রোমান্টিক নগরপিতার প্রত্যাশায়

রোমান্টিক মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন, কল্পনা করতে আরও বেশি ভালোবাসেন। রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে স্বপ্ন, কল্পনা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জীবনের রূঢ় বাস্তবতা মানুষের কল্পনা শক্তিকে দিন দিন দুর্বল করে ফেলছে। মানুষ এখন আর অনিন্দ্য সুন্দর স্বপ্ন দেখে সকালে আপনজনের সঙ্গে কথার বিনুনি গাঁথে না। আমাদের যৌবনে অনেক মার্ক্সবাদী পণ্ডিত বলতেন, শিশুদের রূপকথার গল্প শেখানো সঠিক কাজ নয়। সাম্রাজ্যবাদীরা চায়, রূপকথা শোনে বা শিখে শিশুরা কল্পনার জগতে যেন বসবাস করে। ভবিষ্যতে কল্পনার জগতে বুঁদ হয়ে থেকে ভাত, কাপড়, জমি, কাজের অধিকারের বিষয়ে নিস্পৃহ থাকে।
আরও মজার কথা শুনতাম। তার মধ্যে একটি হলো— সাম্রাজ্যবাদীরা কালো মানুষদের খেলাধুলা, সংগীতে মজিয়ে রাখে। যাতে করে কালো মানুষদের মাথায় অধিকার বোধ না জন্মে। চিরকাল তারা গৌরবর্ণ মানুষের দাস হয়ে থাকে। এসব কথা শুনে কয়েকটি প্রজন্ম কুয়াশা, ধোঁয়াশা, বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যৌবনের দিন পার করে ফেলেছে। আধুনিক মার্ক্সবাদীদের মানসিকতায় এত ছুৎমার্গ কাজ করে না। তাঁরা সবকিছুই ভাবেন।
সমাজে দেখা গেছে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে পানির দামে বিএমডব্লিউ কিনে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বা চালের মতো বিক্রি করে দেন। তাঁদের মতো করে ন্যায্য মূল্য নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সন্তানদের কল্পনা শক্তি বাড়ানোর জন্য তারাই আবার ‘রূপকথা’ শোনানোর ব্যবস্থা করেন। কারণ কল্পনা শক্তি ছোটবেলা না বাড়লে শিশুদের নাকি উদ্ভাবনী শক্তি জাগ্রত হতে পারে না।
কিছুদিন থেকে অনেক স্বপ্নের কথা শুনতে পাচ্ছি। এসব স্বপ্নে উদ্ভাবনী শক্তি নেহাত কম নয়। যারা আসন্ন ঢাকা সিটির উত্তর ও দক্ষিণে ভোট কামনায় অষ্ট প্রহর ব্যয় করছেন, তাঁদের কথা যখন শুনি তখন প্রার্থীদের অনেক স্বাপ্নিক মনে হয়। তাঁদের কল্পনা শক্তি যথেষ্ট প্রখর। উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তাঁদের মেয়াদ কালে ঢাকাবাসীদের আন্তর্জাতিক মানের ‘নাগরিকত্ব’ উপহার দেবেন বলে আশা করছি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিকেরা জানেন, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা উপহার পেতে যাচ্ছেন গ্রিন ঢাকা। সে ঢাকা হবে ক্লিন ঢাকা, শুধু ক্লিন হলেই হবে না ঢাকা হবে স্মার্ট ও প্রকৃত অর্থে আধুনিক।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের প্রধান চারজন মেয়র প্রার্থী এবং অসংখ্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা ছুটছেন গলি, উপগলি ও কাঁদা গলির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কী সুন্দর দৃশ্য। মেয়র কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে দলের ওয়ার্ড কমিটির সদস্য, পানের দোকানদার, মুদি, লন্ড্রি ব্যবসায়ী—কে নেই সেই ভোট প্রার্থনার মিছিলে। এই যে ভোটের প্রচারণার মিছিল, তা দেখলে মনে হয় শ্রেণিহীন সমাজ কায়েম হলো বলে। একেবারে বৈষম্যহীন অবস্থা ও অবস্থান। এই সোনার বাংলায় তো আমরা এমনটাই চেয়েছিলাম। নির্বাচন এলেই কী করে প্রার্থীরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বুঝে যান। প্রতিবেশী অটো রিকশার চালক যার দিকে চোখ তুলে কখনো তাকাননি প্রার্থী, পাড়ার মুদির দোকানে যিনি কখনো যাতায়াত করেন না—সেই তিনি বিগলিত হাসিতে মুদি ভাই, রিকশা চালক ভাইকে সমীহ করে ভোট প্রার্থনা করছেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে কী হবে, ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে এই যে সমীহ পাওয়া তাও বা কম কীসে! নির্বাচনের আগের এই কয়টা দিনকে মনে হয় অতি সাধারণ মানুষেরা খুব ভালোবাসেন। এ কারণে নির্বাচনের জন্য মানুষ অপেক্ষা করেন, নির্বাচনকে উৎসবে রূপান্তরিত করতে বাঙালিদের জুড়ি নেই। নির্বাচন এ দেশের মানুষের কাছে এক ধরনের বিনোদনের উপলক্ষও বটে। বারবার বঞ্চিত হওয়ার পরও মানুষের কাছে নির্বাচন বিশেষ একটি ঘটনা, কয়েক দিনের সম্মান লাভের একটি উপলক্ষ। জীবনে কী আর চাওয়া! এই যে একটু সম্মান, হোক তা মেকি কিংবা আসল, এই প্রাপ্তিকেও বাঙালিরা নগণ্য মনে করেন না। এই আত্মমর্যাদা যাতে সব মানুষ পায়, সে জন্যই তো দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ডিগনিটি অব লাইফ বা জীবনের মর্যাদা। এর প্রাপ্তি তো মানবাধিকার প্রাপ্তি। এই যে ইউরোপ, আমেরিকাতে যিনি পরিচ্ছন্নতা কর্মী আর যিনি রকেট সায়েন্স নিয়ে কাজ করেন তাঁদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় অন্তত ভেদাভেদ বোঝা যায় না। দুই পক্ষের কথাতে মনে হয় একই সমতলে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন। আমরাও কিন্তু তাই চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা প্রতিশ্রুতি ও চাওয়াকে খুব দ্রুত ভুলে যাই।
আসুন আমরা আবার ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিগুলোতে ফিরে আসি। কোনো প্রার্থী বলছেন, আমরা নিরাপদ ঢাকা উপহার দেব। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিরাপত্তার কোনো অভাব হবে না। নিরাপত্তার সঙ্গে আছে জলাবদ্ধতা দূর করা, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, ঢাকাকে সবুজ উদ্যানে পরিণত করে বায়ু দূষণ রোধ করা। ফুটপাত চলার উপযোগী করে তোলা। পরিবহন ক্ষেত্রে নিয়ম শৃঙ্খলা তৈরি করা। এগুলোই তাঁদের মূল প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতিতে প্রার্থীরা নানা চটকদার বাক্য, শব্দে উপস্থাপন করছেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রার্থীরা সরগরম করে রাখছেন তাঁদের প্রতিশ্রুতিগুলোকে নানা ভাবে উপস্থাপন করে।
একটি বিষয় সাধারণ নাগরিকেরা বুঝতে পারছেন না, তা হলো—এই যে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, নিরাপদ সিটি তাঁরা তৈরি করবেন কোথাও এর ব্যাখ্যা নেই যে কীভাবে তাঁরা এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। যে প্রার্থী বলছেন ঢাকা হবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ নগরী। তিনি কিন্তু বলছেন না, কীভাবে সমন্বয় করে নিরাপদ করবেন কিংবা নিরাপদ করার প্রক্রিয়ায় কারা যুক্ত থাকবেন। অনেকেই তাই এসব প্রতিশ্রুতিকে কথার ফুলঝুরি হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিশ্বাসযোগ্য ভাবে কোনো প্রার্থীই তাঁর কর্মসূচি ও কর্ম প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন, তিনি নির্বাচিত হলে নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্ট তৈরি করবেন। নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্টের ধারণা বহুদিন থেকে আলোচনাতে আছে। এর দৃশ্যমান রূপ কী হবে সাধারণ ভোটারেরা তা বুঝতে পারছেন না। প্রার্থীরা সিটি গভর্নমেন্ট শব্দটি উচ্চারণ করেই তাঁর বক্তব্য শেষ করছেন। এতে ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে। প্রার্থীরা যা বলছেন, সেই ধারণাকে পরিষ্কার না করলে মানুষ তাঁকে বা তাঁদের ভোট দেবেন কেন। মনে রাখতে হবে, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে বাস করা নাগরিকেরা দেশের সবচেয়ে সচেতন নাগরিকদের মধ্যে পড়েন।
প্রার্থীরা অনেকেই প্রচারে বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে অভিনব পন্থা অবলম্বন করছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ফুটপাতের চায়ের দোকানে ঢুকে নিজের হাতে চা বানিয়ে কর্মীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন; বাসে উঠে কন্ডাক্টরের মতো আচরণ করে ভোট প্রার্থনা করছেন। ভোট প্রার্থনাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে গিয়ে তাঁরা যে নিজেদের হাসির পাত্রে পরিণত করছেন, সে বিষয়টি তাঁরা ভেবে দেখছেন বলে মনে হচ্ছে না। যারা অন্তর দিয়ে অনুভব করে, অন্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যা সমাধান করে মানুষ তাঁদের পছন্দ করেন। আর যেসব নেতা করুণার বশবর্তী হয়ে সেবা করার ভান করেন সে ধরনের নেতাকে মানুষ পছন্দ করেন না।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কী কী করবেন, তা সারা দিন বলে যাচ্ছেন। কিন্তু কীভাবে করবেন তা বলছেন না। তাঁদের উচিত, তাঁরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন সে বিষয়টি পরিষ্কার তুলে ধরা। নির্বাচনী প্রচারণায় একটি বিষয় খুব পরিষ্কার মনে হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীরা মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হতে যাচ্ছেন। কোনো প্রার্থীই নিম্ন আয়ের মানুষের বসতি বা বাসস্থান নিয়ে তাঁদের সুস্পষ্ট কর্মসূচি কী, তা তুলে ধরছেন না। এ ছাড়া রিকশা চালক, হকার, পোশাক শ্রমিকসহ আরও বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কোনো সুস্পষ্ট কর্মসূচি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। প্রার্থীদের মনে রাখা উচিত, তাঁরা সব মানুষের প্রতিনিধি হতে যাচ্ছেন। বিশেষ কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেননি। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন বা প্রচারণা মিছিলে তাঁরা যেভাবে সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণ করছেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের সবার কথা ভাবতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষেরা যেন নির্বাচিত মেয়র বা কাউন্সিলরদের অগ্রাধিকারের তালিকার ওপরের দিকে থাকেন।
প্রার্থীরা কোলাকুলি করে যাদের ভোট আদায় করবেন, তাঁদের জন্য সিটি করপোরেশনের দুয়ার যেন খোলা থাকে। এ ক্ষেত্রে আমরা খুব আশাবাদী। কারণ অনেক প্রার্থীই বলছেন, সব মানুষের জন্য করপোরেশনের দুয়ার তাঁরা উন্মুক্ত রাখবেন।
আমরা চাই, গভীর রাতে কাজ শেষ করে নির্ভয়ে একজন নারী কর্মী তাঁর বাড়িতে যেন নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন। এ রকম পরিবেশ যেন জনপ্রতিনিধিরা তৈরি করতে পারেন। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে বাসস্থান যেন তলিয়ে না যায়। ঢাকা শহরের মানুষ বৃষ্টিতে যেন দুর্ভোগ না পোহায়, বরং তারা যেন বৃষ্টিকে উপভোগ করতে পারে।
আমরাও প্রার্থীদের মতো ভাবতে চাই—ঢাকা হবে উদ্যানের নগরী, পরিকল্পিত নগরীতে মানুষ মানুষের মতোই বসবাস করবে। এ নগরীতে বিদেশি অতিথিরা এসে আমাদের সংরক্ষিত ইতিহাস, ঐতিহ্য দেখে মুগ্ধ হোক। পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল একটি নগরী আমাদের বসবাস উপযোগী হোক।
আমাদের নগরপিতাদের মনে রাখতে হবে, তাঁদের সঙ্গে আছেন আরেকজন অদৃশ্য, সর্বজনপ্রিয় নগরপিতা। যিনি এই নির্বাচনে না থেকে ও আলোচনায় আছেন বারবার। যিনি ইতিমধ্যে এ দেশের নগরপিতাদের রোল মডেলে পরিণত হয়ে গেছেন। নির্বাচিত হলে, সেই সর্বজনগ্রাহ্য নগরপিতা আনিসুল হকের সঙ্গে নতুন নগরপিতাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে পূর্ণ মেয়াদ। তিনি কিন্তু শুধু রোমান্টিক কিংবা স্বাপ্নিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কর্মবীরও। তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য সাহসী বীরের মতো অবিরাম কাজ করে যেতেন। তাই আমরাও ভবিষ্যৎ নগরপিতাদের রোমান্টিক ও কর্মবীরের ভূমিকায় দেখতে চাই। আশা করি, এই দুইয়ের সমন্বয়ে তাঁরা প্রকৃত অর্থে একটি স্মার্ট ঢাকা গড়ে তুলতে পারবেন।