ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কিছু নেই

ইশরাত নিশাত
ইশরাত নিশাত

যে সৃষ্টি করতে জানে, তার মৃত্যু নেই। সৃষ্টির মধ্যেই সে বেঁচে থাকে চিরকাল। নিশাত আপা ছিলেন তেমনি এক মানুষ। আপা বললে ভুল হবে, তিনি ছিলেন অনেকটা মায়ের মতো, শাসন-বারণের মধ্যেও নিবিড় ও নিখাদ এক ভালোবাসার নাম ইশরাত নিশাত। বড় অসময়ে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। ইশরাত নিশাত, প্রয়াত বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব নাজমা আনোয়ারের মেয়ে।
মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীকে প্রবাসী নতুন প্রজন্মের কাছে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার প্রয়াসে নিউইয়র্কের নাট্যকর্মী সীতেশ ধরের আমন্ত্রণে এসেছিলেন ২০১৭ সালে। নিশাত আপার ডাকে সাড়া দিয়েছিল নিউইয়র্কের বাংলাদেশিরা। বাংলা সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছেন মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। হাসান রাজা ছিলেন সিলেটের সন্তান। সিলেটের সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী গ্রামে জমিদারী ছিল তাঁর। সম্ভবত সেই কারণে সিলেটী ভাষায় নাটকটি রচিত হয়েছিল। মূলত সিলেটী ভাষা জানা নাট্যকর্মী খোঁজার কারণেই নিশাত আপার খুব কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম সে সময়। হাসন রাজা নাটকে চন্দ্রার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নিশাত আপা যখন প্রথম আমাকে বললেন, আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
সিলেটের কথাকলির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও সরাসরি মঞ্চনাটকে কখনো অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি। নিশাত আপা বললেন, ‘আগে স্ক্রিপ্টটা আমি পড়ি, তোরা শোন। যখন স্ক্রিপ্ট পড়তে লাগলেন, একে একে সবাই চুপ হয়ে গেলাম। বুকটা যেন ভারী হয়ে এল নাটকের গল্পটা শুনে। নিশাত আপার অনুপ্রেরণায় শেষে নাটকটিতে অভিনয়ের সাহস পেলাম। অভিজ্ঞ কিছু নাট্যকর্মী ও আমরা কয়েকজন নতুনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করলেন নিশাত আপা। শুরু হলো মহড়া। নিউইয়র্ক শহর তখন বরফে আচ্ছন্ন। বাইরে তুষার ঝড়, আর ভেতরে রিহার্সাল। টানা এক মাস শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যেতে থাকে হাসন রাজা নাটকের রিহার্সাল। হাসন রাজার পুরো টিম এক সময় হাসন রাজা পরিবারে পরিণত হয়ে যায়। নিশাত আপা’ই পেরেছিলেন এই ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোকে মায়ার সুতায় বাঁধতে। হাসন রাজা যৌবনে ভোগবিলাসী ও শৌখিন জীবনযাপন করলেও প্রতাপশালী এই রাজা পরবর্তী জীবনে আধ্যাত্মবাদ গ্রহণ করেন।
মোস্তাক আহাম্মেদের রচনা ও ইশরাত নিশাতের নির্দেশনায় দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও গানের সঙ্গে বিপার কোরিওগ্রাফি—সব মিলিয়ে নাটকটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল নিউইয়র্কের দর্শকদের মধ্যে। নাটকটি দেখতে কুইন্স থিয়েটারে বাঙালিদের ঢল নামে। নাটক শেষ হওয়ার পরও যেন মুগ্ধতার রেশ কাটে না দর্শকদের। আমেরিকায় বাংলা নাটকের ইতিহাসে যা ছিল বিরল ঘটনা। নিশাত আপার মুখে তখন ছিল তৃপ্তির হাসি। এর আগে তিনি লন্ডনে এই নাটক মঞ্চস্থ করেন। নিশাত আপা অকালে চলে যাওয়ায় থিয়েটার একজন অভিভাবক হারাল। আমরা হারালাম একজন নিবেদিতপ্রাণ। হাসন রাজা নাটক শেষে দর্শকদের মন্তব্য ছিল, নাটকটি আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে ভালো লাগত; ঠিক যেন নিশাত আপার আয়ুর মতো। আরেকটু দীর্ঘায়ু হলে কী এমন ক্ষতি হতো? কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি থেকে গেল; একটা হাহাকার থেকে গেল। পৃথিবী হয়তো আরও কিছু পাওয়ার ছিল তাঁর কাছ থেকে। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়ে চলে গেলেন ক্ষণজন্মা এই আবৃত্তিকার, নাট্যনির্দেশক ও আলোক নির্দেশক।
গত সেপ্টেম্বর মাসে আমার সঙ্গে শেষ দেখায় ইশরাত নিশাত বলেছিলেন, ‘জানিস মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কিছু নেই!’ আসলেই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি চিরবিদায় নিলেন। নিশাত আপা আপনি সবার হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন। যেখানেই থাকুন সৃষ্টিকর্তা আপনাকে ভালো রাখবেন নিশ্চয়ই।