নীল শাড়ি

বিয়ের পর প্রথম মাসের বেতন পেয়ে শিমুর জন্য একটা নীল শাড়ি কিনে আনল রাসেল। এ বিষয়টা রাসেলের মায়ের তেমন পছন্দ হয়নি। তাই বলেই ফেললেন—উপলক্ষ ছাড়া অহেতুক অপচয় করার কি দরকার ছিল? এই বয়সে টাকা-পয়সা কীভাবে ভবিষ্যতের জন্য জমাবে সেটা চিন্তা করা উচিত। সংসারের প্রয়োজনীয় খরচের কী অভাব আছে!
শাশুড়ির এসব কথা বেডরুমে থেকে শুনেছে শিমু। মাকে কোনো উত্তর না দিয়ে রাসেল বেডরুমে চলে গেল। শিমু তার কাঁধ থেকে অফিসের ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে টেবিলে রাখল। তারপর বলল, তুমি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি চা করে আনছি। রাসেল তখন পেছন থেকে তার হাত ধরে ফেলে বলল, তুমি কি মায়ের কথায় মনে কষ্ট পেয়েছ। একটু হেসে শিমু বলল, আরে না।
সবাই মিলে এক সঙ্গে চা-নাশতা খাওয়ার পর রাসেল কিছুক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করল। রাতে খাওয়ার পর যখন ঘুমাতে গিয়েছে, শিমু তখন রাসেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল—তোমাকে একটা ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম। আজকে আমার বান্ধবী শিলার সঙ্গে কথা হয়েছে। সে যে ব্যাংকে চাকরি করে সেখানে নাকি লোক নেবে। তুমি যদি অনুমতি দাও আমি একটু চেষ্টা করে দেখতে চাই।
রাসেল বলল, তুমি পারবে বাইরে চাকরি করে ঘর সামলাতে। শিমু বলল অবশ্যই পারব, কোনো সমস্যা হবে না।
—তুমি যদি মনে করো তুমি পারবে, তাহলে মায়ের সঙ্গে একটু আলাপ করে দেখতে পারো। মা যদি অনুমতি দেয় তাহলে আমার পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই।
রাসেল এবার জিজ্ঞেস করল—শিমু শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে?
শিমু জবাব দেয়, অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে। রাসেল বলতে থাকল, জানো শিমু অনেক চেষ্টা করছি একটা ভালো চাকরির জন্য। এই প্রাইভেট কোম্পানিতে গত দুই বছর কাজ করছি। কিন্তু ২৫ হাজার টাকা মাসে বেতন। ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে, খাওয়ার খরচ, কলেজ পড়ুয়া দুই ভাই-বোনের খরচ চালিয়ে তোমাকে কিছুই দিতে পারি না।
রাসেলের বুকে মাথা রেখে শিমু বলল—হয়েছে তোমাকে এসব ব্যাপারে কোনো চিন্তা বা মন খারাপ করতে হবে না। তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছ। আমি অনেক সুখে আছি। আর সেটাই হচ্ছে বড় কথা। এখন ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে অফিস আছে।
পরদিন সকালে রাসেল অফিসে চলে যাওয়ার পর শিমু শাশুড়ির সঙ্গে আলাপে বলল—মা আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলাপ করতে চাচ্ছিলাম, আমার বান্ধবী যে ব্যাংকে চাকরি করে সেখানে নাকি লোক নিচ্ছে। আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি একটু চেষ্টা করে দেখতে চাই।
শাশুড়ি উত্তরে বললেন, তোমরা আজকালকার পড়াশোনা করা শিক্ষিত মেয়ে। তোমাদের কি ঘরে মন বসবে। তো আমি আর কি বলব। যদি মনে করো ঘরের সব কাজ সামলিয়ে বাইরে কাজ করতে পারবে তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারো।
শাশুড়ির কাছে পারমিশন পেয়ে শিমু খুশিতে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, থ্যাংক ইউ মা। আমি আজই বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ করে দেখব।
বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ করে শিমু পরদিন ব্যাংকে গেল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে। শিমুর ভাগ্য খুবই ভালো, সেদিনই তার ব্যাংকে চাকরিটা হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় শিমুর কর্মজীবনের ব্যস্ততা। বাসায় সবকিছু সামলাতে হয় আবার অফিস সামলাতে হয়। এভাবে এক মাস কেটে গেল।
প্রথম মাসে বেতন পেয়ে শিমু বাসায় ফেরার সময় একটা মার্কেটে ঢুকেছে। মার্কেট থেকে শাশুড়ির জন্য একটা শাড়ি, ননদের জন্য একটা সালোয়ার কামিজ আর দেবরের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছে। রাসেলের জন্য কিনেছে পারফিউম। বাসায় আসার পর সবাইকে ডেকে যার যার গিফট দিয়ে দিল। আর শাশুড়িকে বলল, মা আমি ২৫ হাজার টাকা বেতন পেয়েছি। পাঁচ হাজার টাকা গিফট কিনতে খরচ হয়েছে। এখানে আর ২০ হাজার টাকা আছে, এগুলো আপনি রাখেন।
শাশুড়ি বললেন—বউমা তুমি আমাকে এত সম্মান করেছ, আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমি জানি রাসেলের বেতনের পুরো টাকাটাই সংসারের কাজে খরচ হয়ে যায়। তুমি এখন থেকে তোমার বেতনের টাকাটা একটা সেভিংস অ্যাকাউন্টে রেখে দাও।
কয়েক মাস চাকরি করার পর শিমু জানতে পারে সে কনসিভ করেছে। কিন্তু নতুন চাকরি কাজ তো চালিয়ে যেতে হবে। এর কিছুদিন পরে হঠাৎ বাসায় একটা মেইল আসল। খুলে জানতে পারল, বিয়ের আগে রাসেল আমেরিকায় ডিভি লটারিতে অংশ নিয়েছিল। আর আজকে জানতে পারল, সে ডিভি পেয়েছে। তারা তো খুশিতে আত্মহারা, আবার অনেক ভয় ভেতরে কাজ করছিল। কারণ, আমেরিকায় ওদের পরিচিত তেমন কেউ ছিল না। শিমুর পরিচিত এক বান্ধবী ছিল। শিমু সেই বান্ধবী মিলির সঙ্গে আলাপ করল। ওরা আমেরিকার আটলান্টায় থাকে। পরে তার বান্ধবী মিলির স্বামীর সঙ্গে রাসেলও আলাপ করল।
ঠিক হয়েছে তারা প্রথমে আমেরিকা গিয়ে মিলিদের বাসায় উঠবে। এক মাসের মধ্যেই সবকিছু ঠিকঠাক করে রাসেল আর শিমু চলে গেল আমেরিকা। আটলান্টা মিলিদের বাসায়। মিলিরা আমেরিকায় পাঁচ বছর ধরে আছে। ওর স্বামীর একটা ব্যবসা আছে। তিন বছরের একটা মেয়েও আছে তাদের।
মিলিরা এক বেডরুমের একটা বাসায় থাকে। বাড়ি কিনবে কিনবে করে ওদের মেয়ে হওয়ার পরেও আর বড় বাসা নেয়নি। এখানে আসার পর রাসেল আর শিমুকে লিভিং রুমে ফ্লোরিং করে থাকতে হয়েছে। শিমু তখন চার মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। প্রেগনেন্সি অবস্থায় ফ্লোরে থাকাটা একটু কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু অচেনা এই দূর দেশে এসে মাথার ওপর যে ছাদ পেয়েছে সেটার জন্য অনেক খুশি ছিল। আসার পরপরই মিলির স্বামী কাছেই পরিচিত একটা ডানকিন ডোনাটের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে রাসেলকে কাজে লাগিয়ে দেয়। সেখানে রাসেল ঘণ্টায় ১০ ডলার করে বেতন পায়। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে ট্যাক্স বাদে ৩২৫ ডলার বেতনে খুশি ছিল। কারণ বাংলাদেশের এই বেতন পেতে তাকে পুরো মাস কাজ করতে হতো।
এভাবে এক মাস পেরিয়ে যায়। তারা মিলিদের বাসার কাছেই এক বেডরুমের একটা বাসা ভাড়া নেয়। ভাড়া ছিল ৮০০ ডলার। বাসা ভাড়া আর খাওয়া খরচের পর রাসেলের হাতে আর তেমন সেভিংস থাকত না। এ কারণে শিমুও রাসেলের সঙ্গে ডানকিন ডোনাটে পার্ট টাইম কাজ করে, সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা। এভাবে চলে যায় বেশ কয়েক মাস। এরপর ওদের মেয়ে অনিকার জন্ম হয়। মেয়ের জন্মের তিন মাস পর, শিমু তাদের কাছেই এক বাঙালি আন্টির কাছে মেয়েকে বেবি সিটিং রেখে রাসেলের সঙ্গে ফুলটাইম চাকরি করা শুরু করে।
রাসেল অনেক ভালো কাজকর্ম করে। তাই তার প্রমোশন হয়ে যায়। সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে থাকে। বেতনও বেড়েছে। আর এক বছরের যেতেই সেই ডানকিন ডোনাটের মালিক রাসেলের কাজে অনেক বেশি সন্তুষ্ট ছিল। পরে তাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ম্যানেজার হওয়ায় বেতন বেড়েছে, দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। শিমু আর রাসেল মিলে কঠোর পরিশ্রম করে কয়েক বছরে ভালোই করেছে। বাংলাদেশে বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট কিনেছে, বোনের পড়াশোনা শেষে বিয়ে দিয়েছে। ভাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষে এখন একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করছে। আমেরিকায় বাড়ি-গাড়ি করেছে। এ ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ারে এখন তারা তিনটা ডানকিন ডোনাটের মালিক।
আজ তাদের দশম বিয়ে বার্ষিকী। আজ তারা বাইরে যাবে খেতে। শিমু ওই নীল শাড়ি পরেছে। রাসেল দেখে বলল, তুমি এটা কী পড়েছ?
শিমু বলল—তুমি জানো এটা কোন শাড়ি? তোমার খেয়াল আছে? যে শাড়িটা তুমি বিয়ের পর প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমার জন্য কিনেছিলে। যেটার জন্য মায়ের কাছে বকুনি শুনেছিলে। আমার জন্য তোমার বুক ভরা ভালোবাসা আমি অনুভব করেছিলাম। তুমি অনেক বদলে গেছ রাসেল। আমেরিকা আসার পর টাকার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে তোমার সময় নেই। সময়ের সঙ্গে আমাদের ছোট ছোট সুখ-স্বপ্ন-আশা-ভালোবাসা সব বিলীন হয়ে গেছে। স্মৃতি হয়ে শুধু রয়ে গেছে এই নীল শাড়িটা।