিলেন? যদিও সে রহস্য উদ্‌ঘাটন করা সহজ নয়। তাই কথা না বাড়িয়ে দুজন মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কর্ম এলাকা পরিদর্শনে।

এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সুমন আরও এক জটিল রহস্যের জালে আটকা পড়ে। তারা যে রাস্তায় যেখানে যায় সেখানেই সুমনের মনে হয় রাতের বেলা স্বপ্নের মাঝে সে এই রাস্তা-ঘাট, দোকান, বটতলা, সবকিছু সে পরিদের সঙ্গে উড়ে উড়ে দেখেছে। সে আলম সাহেবকে বলে, রাতে সে পরিদের সঙ্গে এসব দেখেছে। শুনে আলম সাহেব একটু শব্দ করে হাসেন। সুমনের রাতে শোনা সেই পুরুষ কণ্ঠের হাসি। সুমন তার যুক্তিবাদী মন দিয়ে রহস্যগুলোর মাঝে একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বপ্নের জগৎ কীভাবে বাস্তব হতে পারে তা তার জানা নেই। মনের মাঝে একটা অস্বস্তি অনুভব করে। ফিরে আসে অফিসে।

সুমনকে নিয়ে যায় বাটিকের কাজ দেখাতে যান আলম সাহেব। গেস্টহাউসের পাশেই ছোট দুটি ঘরে বাটিকের কারখানা। রাতে এখান থেকে হাসলে বা কথা বললে গেস্টরুম থেকে শোনা যেতেই পারে। এ ভাবনা তাকে যতটা স্বস্তি দেয় তার থেকে হাজার গুন অস্বস্তি আর বিস্ময় তৈরি হয় চারজন মেয়েকে দেখার পর। ঠিক এই চারজনকেই সে দেখেছে রাতে পরি হিসেবে। এঁদের চেহারা তার চেনা। এমনকি তাঁদের শরীর থেকে রাতে পাওয়া সেই অচেনা ঘ্রাণটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।
—এঁরা তো আমার রাতে দেখা পরির মতো দেখতে।

শুনে নারীরা হেসে ওঠেন। আলম সাহেবও হাসেন। আবার রাতের সেই হাসি। সুমন এবার রীতিমতো অসুস্থ বোধ করে। শরীর ঘামতে থাকে।
আলম সাহেবকে বলে, আমাকে একটু কুষ্টিয়া শহর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমাকে এখনই ঢাকা ফিরতে হবে।

দুই.
সকালে ঘুম ভাঙতেই আবার সেই চার পরির কথা মনে পড়ল সুমনের। অরুণাকে এ কথা বলা যাবে না। এ ছাড়া সে নিজেই কোনো যুক্তি খুঁজে বের করতে পারছে না স্বপ্নে দেখা পরির চেহারা কীভাবে বাস্তব মানুষের সঙ্গে মিলে যায়।
—আজকেও কি বৃষ্টি শুরু হয়েছে?
—বৃষ্টি কোথায় দেখলে? সারা দেশে মানুষ বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে। কালকেও তো পেপারে দেখলাম কোথায় কোথায় যেন লোকজন ব্যাঙের বিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির আশায়। তুমি কি রাতে স্বপ্ন দেখেছ নাকি? অরুণা জানালার পর্দা সরাতে সরাতে উত্তর দিল।
—স্বপ্ন দেখব কেন? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ঘর অন্ধকার তাই বললাম।
—কেন, আমার মতো যাদের মাথা খারাপ তারাই বুঝি শুধু স্বপ্ন দেখে! তোমার মতো সুস্থ মানুষেরা বুঝি কোনো স্বপ্ন দেখে না?

সুমন বুঝতে পারে সে ভুল করে ফেলেছে। অরুণাকে এ ধরনের কথা বলায় ডাক্তারের নিষেধ আছে। বিয়ের পর আজ প্রায় এক বছর ধরে অরুণার মানসিক রোগের চিকিৎসা চলছে সুমনের বন্ধু ডা. আলীমের কাছে। আজই অরুণার রিপোর্ট দেখানোর জন্য আলিমের চেম্বারে যাওয়ার কথা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সুমন রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে।

বাইরে বেশ তাতানো রোদ হলেও আলিমের চেম্বারে এসি আছে। ডা. আলীমকে সব রিপোর্ট দেখানোর পর স্বপ্নে দেখা পরিদের গল্পটা বলল। বিষয়টার আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না, এটা কীভাবে সম্ভব?

ডা. আলিম বললেন, ‘এমনটা হতেই পারে। ধর, তোর কোনো আত্মীয়ের সন্তানকে ১০ বছর আগে দেখেছিস। সেই চেহারাটা তোর আবছা মনে আছে। ১০ বছর পর তুই যখন সেই ছেলেটাকে আবার দেখবি তখন তোর মনে পুরোনো চেহারাটার জায়গায় নতুন চেহারাটা প্রতিস্থাপিত হবে। এখন এই ছেলেটার নাম শুনলেই তোর নতুন চেহারাটা মনে পড়বে। তোর ক্ষেত্রেও এমন কোনো কিছু ঘটেছে। এটা এক ধরনের প্রতিস্থাপন।’
যুক্তিটা সুমন ঠিক মানতে পারল না। সমস্যাটা মাথার মধ্যে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে।

—আরে স্বপ্ন তো স্বপ্নই। ওসব বাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
—ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছি কিন্তু ঝেড়ে ফেলতে পরছি না তো। যখনই মনে হয় তখনই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করি।
—তাহলে তোকে একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। রাতে ঘুমের আগে খেয়ে নিবি। তারপর কাল সকালে আমাকে ফোন দিয়ে জানাবি কেমন বোধ করছিস।

তিন.
পরদিন সকালে সুমন ডা. আলীমকে ফোন দিয়ে জানাল, আসলে তার পুরো ঘটনাটাই ছিল একটা স্বপ্ন। সে কোনো ফিল্ড ট্রিপেই যায়নি। এক মাস আগে সে যে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তাতে তাকে কোনো ফিল্ড ট্রিপেই যেতে হয় না। তবু এখনো তাকে আগের চাকরির ফিল্ড ট্রিপের যন্ত্রণা তাড়া করে ফেরে। যে সমস্যার কারণে অরুণা পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

ডা. আলীম বললেন, সেটা আমি কালই বুঝেছিলাম। তোকে বলিনি কারণ তাতে তোর মনের ওপর চাপটা আরও বাড়ত। তবে তুই যাই বলিস, তোর পরির গল্পটা কিন্তু বেশ মজার ছিল।
এই নিয়ে দুই বন্ধুতে যখন খুব হাসাহাসি হচ্ছে তখন অরুণার ধাক্কায় সুমনের ঘুম ভাঙল।
—ঘুমের ভেতরে ওভাবে হাসছ কেন? উঠে পড় সকাল হয়ে গেছে।
সুমন চোখ বন্ধ করে ভাবল, সারা রাত ভরে এতগুলো স্বপ্ন ধারাবাহিক ভাবে দেখলাম! হয়তো কোনো একদিন ঘুম ভেঙে মনে হবে সারা জীবন একটা স্বপ্ন ছিল। আমি হয়তো ভিন্ন কোনো গ্রহের বাসিন্দা।