শান্তনু

এ গল্প কোনো বউ-শাশুড়ির গল্প নয়। পাড়ার একটি ছোট ছয় বছরের ছেলের গল্প, যার নাম শান্তনু। আমাকে বউমা বলে ডাকত। কারণ, ওর মামার সঙ্গে আমার এক সময় সম্পর্ক ছিল। মা-বাবা আদর করে নাম রেখেছিল লেখনী। শান্তনুর মায়ের ভাই, মানে তার মামা আর আমি চাইতাম দুজন বিয়ে করব এক সময়। ওর নাম ছিল চন্দন। চন্দনের বোন ও তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে এক সময় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় আবার বিয়ে করার। বিপদ এখানেই। এখনো আমাদের সমাজ, বোধ হয় বাচ্চাসহ কোনো মহিলাকে বিয়ে করার ছাড়পত্র দেয় না। আর ভালো পাত্র হলে তো কথাই নেই।
চন্দনের বোন তাই ভালো পাত্র পেয়ে বাচ্চার কথা গোপন করে আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্বামীসহ আমেরিকা চলে যান। চন্দনের বোনের প্রথম ঘরের ওই ছেলেটির নামই শান্তনু। ওকে দেখলে কি যে এক মায়া হতো আমার। কী করে মা তার নাড়ি-ছেঁড়া ধনকে ফেলে রেখে বিয়ের পিঁড়িতে আবার নতুন বউ সেজে বসে? প্রশ্ন জাগে লেখনীর মনে। বিয়ের আগে শান্তনুর মা তাকে তার নানির কাছে রেখে আসে। তখন শান্তনুর বয়স মাত্র এক বছর। সেই যে দূরে পাঠালেন সন্তানকে, তারপর আর কখনো খোঁজও রাখেননি। মা কী জিনিস শান্তনু তখনো বুঝে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় স্বামী শুধু জানত বিয়ের খবর। কিন্তু জানত না প্রথম ঘরের সন্তানের কথা। লেখনী প্রায়ই চন্দনকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করত। কিন্তু কোনো উত্তর পেত না। এদিকে নানি-মামাদের কাছে বড় হতে থাকে শান্তনু।
এরই মধ্যে চন্দনের সঙ্গে লেখনীর প্রেমের সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। লেখনী খুব ভালোবাসত শান্তনুকে। প্রায়ই ওর জন্য এটা-ওটা গিফট কিনে মামার হাতে দিত। ভারী মিষ্টি ও শান্ত স্বভাবের একটি ছেলে ছিল। ছয় বছর বয়সে একদিন শান্তনু হঠাৎ লেখনীকে বউমা বলে ডাকতে শুরু করে। লেখনী শান্তনুকে বলল, ‘তুমি আমাকে বউমা বল কেন?’ শান্তনু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে মন খারাপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে মাথা উঁচু করে বলল, ‘তুমি অনেক ভালো। তাই বউমা বলতে চাই।’ লেখনী শান্তনুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘তাই বলো, যা তোমার ভালো লাগে।’ আচ্ছা বউমা, আমেরিকা তো অনেক অনেক দূরের দেশ তাই না? এটা কি আকাশের মত দূরে?’
লেখনী বুঝতে পারে শান্তনুর কষ্ট। তবুও জিজ্ঞেস করল, ‘কেন তুমি জিজ্ঞেস করছ?’ শান্তনু সহজ-সরলভাবে বলল, ‘আমি যদি ওই দূরের আমেরিকা যেতে পারতাম, তাহলে মাকে একবার দেখে আসতে পারতাম। মা দেখতে কেমন? মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আমি কীভাবে যাব আমেরিকা। আচ্ছা বউমা মা দেখতে ওই তারার মতো উজ্জ্বল? তোমার মতো মায়াবতী হয় তাই না?’ শান্তনুর চোখ দুটো ছলছল করে; মায়াভরা মুখখানি। লেখনী কী বলবে ভেবে পায় না। বুকটা ভেঙে যায় কষ্টে। মায়াবতী না ডাইনি। কীভাবে এমন সন্তানকে ভুলে থাকে। ওর ছোট ছোট চাওয়াগুলো লেখনী চেষ্টা করত পূরণ করতে।
এভাবে বছর দুই কাটল। মাঝেমধ্যে চন্দন ওকে সঙ্গে নিয়ে আসত। চন্দন পেশায় তেমন ভালো কিছু করত না। লেখনী আর চন্দনের বিয়েটা পারিবারিক কারণেই আর হলো না। কিন্তু শিশুটিকে তো লেখনী ভালোবেসে ফেলেছে। ওর মা হওয়ার খুব সাধ হয় লেখনীর। কিন্তু লেখনীর মা-বাবা এটা কোনো দিন কি মেনে নেবে? একদিন লেখনীর মা একটি ভালো পাত্রের সন্ধান পেল। পাত্র পেশায় ডাক্তার। আমেরিকায় থাকে। লেখনীকে প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ‘মা আমি বিয়ে করব না।’
মা-বাবার হুকুম ছিল আজ থেকে এই শান্তনুর চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে। এর পর এক প্রকার চাপের মুখে লেখনীর বিয়ে হয়ে যায় আমেরিকা থাকা পাত্রের সঙ্গে। চন্দনের বিচ্ছেদ যত না কষ্ট দিয়েছিল, তার চেয়ে কষ্ট হয়েছে ভুলে থাকতে শান্তনুকে। লেখনী বসে বসে ভাবে, ‘আমাকে দেখার সঙ্গ সঙ্গে কী মায়া ও ভালোবাসায় আমাকে জড়িয়ে ধরতি, যাতে কোথাও পালাতে না পারি। সত্যি আমরা সবাই তোর মতো করে কাউকে ভালোবাসতে পারি না কেন রে? নিজেদের লাভের জন্য ছেড়ে যাই সবকিছু?’