এক ফ্রেমে দুই মুখ

বার্ষিক পরীক্ষার পর বাচ্চারা পড়ার চাপমুক্ত। তেমনি এক শীতের বিকেলে ছেলেমেয়েরা ঘরের আঙিনায় খেলারত। পিঠের একটি ইজিচেয়ার নিয়ে একটি ঠেলাগাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের গেটের বাইরে। ‘ব‍্যাপার কী? কার জিনিস?’ কৌতূহলী চোখের মানুষগুলোর একসঙ্গে অস্থির জিজ্ঞাসা ঠেলাওয়ালাকে?
–কার ওটা?
–কে পাঠিয়েছে?
–আপনি ঠিকানা ভুল করেন নাই তো?
ঠেলাওয়ালা তার হাতের চিরকুট মেলে ধরল।
–আরে এখানে তো পরিষ্কার করে লেখা, ‘বাড়ি নং ১৪, রোড নং ১৬, ব্লক বি, উপশহর।’
–কোথাও ভুল হয়েছে। আমাদের তো কোনো ইজিচেয়ার আসার কথা নয়। আপনি বরং যেখান থেকে ওটা এনেছেন ওখানে ফেরত নিয়ে যান।
–আমি ওটা এখন নিতে পারব না। ফার্নিচার দোকানের মালিক এটা বের করে দিয়ে দোকান বন্ধ করে চলে গেছেন। কাল শুক্রবার। দোকান বন্ধ। পরশু দোকান খুললে তাঁকে জিজ্ঞেস করে যদি এটা আপনাদের না হয়, তাহলে আমি ফেরত নিয়ে যাব। ওই দুদিন ওটা আপনাদের বাসায় রাখুন।
কী আর করা। কাঠের তৈরি ইজিচেয়ারটাকে ঘরের ভেতরে নেওয়া হলো। তারপর খাওয়া–ঘুম ভুলে তিন ছেলেমেয়ের ইজিচেয়ারে দোল খাওয়া আর থামে না। ভুল করে যখন আমাদের ঘরে চলে এসেছে, তখন আমরা
প্রাণভরে দোল খাই। পরশু তো ওটা চলেই যাবে। আমার বাচ্চারা দোল খায় আমার ঘরে, আর আমি দুলনির স্মৃতিতে দুলতে থাকি।
বাদশাহ নানা ও নানি নিঃসন্তান দম্পতি; আমার মায়ের ফুফা-ফুফু। বাদশা নানা ডুয়ার্সের এক চা বাগানে চাকরি করতেন। তাঁদের জীবনযাপনে পরিলক্ষিত হতো বাদশাহি ভাবসাব। বিশেষ করে তাঁদের ঘরের কাঠের ফানির্চারের কারুকাজ ছিল এককথায় অপূর্ব। ফুলে ছাওয়া পরিষ্কার ঝকঝকে বাড়ি গ্রামের মানুষের চোখে আলাদা ও অনন্য ছিল। গ্রামের অন‍্যান‍্য বাড়িতে লাউ, সীম, পেঁপে, কুমড়া বা অন‍্যান‍্য শাক-সবজির বাগান থাকলেও বাদশাহ নানা-নানির বাড়ির সর্বত্র ছিল নানা জাতের নানা আকৃতির ফুলের গাছ।
শৌখিন নানা-নানির এক ছেলে জন্মের পর মারা যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো সন্তান হয়নি। এ নিয়ে নানা-নানির মধ‍্যে কোন দুঃখ বা কষ্ট কখনো প্রকাশিত হতে দেখেনি কেউ। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর নানা-নানি বাড়িতে থাকতেন, বাগান করতেন। তাঁরা দুজন খুব সময়নিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। প্রতি বিকেলে নানা-নানি তাঁদের ঘরের সামনের বকুল ফুলের গাছের তলায় বসে চা পান করতেন; বই-পত্রিকা বা গল্প করতেন। নানা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসতেন, আর নানি পাশেই একটি মোড়ায়।
বাদশাহ নানা মারা গেলে নানিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে দিলেন। কিন্তু ইজিচেয়ারটা বিক্রি করতে নানিকে রাজি করানো গেল না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেয়ারটাকে নানি তাঁর শিয়রের পাশে রেখে দিয়েছিলেন।
ছেলেমেয়েদের বাবা কালিঘাটের ব‍্যবসায়ী। রাতে বাড়ি ফিরলে বাচ্চারা অতি উৎসাহ নিয়ে ঠেলাওয়ালার ভুলে ইজিচেয়ারের ভুল ঠিকানায় চলে আসার বর্ণনা দিতে শুরু করল। কিছু না বলে বাবা ও বাচ্চাদের সঙ্গে ভুল ঠিকানায় চলে আসা ইজিচেয়ার দেখলেন, দুললেন। বাচ্চারা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর দু হাতে আমার দু চোখ ধরে লিভিংরুমে নিয়ে চেয়ারটায় বসিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার। এটাতে বসে দুলে দুলে তুমি আরাম করে বই পড়বে।