মুজিববর্ষের আয়োজন হওয়া উচিত বিচক্ষণ

বর্তমানে পৃথিবীতে মোট দেশের সংখ্যা ১৯৭, যার মধ্যে ১৯৩টি জাতিসংঘের সদস্য। দুটি রাষ্ট্র হলি সি (ভ্যাটিকান সিটি) ও ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়নি। এ ছাড়া তাইওয়ানকে জাতিসংঘের ২১টি সদস্য দেশ স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, এখনো তাইওয়ানকে গণচীনের অধিভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার হলি সিসহ ১১০টি দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পরও কসোভোকে এখনো সার্বিয়ার অংশ হিসেবে মনে করা হয়।
এই যে পৃথিবীতে এতগুলো দেশ, এত বিভক্তি, প্রতিটি দেশ সৃষ্টির পেছনে অনেকগুলো মহৎ উদ্দেশ্য জড়িত থাকে। অনেক সংগ্রাম, অনেক ত্যাগের ইতিহাস থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই একটি সার্বভৌম ভূখণ্ডের মানচিত্র আঁকা হয়, একটি স্বাধীন জাতিসত্বার জন্ম হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসও তেমন ঘটনাবহুল। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিকে ত্যাগ করে অনেক রক্তের বিনিময়ে অনেক কষ্ট সয়ে আজকের এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভিতটি রচিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস অনেক গৌরবোজ্জ্বল, যা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। সেই ইতিহাসের পথে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ব্রতই আমাদের চালিত করেছে, পথ দেখিয়েছে। ইতিহাসের পাতায় যে কজন মহান রাজনীতিকের নাম উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে তাঁরা হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহান রাজনীতিবিদ ও গণমানুষের নেতারাই ধাপে ধাপে নির্ণয় করে দিয়েছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাঁদের ধারাবাহিক কাজের ফল হিসেবেই এ দেশের মানুষ বিশ্বের বুকে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন মানচিত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শোষণ, নির্যাতন, ভেদাভেদ ও প্রতিহিংসামুক্ত পরিবেশ পেতেই তো মূলত সব আন্দোলন-সংগ্রাম।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যখন পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে আমাদের নেতারা পরিকল্পনার ছক আঁকছিলেন, তখন তাঁরা তাদের জন্মভূমিকে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনেছিলেন। আমাদের সেই রাজনীতিবিদেরা বাংলার গণমানুষকে, পাকিস্তানি শোষণ, নিপীড়ন ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। দেশের অধিকাংশ মানুষ সে পরিকল্পনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সে যুদ্ধ জয়ের এ অবিশ্বাস্য গল্প মোটামুটি অনেকেরই জানা। আমি সেদিকে যাব না। আমি আজ কথা বলব মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও আমাদের অর্জন নিয়ে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফেরার পথে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি সমাবেশে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বাংলাদেশের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘Bangladesh stands for socialism, secularism and democracy.’ এর পরের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের ভেতর দিয়ে, ক্ষমতার লালসায় টানা হ্যাঁচড়ায় অসভ্য রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগণকে শুধু দ্বিধাগ্রস্ত জাতিতে পরিণত করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের মাধ্যমে, আমরা আশা করেছিলাম এবার হয়তো আমরা সুশাসন ও গণতন্ত্রের পথে দৃঢ় পায়ে হাঁটা শুরু করব। কিন্তু না, তৎকালীন নির্বাচনে বিজয়ী দল বিএনপির রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অন্তরালে দেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে সাম্প্রদায়িক শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির, ফতোয়াবাজ ও ভণ্ড কাঠমোল্লাদের দলগুলো। ধর্মীয় অনুভূতি বিস্তারের আড়ালে চলল সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের সাংগঠনিক তৎপরতা।
স্বাধীনতা অর্জনের তিন দশক পার হওয়ার আগেই স্বাধীনতাবিরোধীরা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত লাভ করে। রাজাকার নেতার গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবের পতাকা উড়তে দেখে খারাপ লাগত সবারই। আমরা তখন অনেক আফসোস করতাম, অনেক সমালোচনা করতাম। তারপর পটপরিবর্তনের আগে ঘটে গেল ১/১১-র ঘটনা। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের সরকার। নির্বাচনী ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আলোচনায় ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের আশ্বাস। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোট পরপর তিনবার সরকার গঠন করল। বিরোধী জোটের অপবাদ, অভিযোগ সত্ত্বেও তারা টিকে থাকল রাষ্ট্রক্ষমতায়। বিশেষ করে তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকা বা সরকার গঠনের সুযোগ, দুটি কারণে আওয়ামী লীগের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই মেয়াদেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন হবে। এটি নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি সুযোগ।
আমরা দেশের সাধারণ জনগণও চেয়েছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ যথাযথ মর্যাদায় আমাদের দেশে উদ্‌যাপিত হোক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি থাকলেও, মুজিববর্ষ উদ্‌যাপনের ক্ষণ গণনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। শতসহস্র কর্মপরিকল্পনা নিয়ে জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজনের মধ্যে আয়োজকেরা, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো মুজিব আদর্শের কিছু স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নিতে ভুল করে বসে আছেন। এ মাসের শুরুর দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমে ঘোষণা দিলেন, মুজিব জন্মশতবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে চারজন বিদেশি নেতা বাংলাদেশ সফরে আসছেন এবং মূল অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এরা হচ্ছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, ভারতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধী এবং ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী। অতিথি তালিকার প্রথম তিনজনকে নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেননি। আপত্তি উঠছে শেষ নামটি নিয়ে। অনেক মাধ্যম থেকেই আপত্তিটি তোলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উচিত হবে, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি নির্বাচনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে নিজেদের ভুল আগেভাগে সংশোধন করে নেওয়া। আর যদি সংশোধনের উদ্যোগ নিতে তাঁরা ব্যর্থ হন, তাহলে দেশের সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী একটি বাজে সুযোগ পাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এটি সংশোধন না করা হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরই নৈতিক পরাজয় হবে। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান থাকবে।
আজ বাংলাদেশ যে অবস্থানে এসেছে, তার জন্য আমাদের দেশের ছাত্র, জনতা, রাজনীতিবিদ, কৃষক, শ্রমিক অনেকেরই অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আপামর জনতা বহুবার রাজপথে নেমে এসেছেন, ছাত্ররা-রাজনীতিবিদেরা বহুবার কারাবরণ করেছেন, নিপীড়ন সহ্য করেছেন। সাধারণ মানুষের রক্তে রাজপথ বহুবার রঞ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন রক্তের গাঢ় দাগ লেগে আছে। সেই সব মুক্তিকামী মানুষের উদ্দীপনায় ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের পুরোধা, আমাদের বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় এমন কিছু আমাদের করা উচিত হবে না।